সবুজ পাসপোর্টের পিছুটান

সবুজ পাসপোর্টের পিছুটান

আমার এক বন্ধু পুরো পরিবার নিয়ে সম্প্রতি কানাডায় মাইগ্রেট করেছে । কি কারনে করেছে জানিনা । সবুজ পাসপোর্টের প্রতি ফ্যাডআপ হয়ে নাকি বিদেশী পাসপোর্টে আকৃষ্ট হয়ে কে জানে ? ছেলেমেয়ের ফিউচারের কথা ভেবেও তা করতে পারে । ও দেশে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ অনেক ভাল। পড়াশুনা করে একটা ডিগ্রী নিতে পারলেই হল। ফিউচার সিকিউর। আর এ দেশে ? অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রী নিয়ে মাসের পর মাস বছরের পর বছর বেকার থাকতে হয়।একতা চাকরির আশায় অফিসে অফিসে ধরনা দিতে হয়। তার ওপর ওই দেশে জীবন যাপনের স্টাইল, সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা সবকিছুই আকর্ষণ করার মতো । অন্যদিকে সিঙ্গাপুরে বসবাসকারী বেশকটি ফামিলিকে জানি যারা কানাডার রেসিডেন্টশিপ নিয়ে সেখানে গিয়ে থাকার সাউন্ডিং নিচ্ছে। আবার এমন অনেক কে চিনি যারা চাকরির খাতিরে সবুজ পাসপোর্ট বদলালেও মন পড়ে আছে দেশে। অনেকে আবার দেশের প্রতি টান হালকা হবার ভয়ে সবুজ পাসপোর্ট আঁকড়ে ধরে আছে । আমি ওদেরই একজন। কানাডায় এমেগ্রানট ইমিগ্রান্ট হওয়া বন্ধুটি সম্প্রতি ফিলিপাইনের ভিসা নিতে গিয়ে তার তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন।বন্ধু ভেবেছিল কানাডায় ইমিগ্রান্ট হওয়ার সুবাদে ভিসা পাওয়াটা সহজ হবে।সে রকমটা হয়নি। সত্য হল যতক্ষণ হাতে সবুজ পাসপোর্ট থাকবে ততক্ষণ সে একজন পিওর বাংলাদেশী । ভিসা নিতে হলে পৃথিবীর সব এমবাসিতে সবুজ পাসপোর্টধারীদের কদর কমবেশি একই রকম। আমি দশ বছর সিঙ্গাপুরে থাকলেও ওদের চোখে তা কোন পার্থক্যই তৈরি করেনি। সবুজ পাসপোর্ট থাকার কারনে শুধু এ বছরেই আমার চার-চারটি বিদেশ সফর বাতিল হয়েছে।ভিসা পেতে একদিন দেরি হওয়ার কারনে চায়নার একটি এবং ফিলিপাইনের দুইটি সফর বাতিল করতে হয়েছে। গত মাসের শেষ দিকে থাকা হংকং সফরটাও সময়মত ভিসা না পাওয়ার কারনে বাতিল হয়েছে। এ নিয়ে বস মোটেও সন্তস্ট না ।বছর দশেক হল তিনি নিজের ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট সারেন্ডার করে সিঙ্গাপুরের পাসপোর্ট নিয়েছেন। ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট ছেড়ে দিলেও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। দেশে যাওয়ার সময় পিআইও(পিপলস অফ ইন্ডিয়ান অরিজিন) আইডি কার্ড ব্যবহার করেন। এ কার্ড নিয়ে পাসপোর্ট থাকার মতোই সুজগ-সুবিধা উপভোগ করেন। আমাকেও পাসপোর্ট বদলানোর উপদেশ দেন। সিঙ্গাপুরিয়ান যে মেয়েটি আমার ভিসার কাগজ প্রসেস করে সে সেদিন জিজ্ঞেস করল, প্রিথিবীতে এমন কোন দেশ আছে যে তুমি ভিসা ছাড়া জেতে পার? বললাম পারি। সে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইল। বললাম বাংলাদেশ।শুনে মেয়েটি হেসে উঠল। বললাম, পরিস্তিথি দেখে মনে হচ্ছে কিছুদিন পর সেখানে জেতেও আমাকে ভিসা নিতে হবে।আমার কথা শুনে ওর হাসি বেড়ে গেল।

সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে বিশ্বের আর সব অনুন্নত দেশের তুলনায় আমরা কোন অবস্থানে আছি তা একটু তুলে ধরি। ফিলিপিনো ভিসার কথাই ধরা যাক। একশ পঁয়তাল্লিশটি দেশের নাগরিকদের সেদেশে যেতে আগাম ভিসা নিতে হয় না। পাসপোর্ট আর রিটার্ন টিকেট নিয়ে অবতরন করলে একুশ দিন পর্যন্ত থাকার পারমিশন পেয়ে যায়। সে লিস্টে ইথিওপিয়া,সোমালিয়া,নেপাল, ভুটানের মতো দেশ থাকলেও বাংলাদেশ নেই। হংকংয়ের ভিসার ক্ষেত্রে সবুজ পাসপোর্টের অবস্থা আরও করুন। অন্তত শ’দেড়েক দেশের নাগরিকদের সেখানে যেতে আগাম ভিসা নিতে হয় না। অবতরন করার পর দেশভেদে ১৪ দিন থেকে ৯০ দিন থাকার পারমিশন পেয়ে যায়। বাংলাদেশের নাম সে লিস্টে নেই। ভিসা নেওয়ার লিস্টে যে গোটা পঞ্চাশেক দেশ আছে সেখানেও বাংলাদেশের নাম লাল অক্ষরে লেখা। লোকাল এমব্যাসি এসব লাল অক্ষরে লেখা দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে ভিসার ডিসিশন নিজেরা নিতে পারে না।কাগজপত্র ডাকে হংকং পাঠানো হয়। সেখান থেকে গ্রিন সিগন্যাল পেলেই ভিসা মেলে। চাইনিজ ভিসারও একই অবস্থা। বিজনেস ভিসা (এফ ভিসা) পাওয়া অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তার জন্য খোদ চায়না থেকে ইনভাইটেশন লেটার আনতে হয়। সে লেটার আবার ফাক্স-ইমেইলে এলে হবে না।অরিজিনাল লেটার ডাকের মাধ্যমে আনতে হবে। ভিসা দ্রুত প্রসেসিংয়ের জন্য যে এক্সপ্রেস সার্ভিস চালু আছে তা আমাদের লাল অক্ষরে লেখা বাংলাদেশি নাগরিকদের বেলায় প্রযোজ্য না।

নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের পর পরিস্থিতি বদলে গেছে মানলাম কিন্তু জঙ্গিবাদের প্রতি সিংহভাগ বাংলাদেশির নেতিবাচক মনোভাব, তা দমনে সরকারের কঠোর মনোভাব, সংখালঘুদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ বসবাস এ দেশকে এক মডেল দেশে পরিনত করেছে। সেটা ভাবলে ৯/১১ পরবর্তী বিশ্বে বাংলাদেশের পজিশন আরও ভাল হওয়া উচিৎ ছিল। আসলে সবুজ পাসপোর্টের এই অবমূল্যায়নের জন্য সরকার,আদম ব্যাপারী, আমারা নিজেরা সবাই কমবেশি দায়ী।দেশের এক পাল বেকার মানুষকে নিয়ে আদম ব্যাপারীরা বছরের পর বছর ধরে অমানবিক ব্যবসায় লিপ্ত। তা নিয়ন্ত্রনে কোনো সরকারই কঠোর পদক্ষেপ নেয় না। মুনাফালভী কিছু ব্যাপারি বিদেশী দালালদের হাত করে হাজার হাজার যুবককে বিমানে তুলে দিচ্ছে। কয়ালিফিকেশনের তোয়াক্কা নেই। সেখানে গিয়ে কি কাজ করবে? বেতন কত হবে? এসবের সুস্পষ্ট এগ্রিমেন্ট নেই। গন্তব্যে পৌছার পর অনেকেই প্রতারনার শিকার হয়। অনেকেই দেশে ফেরার বদলে অবৈধভাবে থাকা শুরু করে। লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ করে। ধরা পড়লে নাম খারাপ হয় দেশের। হাজারো শিক্ষিত যুবক নিজেদের বিকশিত করার জন্য সুযোগ খুঁজছে। বিশ্ব বাজারের চাহিদার সঙ্গে ওদের সঠিক ভাবে মিলিয়ে দিতে পারলে দেশের চেহারাটাই পালটে যেত।

সরকারেরও করার অনেক কিছু আছে। ভিসার শর্ত সহজ হওয়ার জন্য দেশের ইমেজ ভাল হতে হয়। আমারা বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতিতে মডেল নিচ্ছি। চ্যাম্পিয়ন না হলেও চ্যাম্পিয়ন থেকে আমাদের অবস্থান খুব একটা দূরে নয়। দুর্নীতি হলো ভালো কাজের প্রতিবন্ধক। বিশ্ববাসি যখন আমাদের বারবার এ রকম অবস্থানে দেখে তখন আর আমাদের থেকে ভালো কিছু আশা করে না। সদিচ্ছা থাকলে আমারা সে ইমেজ পাল্টাতে পারতাম। ইন্দোনেশিয়ার আদলে শ্রী মুলায়িনি গোছের কাউকে দুদকে কিংবা অর্থ মন্ত্রানালয়ে বসিয়ে বিশ্ববাসির বাহবা কুড়াতে পারতাম। ভিসার নিয়ম কানুন দুই দেশের পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতেই সহজ করা যায়। যেসব দেশের কাছে আমরা লাল অক্ষরে চিহ্নিত হয়ে আছি সরকার সেসব দেশের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারে। সুষ্ঠু আলোচনার মাধ্যমে অনেক কাজই হাসিল করা যায়।

কানাডিয়ান পাসপোর্ট হাতে পেলে বন্ধুর ভিসা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা যারা সবুজ পাসপোর্ট আগলে আছি তারা সিঙ্গাপুর পাসপোর্ট নিলেও সমস্যা পিছু ছারবে না। সিঙ্গাপুর সরকারের ডুয়েল সিটিজেনশিপ পলিসি নেই। তার মানে সিঙ্গাপুর পাসপোর্ট নিতে হলে সবুজ পাসপোর্ট সারেন্ডার করতে হবে। নানা কারনে আমরা সবুজ পাসপোর্ট ছাড়ছি না। এটা ছাড়লে দেশে থাকা ধনসম্পদের কি হবে? সে নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত। কেউ ভাবছি এটা ছাড়া দেশের প্রতি সম্পর্ক হালকা হওয়ার শামিল। এটা আগলে রেখে মনের দেশপ্রেম যতই চাঙ্গা মনে হোক না কেন সত্য হলো এটা নিয়ে ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমন করা সহজ কোন কাজ হবে না। তাছাড়া সবাই যখন দলপ্রেমে আর পকেট প্রেমে মত্ত তখন আমার মতো সাধারন এক মানুষের দেশপ্রেম একটু হালকা হলে কি আসে যায়? রুজি-রজগারের খাতিরে আমাকেও বুঝি সবুজ পাসপোর্টটা ছাড়তে হবে।

হারুন অর রশীদ
সিঙ্গাপুর থেকে

Harun_21st
harun5200@yahoo.com ( পূর্বে প্রকাশিতঃ দৈনিক যায়যায়দিন ৪জুলাই ২০১০)

Share