[SMC Magazine ‘নোঙর’] জেগে ওঠার গল্প : তাহসীনা সাইফুল্লাহ তুলি

[SMC Magazine ‘নোঙর’] জেগে ওঠার গল্প : তাহসীনা সাইফুল্লাহ তুলি

একটা শান্ত দুপুরের নিরিবিলিতে ভেজা অচিন নদীর কূল। তার পাড় ঘেষে সে কোন অনাদিকালের ছায়ামাখা ঝুড়িবট। মিঠে বাও নেড়েচেড়ে দিচ্ছে তার উদাসী ডালপালা শুকনো পাতা। মধ্যদুপুরের নিমগ্নতায় একা, শান্ত ছায়ায় দাড়িয়ে ওই প্রাচীন মহীরুহ কোন শিকড়ের রহস্যময় টানে আমাকে ডেকে যায়। চোখ বন্ধ করে আমি তার গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকি, আর আমায় ছুঁয়ে যায় জোলো মিঠে হাওয়া ঝিরি ঝিরি ঝিরি ঝিরি ঝিরি ঝিরি। বেঁচে থাকা মাঝে মাঝে এতো সুন্দর হয়, এতো স্বপ্নময় হয় যে আমরা ভালবেসে ফেলি শুধুমাত্র বেঁচে থাকাকে।

ভোরের অলিক ক্ষণে ঝরে পরা শিশিরবিন্দুর জীবন। সতেজ, স্নিগ্ধ, কমনীয়। শিরশিরে হিমেল বাতাস ছুঁয়ে যায় তার নিটোল সত্বা, ঝিল্কিয়ে ওঠে সে সূর্যরশ্মিরতেজালো স্পর্শে। আর তারপর? মিলিয়ে যায় মায়া রেখে। মহাকালে। শুধু রয়ে যায় তার অস্পষ্ট স্মৃতি । সবুজ পাতাগুলোর উদাসী মনে শুকিয়ে যাওয়া জলেরকনার চিহ্ন রেখে। হ্যা, ভোরের ঐ শিশিরবিন্দুর মতোই ক্ষণস্থায়ী মহাকালে আমাদের জীবন, বেঁচে থাকা। আমরা বেঁচে থাকি আলোয়,যা কিছু সব ভালোয়। বাঁচি হাসতে, বাঁচি ভালবাসতে। এক জীবনে এই বেঁচে থাকার জন্য শুধু পার হই কতো কঠিন পথ, ছেড়ে আসি কতো আপনজন,কতো মায়া, কতো নাড়ি পোতা হ্রিদ্য ভূমী! সেই ভূমী যাকে দেশ বলে। নিজের দেশ। নিজের কথাটি বড় স্বার্থপর এবং ভীষণ আপন। তাই তো সহস্র মাইল দূরে এক ঘোলা সাগরের পারে পৃথিবীর সবচে বিশাল সৈকত বুকে নিয়ে একটেরে পরে থাকা নিজের ঐ দেশটা  ক্ষণে- বীক্ষণে  উত্তাল সব ঢেউ তোলে মনের গহন গভীরে। আমরা আন্দোলিত হই, আপ্লুত হই, তুমুল তর্ক করি আর, আর বড় ভালোবাসি। ভালবেসে নিজের মধ্যে নিজে গলে যাই। কখনো গর্বে, কখনো হতাশায়, কখনো প্রবল ক্রোধে, আবার মাঝে মধ্যেই আনন্দে… সবচে বেশি স্মৃতিতে।

কিছু স্মৃতি আছে যা হৃদয়ের গভীরে গচ্ছিত রেখে আমরা নিত্যদিনের বাঁচা বেঁচে থাকি। যে যত কথাই বলুক না কেন এখানে এই উজ্বল আনন্দময় নিরাপদ প্রবাসে আমরা খুব খুব খুব ভাল আছি। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে একবার বলুন তো আকাশ পাতাল মাতাল করে যখন আলোর রেণু নিয়ে  জোছনা আসে ,প্রবল বর্ষণে কাঁচকাটা পানির নিক্কনে ঘন ছায়ায় ছেয়ে বর্ষা, ঝড়ের মত্ত পৌরুষ সুন্দর যখন আকুল আবেশে বাধাহীন ভাললাগায় উদ্বেল করে দেয়  বুক তখন কি খাঁ খাঁ করেনা মন নিজের মাটির জন্য? সোঁদা গন্ধ কি ওঠায় না নাড়ীর টান? হৃদয়ের ভার বইতে বড় কষ্ট হয় তখন ।তাই না?  চোখ বুজে তখন ডুব দিতে হয় মনে, নিজের গভীরে। এক যাদুর রথ হাওয়ার বেগে, আলোর ছন্দে একটানে নিয়ে যাবে সেই সব সুগন্ধি ক্ষণগুলোয়। যেখানে ফিরে গেলে মনভরে উঠবে কখনো টাটকা কাঠ গোলাপের মাতাল সুবাসে কখনো বা মিঠে কামিনীর বিভোর গন্ধে। আমার কেমন মনে হয় ওইসব স্মৃতিতে শুধু সুবাস নয়রঙ ও জড়িয়ে থাকে। হালকা হালকা লেবু হলুদ বা গাঢ় আকাশ রঙা স্মৃতি।
রোদের গায়ে কে যেন কুয়াশা মেখে দিয়েছে । অস্বচ্ছ আর রহস্যময় আর নিরিবিলি ।এখন দামাল চৈত্র। হয় ঠা ঠা রোদ্দুর অথবা ছাই রঙা মেঘ। আকাশেরযে কত শত নতুন সাজে সাজতে ইচ্ছে হয় এসময় ! যখন তখন যা ইচ্ছে তাই। কল্পনায় দেখি, মিঠে হলুদ আভা মাখা, নরম মায়া মায়া রোঁদ আজ বাংলাজুড়ে। তরুণীর নিটোল কপোল ঝলসে উঠে মায়াবি লাবন্যে, দেশের প্রকৃতির মতোই হিমেল হাওয়া আর শুষ্কতা ঝেড়ে ফেলে এ ঋতু জুড়ে যে সোনা রঙেসাজবে সে। যে গৈরিক বর্ণ একদিকে বৈরাগ্যের রাগিণী গায় অন্য রুপে তাই যে আবার উৎসবের, সৌন্দর্যের,প্রানের ঝর্না নিয়ে বসন্তকে গৌরব দানে। একটাবাসন্তী শাড়ি, কিছু গাঁদা’র মালা খোপায় গোঁজা, লাল একটা টিপ- তারুন্য ছোঁয়া বসন্ত দিন এখন। এ প্রানের দোলা ছুঁয়ে যায় ঘরকে বাইরেকে । এ সময় বাংলার দুয়ার খুলে বের হয় শুভ্র আনন্দ, নব রুপে রঙে সেজে। মৌমাছির গুঞ্জনে, আধ ফোটা বেলকুঁড়ির সৌরভে, হাওয়ায় হাওয়ায় প্রাণ জাগে যে গ্রামের আমের পাতায়, নিবিড় শহরের রাধাচুরোর সোনালি ফুলে ।  আর মাত্র কটা দিন তার পরই রাজপথ আলো করে ফুটবে আগুনের মত কমলা লালকৃষ্ণচূড়া। দুহাত ভরে নিয়ে যে ফুলকে ভীষণ হিংশেয় বলতে ইচ্ছে হয়,’ইশশশ কি সুন্দর…’।হঠাত কোনো এক আকুল দুপুরে ঝা ঝা রোদ্দুরে কৃষ্ণচূড়াময়কালো পথ ধরে হেঁটে চলা…একলা…শুধু সুন্দরের হাত ধরে ।

আমরা মানুষ, বিধাতার শ্রেষ্ঠ  সৃষ্টি। অনুভবে নানা  বিমূর্ত বিষয় ধারণ করি শুধু আমরাই। আমরা জন্ম নেই,বেড়ে উঠি চেতনে মনে বোধে মননে। বেড়ে ওঠার ধাপগুলোয় অনায়াসে কেউ কেউ একদম বদলে যাওয়া নতুন একজন হয়ে যায়। আবার  কেউ কেউ এমন আছে  যারা মনের গভীরেশৈশবকে জিইয়ে রেখে বয়সের রথে চড়ে। তারা সুখে,দুঃখে, ব্যাথায়, অভিমানে, বিশ্বাস ভঙ্গের বেদনায়, অন্যায়ে, আনন্দে প্রকৃতির সন্তান হয়ে  নিলাভ সবুজঅনুভুতিময় গাছের মতোই  কখনো নুয়ে যায় কখনো বা পত্রপ্ললবে উদ্বেল হয়ে ওঠে। আমরা জীবন পথে পেরিয়ে যাই কতো শত নিত্যদিনের ঝড় ঝঞ্ঝা। কর্তব্য ধর্মের গায়েবি শিকল তার অদৃশ্য পাকে মুড়ে নিয়ে এক যন্ত্রের মতো জীবনের ইঞ্জিনে জুড়ে দেয় আমাদের। কর্ম  দখলে নেয় আমাদের চিন্তা, আমাদের অনুভবের সবগুলো খোলা দরজা।  আমাদের ভাললাগার মন, শুভ সুন্দরের বোধের জানলায়  নৈমিত্তিক একঘেয়েমির মরচে পরে। দিন যায় আমরা বড় থেকে আরও বড় হই। আরও অনেক দায়িত্ব আরও বেশি কর্তব্য আচ্ছন্ন রাখে আমাদের । কিন্তু তখনো হয়তো সবার অগোচরে  ওই অলিকপ্রকৃতির খেয়ালে হঠাত খুব হাওয়া ওঠে,রোদের কনাগুলো কোথা থেকে আসা এক যাদুর ছায়ায় মুড়ে যায়। অপরাহ্নের ধুলো পায়ে মেখে ঘরে ফিরতে ফিরতে হঠাৎ এক হাহাকার ওঠে বুক জুরে,চিরে দেয় অন্তরের একূল ওকূল। শৈশব কৈশোর তারুন্য যৌবন এক রেখায় দাড়িয়ে যেন প্রশ্ন ছুড়ে দেয়মনের কাছে ! বেঁচে থেকে কেন পায়ে পড়লে দাসত্বের শিকল? দেখলে না রঙ,সাজলে না রূপে,ভাসলে না বিধাতার অপার করুনা স্রোতে।
প্রকৃতি বলি বা স্রষ্টা, আমাদের ঘিরে আছে তার করুনাধারা। তার যাদুর সে রূপকথালোকে আমাদের বসবাস। একজীবনে ছুটে চলার ফাঁক-ফোকর গলেআমাদের নিজের গভীরে একবার ডুব দেয়া দরকার। আমাদের ঘিরে যে মহাযজ্ঞের নিত্য আয়োজন বিধাতা করে চলেছেন অবিরাম, চোখ খুলে  তা একবার দেখি । এই যে এক গভীর কালো নিরালা রাত্রি, এর অন্তরে এর অম্বরে যে নিত্য বাঁশি বেহাগ রাগে বেজে যাচ্ছে, কতো কি সৃষ্টিছাড়া ঘটিয়ে ছাড়ছে,সময়ের স্রোত উল্টো বাগে ধেয়ে কতো রূপ রস গন্ধে হৃদয় পরিপূর্ণ করে দিচ্ছে,তার কি কোনও লেখা-ঝোকা আছে? আসলে আমরা বেঁচে থাকার, শুধুধুকপুক ধুকপুক শ্বাস নেবার ভিতরেও যে কতো অলিখিত আনন্দ আছে, আছে অর্থপূর্ণতা, আছে ছন্দ, আছে বর্ণ আছে গাঢ় বোধ তা অনুভবই করিনা। শুধুঅতৃপ্তি আর অসন্তুষ্টি জিইয়ে রেখে অর্ধেক বাঁচা বেঁচে থাকি। একদিন হঠাত সামনে এসে দাড়ায় নিয়তির মতো অসহ্য সমাপ্তি। সেই complete শুন্যতা। যারওইপারে আর কিছু নেই। শুধু শুন্য হয়ে যাওয়া। এর মতো বিবর্ণ আর কিছু হতে পারেনা। সেখানে সময় শেষ। সেখানে সুরের শেষ। শুধু একদম শেষ নোয়ানুয়ে পড়া মরা লজ্জাবতীর ঝোপের মতোন শুন্যতা।  তাই কচি, দুটি পাতা একটি কুড়ির  জীবন নিয়ে তার  অল্প কটা আনন্দ বেদনা শুধু অনুভব করে , যাপেয়েছি সেই সুখে আপ্লুত হয়ে এ জগতময় চলতে থাকা নিত্য আনন্দের ধারার অংশ হয়ে যদি থাকতে  পারা যেতো ..তাহলেই হয়তো আজন্ম খুঁজতে থাকাঅলিক হাহাকারের অপরূপ উত্তর  আপনাকে আলিঙ্গন করতো মহৎ সৌন্দর্যে।

 

—————————–

Tahsina Tuly 29

[তাহসীনা সাইফুল্লাহ তুলি- লেখার শুরু ছোটবেলায়, ছড়া  দিয়ে। এরপর দীর্ঘ বিরতি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনা শেষে বাংলারই প্রভাষক বনে যাওয়া। এ কে এম সাইফুল্লাহ’র (২৯) সহধর্মিণী হয়ে নতুন পথের শুরু এবং লেখালেখির দ্বিতীয় পর্যায় আরম্ভ। কিছু ই পত্রিকায় অনিয়মিত লেখা ছাড়া নিজের মনের আনন্দে পড়া আর লেখা দুইই করা হয়। বাচ্চা, প্রকৃতি, স্বদেশ হোল ভালবাসা। আর প্যাশন বই পড়া।]

Share