[SMC Magazine ‘নোঙর’] ভালবাসার ছোঁয়া – রওনক হাসবুন নাহার (রুবা)

[SMC Magazine ‘নোঙর’] ভালবাসার ছোঁয়া – রওনক হাসবুন নাহার (রুবা)

হেমচন্দ্রের ভাষায় “Love is the reciprocity of heart”; অর্থাৎ “প্রানের বিনিময়ে ভালবাসা”। তাহলে যার ভালবাসা নেই তার কি ভালবাসা হতে পারেনা? নিশ্চয় পারে। মানব মানবীর প্রেম কে হেমচন্দ্র মশাই এভাবেই বোঝাতে চেয়েছেন।

হৈমন্তী গল্পে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমি ইহাকে পাইলাম”, তিনি কি করে এত সহজে হৈমন্তী কে পাইয়ে দিয়েছিলেন জানিনা? কিন্তু আমি তাকে কখনই পাইনি। কেবল ই খুঁজে মরছি। যদিও বা কখনও মনে হয়েছে এই বুঝি পাব, আর তখনই দেখেছি চঞ্চল অঞ্চল উড়িয়ে তিনি অপসৄয়মান।

আসলে পাওয়া এত সহজ নয়, আদতেই সম্ভব কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। হাজার সংসার তল্লাশি করে এমন কি অপারেশান ক্লিন হার্ট চালিয়ে দেখলেও একটি যুগল যে নিরবিচ্ছিন্ন ভালবাসায় এখনও কাতর হয়ে আছেন এমন টি পাওয়া অসম্ভব না হলেও বিস্ময়কর তো বটেই! তাই “আমি ইহাকে পাইলাম” এ কথা সত্যি নয়।

বোধ হয় ভালবাসার সবচেয়ে মূল্যবান ও সহজ প্রকাশ হল প্রিয় মানুষটির ছোঁয়া। সদ্যোজাত শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সবার মাঝেই রয়েছে এই আকুতি।

দেখা যাচ্ছে ভালবাসার প্রকারভেদ আছে। তাহলে সব চেয়ে বড় ভালবাসা কোনটি? এ বিষয়ে বড়সড় একটা বিতর্ক আছে। তবে ইতিহাস বলছে ইসলাম ধর্ম এবং দেশ মাতৃকার প্রতি ভালবাসায় যতো সহজে হাজার লোক প্রান বিসর্জন দিয়েছেন, অন্য কোনও ভালবাসায় তার নজির নেই। এই তো ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লাখ লোক হাঁসি মুখে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। পঙ্গুত্ত বরণ করেছেন কয়েক লাখ। অনেক প্রেমিক তাদের প্রেমিকার চেয়ে দেশ মাতৃকার প্রতি ভালবাসা বড় করে দেখে মুক্তিযুদ্ধে গেছেন। অর্থাৎ বলা যায় মানব মানবীর প্রেমের চেয়ে দেশপ্রেম, ধর্ম প্রেম অনেক বড়।
“—-জীবন সমুদ্রের মত বিশাল, দিগন্ত বিস্তৃত আবর্তময়্র। এ এক মমতায় ভরা ঢেউয়ের সমুদ্র। ঢেউ তারপর ঢেউ, তারপর আর ও ঢেউ। এখানে অনেক ফেনা, ডুবে যাওয়া পাঁথরে আছড়ে পরা, আবার আশ্চর্য নীল শান্ত কখনও কখনও। সত্যিই জীবন একটা দারুন গোলমেলে নোনা স্বাদে ভরা দুরন্ত অভিজ্ঞতা। আর আমরা এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষ- সেই সমুদ্রের বুকে উড়ে যাওয়া ছোট নরম সাদা সি-গাল দের মত। আমরা সমুদ্র কে ভঁয় পাই, আবার পাই ও না। আমরা ছোটো অথচ বারে বারে সমুদ্রে ছোঁ মারি। কখনও মাছ পাই কখনও বা পাইনা। কখনও বা সমুদ্র পাড়ের গুহার নীড়ে ফিরতে পারি; কখনও বা ঝড়ে পরে জলে পরি ডানা ভেঙ্গে। তবুও আমরা সি-গাল দের মতই।—-“

তাই উষ্ম হক, হোক শীতল, মাতাল হোক অথবা হোক শান্ত-সমুদ্রই আমাদের জীবন- এ জীবনের জন্যই আমাদের আকুতি, কান্না, আমাদের সমস্ত প্রার্থনা। এই জীবন কেই আমাদের ঘৃণা-ভালবাসা। এর ই মাঝেই বার বার ছোঁ মেরে নামা, বার বার কাছে এসেই আবার দূরে উড়ে যাওয়া। মনে হয় না যে এক জীবনে, জীবনের এই অতল সুনীল তলে কি আছে তা কেই বুঝে পেতে পারে। বোঝা শেষ হয় না বলেই বোধ হয় সমুদ্রের নোনা স্বাদ হু হু হাওয়া ছেঁড়ে অন্য অজানা গন্তব্যে যেতে, যাবার সময় ভারী ভয় করে। মনে হয় যাবার দিনে, যে এই বুঝি শেষ- আর কখনও ফেরা হবেনা।

এখন কেবল সেই শেষের দিনেই বার বার মনে হয়, তবে কেন এ সমুদ্রে মনের সুখে অবগাহন করলাম না, কেন যা চেয়েছিলাম তাকে তেমন করে চাইলাম না, যা চাইনি তাকে তেমন করে কেন ছুঁড়ে ফেলে দিলাম না? কেন মিথ্যের রোষানলে মোহে পড়ে এই জীবন- এই একটাই রহস্যময় সুন্দর ও বীভৎস জীবন কে ফ্রী স্টাইল সাঁতার উপভোগ করতে করতে পাড়ি দিলাম না? সারা জীবন কিসের ভয়, কিসের সঙ্কচ, কিসের দ্বিধা নিয়ে কোন মিথ্যা পুণ্যের লোভে নিজেকে এমন করে ঠকালাম?
উপরোক্ত প্রশ্নবোধক চিহ্ন সম্বলিত কথা গুলো বিদ্ধ করে আমাদের সবাইকে! তাই নয় কি? এরকম হাজার প্রশ্নের আবর্তেও জীবন কখনও থেমে থাকেনা, এগিয়ে যায় নিজস্ব গতিতে।

“—ভালবাসা যদি হয় নিজের ভিতরে অন্যের উপলব্ধি, সেই অনুভবের পক্ষে ঢাক ঢোল পেটানো ভালবাসারই অপমান। আনন্দ যদি হয় জীবন কে উজ্জীবিত করার জন্য এক ধরনের আবেগ, তবে মানুষের আসা যাওয়া তার উপস্থিতি, কোন টা তেই বিষণ্ণ হওয়া উচিত না। বীভৎস স্রোতের পানি যখন নদি কে ভাঙে তখন তার এক পার ই ভাঙ্গে। স্রোত এক সংগে দু পাড় ভাঙতে পারে না। আর এক পার যখন ভাঙে প্রকৃতির নিয়মে অন্য পাড় গড়ে উঠতে থাকে। যে লোহা দিয়ে শিকল তৈরি হয়, সেই লোহা দিয়ে চকচকে ধারালো ছোরাও হয়। এক ই মানুষের জীবন তার নিজের ইচ্ছায় দু রকম হতে পারে।—-“

“—এক জীবনের অর্থ আসলে কি? এক জীবনে এতো কষ্ট কেন পায় মানুশ? সম্পর্কের হাতুড়ী যদি মানুষের বুক ভেঙে চুরমার করে দেয়, তবে এই সম্পর্কেই মানুষ জেনে শুনে আক্রান্ত হয় কেন? যে এত কাছে, যে ঘুমিয়ে থাকে বুকে, তাকে হারানোর তীব্র কষ্ট পৃথিবীতে থাকে কেন? মানুষের সীমাবদ্ধতা মানুষের মৃত্যু। এক মাত্র মৃত্যু ছাড়া পৃথিবীতে যদি শেষ কথা বলে কিছু না থাকে তাহলে এসব প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয় পাওয়া যাবে।—-“

 

PDF Logo_2PDF Version [Published at SMC Magazine “নোঙর” May 2014]
—————————-

Rownok Hasbun Nahar26
[রওনক হাসবুন নাহার (রুবা): পেশায় গৃহিনী, নেশায় সমাজকর্মী। ব্যক্তিগত জীবনে সহধর্মণী – আতাউল মজিদ উজ্জ্বল (২৬)]

Share