[SMC Magazine ‘নোঙর’] মৃত নাবিকের জাহাজ চালনা – খালিদ মাহমুদ (২৯)

[SMC Magazine ‘নোঙর’] মৃত নাবিকের জাহাজ চালনা – খালিদ মাহমুদ (২৯)

২০০৪ সালের ২৮শে  ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭ টার সময় আমেরিকার ভার্জিনিয়ার   উপকূলে “বাও মেরিনার” নামে একটি জাহাজ বিস্ফোরিত হয় । বিস্ফোরণে ২৭ জন ক্রুর মধ্যে ২১ জন মারা গেছে বলে ধারণা করা হয়। কারন ১৮ জনের মৃতদেহ পাওয়া যায় নি। বেচে যাওয়া নাবিকদের কাছে জানা যায় ঘটনা এত দ্রুত ঘটেছে যে কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই জাহাজটি বিস্ফোরিত হয়ে পানির নীচে তলিয়ে গেছে। সেই ঘটনার প্রেক্ষাপটে এবং ঐসব ক্রুর স্মৃতিচারণ করে লেখা হয়েছে গল্পটি।

মিথুন আগের চেয়ে অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। এখন আর হৈচৈ করতে ভাল লাগে না। ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। পাত্রীকে সে একবারই দেখছে। ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে নান্দুসে। জাহাজে আসার আগে হঠাৎ করেই সব হয়ে গেল। তার মামা তাকে ডেকে নিয়ে মেয়ের সামনে বসিয়ে দিয়েছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। মেয়েটা অনেক স্মার্ট। নিমিষেই পুর পরিবেশ হাল্কা করে নিয়েছে। ঠিক এই কারনেই মনে হয় মিথুনের মেয়েটা পছন্দ হয়েছিল। তার পর মাঝে মধ্যে কথা হয়েছে। কিন্তু জাহাজে আসার আগের নানা ঝামেলার কারণে আর দেখা করা হয়ে উঠেনি। আবার বলা যায় পরিবেশ ও ওদের পক্ষে ছিল না। মেয়েটা প্রচলিত অর্থে অত সুন্দরি নয়। বলার মত আহামরি কিছু নেই। কিন্তু সব মিলিয়ে কেমন জানি ভাল লেগে যায়। মিথুন এখনও ভাবে কেন মেয়েটাকে সে পছন্দ করে ? কিন্তু কূল কিনারা করতে পারে না। এক সময় সে হাল ছেড়ে দেয় এই ভেবে যে , সে মেয়েটিকে এখন ভালবাসে। না খুব বেশীই ভালবাসে। আর তা না হলে ক্যাপ্টেনের সামনে সে মেয়েটির কথা ভাবতে পারত না।

ক্যাপ্টেন তার চেয়ারে বসে আছে। চেহারায় অনেকটা নির্লিপ্ত ভাব। এক সময় সে অনেক দাপুটে ছিল। এক সময় বললে ভুল হবে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত সে সবাইকে দাবড়ে বেড়াত। কিন্তু কোন একটা ঘটনার পর থেকে সে ঝিমিয়ে যায়। ঘটনাটা ঠিক কি সে মনে করতে পারে না। সে সামনে তাকিয়ে থাকে ঠিক , কিন্তু কি দেখছে সে নিজেই জানে না। তার পরও প্রতিদিন সূর্যাস্তের সময়টা সে এখানেই বসে উপভোগ করে এবং কোন গভীর চিন্তায় আছন্ন হয়ে পরে। এক সময় বউ বাচ্চাদের নিয়ে সে অনেক চিন্তা করত। কিন্তু এখন আর করার দরকার পরে না। তার স্ত্রী ২২০০ স্কয়ার ফিটের জুহু বীচের ফ্ল্যাটটি মনের মত করে সাজিয়েছিল। কোথায় টিভি বসাবে , লিভিং রুমে কি কি থাকবে , জানালার পর্দা কেমন হবে কত কি ? এই নিয়ে তার সাথে অনেক কথা কাটাকাটি হত। ছেলে মেয়ে দুজনকেই সেরা স্কুল কলেজে পড়িয়েছে । তারা সবাই এখন আমেরিকা থাকে। মেয়ে জামাই দুজনেই ডাক্তার । তার স্ত্রীও ওদের সাথেই থাকে। খুব একটা কথাও হয় না ওদের সাথে। তার শখের ফ্ল্যাটটি এখন ছোট খাট একটা বার। প্রতি রবিবার পুরান বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা এবং ড্রিংক করা ছাড়া দেশে গেল আর কোন কাজ থাকে না।

ফিলিপিনো সেকেন্ড অফিসারের মেজাজ খুব খারাপ। প্রায় প্রতিদিন তার চার্ট কারেকশন আসার কথা। কিন্তু আজ অনেক দিন ধরে কোন চার্ট কারেকশন আসছে না। সে ভাবে ক্যাপ্টেনকে জানাবে কিন্তু সাহস পায় না। মাঝে মধ্যেই সে নেট চেক করে দেখছে। নেটওয়ার্ক পুরো আছে। হঠাৎ করে যখন অনেক গুলো আসবে তার মাথা খারাপ হয়ে যাবে কাজ করতে করতে। অফিস থেকে পরবর্তী ভয়েজের কোন খবরও আসছে না। আসলে প্যাসেজ প্ল্যানটাও করে রাখা যেত। তার মেজাজ খারাপ হবার অবশ্য আরো একটা কারন আছে। গতকাল সে জেনেছে তার এবারের গার্ল ফ্রেন্ড ও চলে গেছে। অথচ ও আসার সময় কত কান্নাকাটি করল। সবই অভিনয়। না আর না। এবার আর সে এই ফাঁদে পা দিবে না বলে মনস্থির করে। এই গত সপ্তাহেই তার সাথে কথা হয়েছিল। ভুলেও বুঝতে পারে নি হুট করে চলে যাবে। খবরটা পাবার পর দুবাই থেকে কেনা বিয়ের আংটি ছুড়ে সাগরে ফেলে দিয়েছে। এখন অবশ্য আফসুস হয়। আংটিটা সে অন্য কোন মেয়েকে দিতে পারত।

অন্য দিকে ফাস্ট ইঞ্জিনিয়ার খুব ঝামেলায় আছে। জাহাজ চলছে। কিন্তু ট্যাংকে তেলের লেভেল কমছে না। অটোমেটিক সিস্টেম না হয় কাজ করছে না কিন্তু ৩য় ইঞ্জিনিয়ার ম্যানুয়ালি তো চেক করতে পারে। ইদানিং তার যে কি হয়েছে !! সারাক্ষন ধ্যান ধরে থাকে। মাঝে মধ্যে মনে হয় কসে একটা থাপ্পড় দিয়ে দিবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর হয় না। সে ঠিক করে ফেলেছে পরের পোর্টেই তাকে নামিয়ে দিতে বলবে চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে। তার পর হঠাৎ নিজেই হেসে ফেলে। কারন ক্যাপ্টেন এবং ৩য় ইঞ্জিনিয়ার একই দেশী। তাই এধরনের চিন্তা না করাই ভাল। মাল্টি ন্যাশনাল ক্রু নিয়ে কাজ করার সুবিধা অসুবিধা দুটোই আছে।

রায়ান অনেক ক্ষন ধরে স্যাটেলাইট টেলিফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ফোনটা কেন জানি তুলতে পারছে না। সে প্রতিদিনই বাসায় ফোন করে। কয়েকদিন আগে তার সহধর্মিণী জিজ্ঞাসাই করে বসল কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা জাহাজে। বিয়ের পর সে অনেক বারই জাহাজে গিয়েছে কিন্তু কখনই এভাবে ফোন করে নি। তার ফোন বিল দেখে ক্যাপ্টেনও তাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিল বাসায় কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা। সে কোন উত্তর দিতে পারে নাই। সে নিজেই জানে না কেন সে এত হোম সিকনেস অনুভব করছে।

৩য় ইঞ্জিনিয়ার রাহুল। তার লক্ষ্য খুব তারাতারি চীফ ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। তাই পেশা নিয়ে সে অনেক সিরিয়াস। ক্যাডেট থেকে খুব অল্প সময় সে ৩য় ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। এবং তার সুনাম সবাই করে। একবার যারা তাকে জাহাজে পেয়েছে সবাই খুব স্নেহ করে এবং পছন্দ করে। তার বাবা মা দুজনেই ইন্ডিয়ান আর্মির অফিসার ।বাবা কর্নেল , মা মেজর। এক মাত্র বড় ভাই ও নেভিতে আছে। তার পরিবারের অন্য সবার ধ্যান জ্ঞ্যান আর্মি কেন্দ্রিক। সে পরিবারের সবার অমতে মেরিনে এসেছে। অবশ্য তার একটা কারন আছে। তার মামা মেরিন ইঞ্জিনিয়ার । বোম্বেতে বিশাল বাংলো। বোম্বে বেড়াতে গেলে মামার বাসায় উঠত। ছোট বেলায় মামার কাছে অনেক গল্প শুনেছে জাহাজ সম্পর্কে। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাহাজে চাকরি করতেই হবে। কিন্তু গত কয়েক দিনে সে অনেক বদলে গেছে। কাজে কর্মে মন বসাতে পারছে না। কিছুই যেন ভাল লাগছে না।
গ্যালিতে ( রান্নার স্থান ) হাল্কা গান বাজছে । গান শুনতে শুনতে রান্না করা চীফ কুকের শখ। কিন্তু এখন কাজটা সে করে খুব সাবধানে। প্রতিদিনই নতুন নতুন নিয়ম কানুন আসছে। সেফটি বাড়াও। এক্সিডেন্ট কমাও। সে মাঝে মাঝে মনে করে এক সময় কাজ কর্ম বন্ধ করে দিয়ে সুধু সেফটি দিয়ে খাওয়া দাওয়া করতে হবে। সে জানে এই সময় বাড়িওয়ালা নিচে আসবে না। তাই একটু চান্স নিচ্ছে। ( ক্যাপেনকে ক্রুরা বিভন্ন নামে ডাকে তার ভিতর বাড়িওয়ালা অন্যতম) । আজ সে ইংলিশ ফুড তৈরি করছে। এটা তার নিজেরও অনেক পছন্দ। ইংলিশ ফুডের সাথে মিষ্টান্ন হিসাবে আইসক্রিম দেয়া হবে। স্টুয়ার্ডকে ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম আনার জন্য পাঠিয়েছে । অনেক্ষন হল ছেলেটা এখনও আসছে না।

চীফ অফিসার ডেক অফিসে বসে আছে। কাজ শেষে বোসানের তার কাছে রিপোর্ট করার কথা। কিন্তু সে এখনও আসছে না। সাধারণত ছয় টার অনেক আগেই ওরা ছুটির জন্য চলে আসে। আজ মনে হয় কোথাও কোন সমস্যা হয়েছে। একবার ভেবেছিল ডেকে যেয়ে দেখে আসবে । কিন্তু এখন আর সেফটি সু , হেলমেট পরতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া “বুড়া” এখন ব্রিজে বসে আছে ( অফিসাররা ক্যাপ্টেন কে অনেক নামে ডাকে তার ভিতর “বুড়া” অন্যতম) । সে খুব বেশি দরকার না হলে তার সামনে পরতে চায় না। তার সামনেই ২য় ইঞ্জিনিয়ার বসে আছে। তারা দুজনেই একই একাডেমীর ক্যাডেট। তাই ডিউটি শেষে ২য় ইঞ্জিনিয়ার প্রতিদিন ডেক আফিসে ঢু মারে। একটু গল্প গুজব করে। এবং বিভিন্ন অফিসার , ইঞ্জিনিয়ারকে তুলাধুনা করে। কিন্তু আজকে সে শুধুই বসে আছে। কতক্ষণ ধরে সে বসে আছে বলা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে অনন্ত কাল ধরে সে এখানেই বসে আছে।

চীফ ইঞ্জিনিয়ারের মনটা কেন জানি খুব ছটফট করছে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে সে শীঘ্রই মারা যাবে। প্রেসার চেক করে দেখেছে ঠিক আছে। তার পরও মনটা খুব অস্থির। কি করবে বুঝতে পারছে না। তাই সে ব্রিজে গেল। ক্যাপ্টেন সাহেবকে ঘটনাটা জানাল। ক্যাপ্টেন কোন উত্তর দিচ্ছে না। সে একমনে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার পর হঠাৎ করেই একটা কথা শুনতে পেল

“চীফ আপনারা মরতে পারেন না” “Chief you can not die”
চীফ ইঞ্জিঃ কেন ?
“কারন, আপনারা সবাই এরি মধ্যে মারা গেছেন”। “Because all of you already death”
চীফ ইঞ্জিঃ কিন্তু কিভাবে !!
“আপনি ভুলে গেছেন। গত সপ্তাহে আমাদের জাহাজের সবাই বিস্ফোরনে মারা গেছে।“ “You have forgotten. Your ship explode and all crew died in that explosion last week”
চীফ ইঞ্জিঃ কিন্তু জাহাজ তো চলেছে ?
“কোথায় যাচ্ছেন, আপনি কি সেটা জানেন?” “You know where you are going?”
আসলেই তো সে জানে না জাহাজটা কোথায় যাচ্ছে। শুধু জানে জাহাজটা চলছে। সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল সবাই মৃত হলে জাহাজটা কিভাবে চলছে, কারা চালাচ্ছে।
“মৃত নাবিকরা জাহাজ চালাচ্ছে”। “ The dead sailors running the ship ”

PDF Logo_2PDF Version [Published at SMC Magazine “নোঙর” May 2014]

————————-

Khalid_29

লেখক পরিচিতিঃ খালিদ মাহমুদ (২৯) জাহাজে চাকরীর পাশাপাশি বিভিন্ন ব্লগে লেখালেখি করেন।

Share