মেরিন জীবনের পুরোটাই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য স্যাক্রিফাইস: আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ (47E)
আমার প্রথম জাহাজে বেশ কয়েকজন অসাধারণ অফিসার পেয়েছিলাম। যারা ব্যক্তিত্ব এবং পেশাগত দু’দিক থেকেই ছিলেন অনন্য। শুরুতে জাহাজের ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার স্যারের সাথে ডিউটি ছিল।
রাতের ৮-১২ টা ডিউটি শেষে প্রায়ই আমি আর স্যার গ্যালিতে নুডলস খেতে খেতে অনেক গল্প করতাম। প্রথম জাহাজে উঠে যখন দেখলাম অফিসারদের ইনিশিয়াল স্যালারি ১৫০০ ডলার (২০১৩ সালে, এখন আরও কম অনেক কোম্পানিতে) তখন খুব আনন্দিত হয়েছিলাম টাকার পরিমাণ দেখে।
২৫/২৬ বছর বয়সে মাসে লাখের উপর ইনকাম করা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যা তা ব্যাপার নয়। আমি কিন্তু তখনও মুদ্রার অন্যপিঠ দেখিনি বা বুঝিনি। স্যার একদিন আমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন।
স্যার বলেছিলেন, মেরিনারদের যে বেতন দেয়া হয় সেটা হচ্ছে আমাদের সময়ের বিনিময়ে। এই যে তুমি তোমার পরিবার – প্রিয়জন ফেলে বিচ্ছিন্ন হয়ে জাহাজে আছো সেটার জন্যই এ টাকা। আর সাথে শারীরিক পরিশ্রম আর মানসিক চাপ তো আছেই। আপাতদৃষ্টিতে মেরিনারদের বেতন অনেক মনে হলেও, আসলে তোমার দেয়া সময় আর স্যাক্রিফাইসের বিনিময়ে এটা খুবই নগন্য।
আবার দেখ, দেশে ল্যান্ডে যারা জব করে অফিস-আদালত কিংবা স্কুল-কলেজে তাদের কিন্তু ৮-৫ টা ডিউটি। ডিউটির শেষে তাদের বেশিরভাগকেই আর কোন মানসিক চাপ নিতে হয়না অফিস-আদালত বা কর্মস্থল নিয়ে। বাড়িতে যাবার পর ম্যাক্সিমাম মানুষই পুরোপুরি নিশ্চিত মনে থাকতে পারে।
কিন্তু আমাদের ডিউটি বলতে গেলে ২৪ ঘন্টাই। রেস্ট আউয়ারেও যখন তখন ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন আসতে পারে। প্রকৃত অর্থে জাহাজে থাকা ৬/৯ মাসের পুরোটা সময়ই তুমি ডিউটি দিচ্ছ। সে হিসেবে ল্যান্ডে দৈনিক ৮ ঘন্টা ডিউটি করে তারা যা আয় করে মেরিনাররা ২৪ ঘন্টা কাজ করেও কিন্তু তার ন্যায্য পাওনার এক তৃতীয়াংশও পায়না।
আমাদের সবারই “ওপারে তে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস” বলে মনে হয়। অর্থাৎ সবাই ভাবে তার চেয়ে অন্যরা সুখে আছে, আরামে আছে। আমি ভাবি যদি সবসময় পরিবারের সাথে থাকতে পারতাম, অন্তত দিনশেষে চোখের দেখা হলেও তো হতো।
আবার দেশে বসে অফিস করা লোকজন ভাবছে, কী এডভ্যাঞ্চারাস লাইফ মেরিনারদের! দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ডলারে ইনকাম করছে! আর কি লাগে জীবনে!
আপনাকে যদি বলা হয় যে, আপনার সন্তান জন্মের ৩ মাস আগে থেকে জন্মের ৬ মাস পরেও সন্তানের কাছে আসতে পারবেন না, কোলে নিতে পারবেন না-আপনি কত টাকা নিবেন এর বিনিময়ে?
আবার আপনার বাবা-মা কেউ মারা গেল, তাদের শেষবার না দেখার বিনিময় কত হতে পারে বলতে পারেন? আরও জীবনের অন্যান্য যত উৎসব-উপলক্ষ্য আছে ধরেন আপনার নিজের বা স্ত্রী বা সন্তানের জন্মদিন, আপনার বিবাহবার্ষিকী, ইদ, পূজা, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি বিশেষ দিনগুলোর বিনিময় কত টাকা চাইবেন আপনি?
উল্লেখিত কোন কিছুই কিন্তু আপনি কোন বিনিময়েই ছাড় দিতে রাজী হবেন না। অথচ মেরিনারদের সারাটা জীবনই এসব ত্যাগ করতে হয়। কিসের বিনিময়ে? সামান্য ডলারের বিনিময়ে!
আপনার কী মনে হয় সেটা লক্ষ ডলার দিয়েও পুরোপুরি পরিশোধ করা সম্ভব? কোনভাবেই কী এসবের কোন আর্থিক বিনিময় হতে পারে? পারেনা। তাহলে কেন মেরিনার হলাম, যাযাবর জাহাজী হলাম সব ছেড়ে?
আমার দেখা মেরিন প্রফেশনে যারা আসে তাদের বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পরিবারকে একটু স্বচ্ছলতা আর আরামদায়ক ভবিষ্যৎ দিতেই বেশিরভাগ মেরিনার এ যাযাবর জীবনকে বেছে নেয়।
এদের মধ্যে অনেকেই আগে আগে পালিয়ে বাঁচতে পারে সমুদ্রের নোনাজল থেকে। আর বেশিরভাগ জাহাজী “এবারই শেষ ভয়েজ” “এটাই শেষ জাহাজ” বলেও জীবনের সব সুন্দর সোনালী সময় উত্তাল সমুদ্রের বুকেই জলাঞ্জলী দেয় পরিবারের জন্য, পরবর্তী প্রজন্মকে আরেকটু ভালো রাখার জন্য।
জাহাজীদের সাথে প্রবাসীদের অনেক বেশি মিল আছে। অনেক ক্ষেত্রে আমি মনে করি, প্রবাসীর চেয়ে মেরিনার হওয়াটা বেশি সৌভাগ্যের! কেননা মেরিনাররা ৬/৯ মাস পর পর দেশে আসতে পারলেও প্রবাসীদের ৩/৪ বছরের আগে দেশে আসার সুযোগ মিলেনা।
আমাদের দেশের অনেকেই মেরিনার হতে বা বিদেশে যাবার ব্যাপারে অতি আগ্রহী। কিন্তু আমার মনে হয় মেরিনার বা প্রবাসী হয়ে বিরিয়ানি খাওয়ার চেয়ে দেশে পরিবারের সাথে থেকে এক টুকরো লেবু দিয়ে ডাল-ভাত খাওয়া বেশি সুখকর।
দিনশেষে পরিবারের চেয়ে আপন আর শান্তির কিছু নেই। আর পরিবারকে দেয়া আপনার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হচ্ছে “সময়”! তাই পরিবারকে সময় দিন। সর্বদা তাদের সান্নিধ্যে থাকতে চেষ্টা করুন।
আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ
এক্স – ক্যাডেট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি।
(৪৭ তম ব্যাচ)
Recent Comments