জাহাজির ডায়েরি: আয়, আরেকটিবার আয়রে সখা… – আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ (৪৭তম ব্যাচ)
একাডেমিতে আমি সবচেয়ে ছোট ডর্মে থাকতাম যার সদস্যসংখ্যা ছিল মাত্র ছয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সেই ২০১২ সালে পাসিং আউটের পর এই ৯ বছরে আমরা ছয় জন ডর্মমেট এখনও একত্র হতে পারিনি। চার বা তিনজন একসঙ্গে বসতে পেরেছি বেশ কয়েকবার কিন্তু ছয়জনের একসঙ্গে বসার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।
জাহাজিদের একটা বড় অপ্রাপ্তি হলো কাছের মানুষের সঙ্গে সম্মিলিত হতে না পারা, সামনাসামনি দেখা করার সুযোগ না পাওয়া। একবার জাহাজি জীবন শুরু করলে নিজেদের গেট-টুগেদারের সুযোগ থাকে না বললেই চলে।
একাডেমিতে আমি সবচেয়ে ছোট ডর্মে থাকতাম যার সদস্যসংখ্যা ছিল মাত্র ছয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সেই ২০১২ সালে পাসিং আউটের পর এই ৯ বছরে আমরা ছয়জন ডর্মমেট এখনও একত্র হতে পারিনি। চার বা তিনজন একসঙ্গে বসতে পেরেছি বেশ কয়েকবার কিন্তু ছয়জনের একসঙ্গে বসার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।
অথচ প্রায় দুই বছর ঘুম থেকে ওঠা থেকে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত ওদের সঙ্গেই ২৪ ঘণ্টা কাটিয়েছি। নাশতা, লাঞ্চ, ডিনার থেকে শুরু করে একসঙ্গে কত পিটি, প্যারেড, ফ্রন্ট রোল, সাইড রোল দিয়ে ঘাম ঝরিয়েছি! আজ আমি জাহাজে তো আরেকজন ডাঙায়, আমি চিটাগাং তো আরেকজন ঢাকায়, আমি এশিয়ায় তো আরেকজন আফ্রিকার কেনিয়ায়! এই দেশ-বিদেশের দুষ্টচক্র থেকে জাহাজিদের রেহাইও মেলে না, দেখাও হয় না।
উপরের ছবিটি ২০১২ সালে একাডেমি থেকে কক্সবাজার এক্সকারশনে গিয়ে তোলা। আমি নিশ্চিত এই ছবির এক-তৃতীয়াংশ ব্যাচমেটকে আর একত্র করা সম্ভব হবে না। অন্তত আগামী ১৫ বছরে তো না-ই। ফেসবুক আর ফেসবুক গ্রুপের কল্যাণে মোটামুটি সবার আপডেট পাওয়া যায় এটাই সান্ত্বনা। অন্য কোনো প্রফেশনের ব্যাপারে ঠিক কতটা জানি না, তবে মেরিনারদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রিয় ব্যাচমেট, জুনিয়র, সিনিয়রদের অবস্থা-অবস্থান জানতে ফেসবুকের মতো যোগাযোগমাধ্যমের বিকল্প নেই আমাদের যাযাবর জাহাজিদের জীবনে।
আমি মাঝে মাঝে ৩০-৪০ বছর আগের মেরিনারদের কথা ভেবে শিউরে উঠি। কীভাবে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কোনো ধরনের যোগাযোগ ছাড়া তারা জাহাজে কাটিয়েছেন। পোর্টে এলে এজেন্ট দিয়ে দেশে চিঠি পাঠানোর নাকি সুযোগ ছিল তখন। এমনও শুনেছি যে, অনেকে জাহাজ থেকে পাঠানো চিঠি নিজে দেশে আসার পর রিসিভ করেছেন! আল্লাহর বিশেষ রহমত যে, এখন যোগাযোগ করা অনেক সহজ, দুনিয়া অনেক ছোট। আগের মতো জাহাজে জয়েন করলে একেবারে বিচ্ছিন্ন হতে হয় না।
এই ছবিতে আমাকে খুঁজে পেলাম না। ছবির একদম ডান দিকে মিরাজ, মাসুদ, নাজমুল আর বামে মুনতাসির, নকীব, শাওন। ছবিতে সবাই এত কাছাকাছি অথচ আজ একে অন্যের থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। কে জানে এই ছবিতে না থাকারাই আমাদের ছেড়ে যাওয়া প্রথম ব্যাচমেট সজীবের পরপারের প্লাটুনে আগে যোগ দেবে কি না!
সম্প্রতি সজীবের একাকিত্ব ঘুচাতে ওয়াহিদ ওর সঙ্গে যোগ দিয়েছে, কাকতালীয়ভাবে ওয়াহিদ এই ছবিতে নেই! সজীব প্লাটুনের ইনচার্জ হওয়ায় ওর একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে আমাদের মধ্যে ও সবচেয়ে তরুণ চেহারার থাকবে। আমরা ওকে একবার দেখে চিনতে পারলেও সজীব হয়তো আমাদের কারও কারও দাঁত ছাড়া, কুঁচকানো চামড়ার ভঙ্গুর চেহারা দেখে চিনতে পারবে না। সেখানে নতুন করে একে অন্যকে সজীবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। আরে ওর কথা মনে নেই তোর? আমাদের ব্যাচের বেস্ট অ্যাথলেট মাসুদ! এ তো আমাদের ব্যাচের একমাত্র বডি বিল্ডার ইমতিয়াজ! ওকে চিনতে পারছিস না? ফোর টপের সদাহাস্যোজ্জ্বল ক্যাডেট ক্যাপ্টেন ইসতিয়াক…
ওপারের প্লাটুনে গিয়ে দেখা হবার আগে আরেকবার এসব আত্মার আত্মীয়দের সান্নিধ্যে আসার খুব ইচ্ছা। সবাই একত্র হয়ে আবারও গাইব সে গান যা শুনতে শুনতে বিদায় নিয়েছিলাম একাডেমি থেকে…
‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা; সে কি ভোলা যায়?
আয়, আরেকটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়
মোরা সুখের-দু:খের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়…’
প্রকাশিত:আয়, আরেকটিবার আয়রে সখা… (newsbangla24.com)
লেখক: এক্স-ক্যাডেট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি (৪৭তম ব্যাচ)
Recent Comments