জাহাজির ডায়েরি-৫: মেরিনারের সামনে দেশের ব্র্যান্ডিংয়ের চ্যালেঞ্জ –  আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ (৪৭তম ব্যাচ)

জাহাজির ডায়েরি-৫: মেরিনারের সামনে দেশের ব্র্যান্ডিংয়ের চ্যালেঞ্জ – আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ (৪৭তম ব্যাচ)

যদিও একজন ব্যক্তিকে দিয়ে সামগ্রিকভাবে কোনো দেশ বা জাতিকে যাচাই করা যায় না, কিন্তু সামান্য হলেও একজনের কার্যকলাপের ওপর ভিত্তি করে জাহাজের ক্রুরা বাকিদের যাচাই করার চেষ্টা করেন

মেরিনারদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য থাকে নিজের দেশ, নিজের দেশের মানুষ সম্পর্কে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন মানুষের মাঝে একটি ভালো ধারণা তৈরি করা। এটি একটি চ্যালেঞ্জ, একটি বড় দায়িত্ব এবং একইসঙ্গে দেশ ও দেশের বাকি মেরিনারদের জন্য কিছু একটা করার সুযোগ।

যখন আমি জাহাজের ২১ জন ফিলিপিনো, ইন্ডিয়ান, রাশিয়ান, কোরিয়ান বা টার্কিশ ক্রুদের মাঝে একা বাংলাদেশি তখন আমার আচরণ, ম্যানার, কার্টেসি অনুযায়ী বাংলাদেশ আর বাংলাদেশিদের ব্যাপারে বাকিরা একটা ধারণা পান।

আমি কীভাবে চলি, কীভাবে খাই, কীভাবে কথা বলি, কীভাবে কাজ করি সবকিছুই সবাই লক্ষ্য করেন এবং আমার ভিত্তিতেই বাকি বাংলাদেশিদের বিচার করেন। তার মানে, আমার একার ওপর পুরো বাংলাদেশ আর বাংলাদেশিদের ইমেজ নির্ভর করছে, অন্তত ছবির এই ২১ জনের কাছে।

যদিও একজন ব্যক্তিকে দিয়ে সামগ্রিকভাবে কোনো দেশ বা জাতিকে যাচাই করা যায় না, কিন্তু সামান্য হলেও একজনের কার্যকলাপের ওপর ভিত্তি করে জাহাজের ক্রুরা বাকিদের যাচাই করার চেষ্টা করেন।

ধরুন, আমি যদি অভদ্র বা রগচটা আচরণ করি তাহলে বাকিরা হয়ত ভেবে নেবেন বাংলাদেশি মানেই অভদ্র আর রগচটা। একইভাবে আমি আন্তরিক আর ভদ্র হলে সবাই সে ধারণাই পাবে আমাদের সম্পর্কে। কয়েক লিটার দুধ নষ্ট করতে যেমন এক ফোঁটা লেবুর রসই যথেষ্ট তেমনি একজন ব্যক্তিই যথেষ্ট পুরো দেশ এবং জাতির নাম ডোবানোর জন্য।

বোঝানোর সুবিধার্থে দুটি বাস্তব উদাহরণ দেই। এই কয়েক বছর আগে একজন মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি মালয়েশিয়ান এক মেয়েকে ছুরি মেরে খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন। ওই ঘটনার পর মালয়েশিয়ার সাধারণ জনগণ শুধু সেই একজনের জন্য মালয়েশিয়াতে থাকা সমস্ত বাংলাদেশিকে বের করে দেয়ার জোর দাবি করেছিল!

মাত্র একজনের জন্য মালয়েশিয়ার পুরো বাংলাদেশি কমিউনিটি কতটা লজ্জিত আর অপদস্ত হয়েছে সেটা সহজেই অনুমেয়। অপরদিকে, সিঙ্গাপুরে লাখ ডলার কুড়িয়ে পেয়ে পুলিশকে ফেরত দিয়ে সততার অনন্য নজীর স্থাপনকারী একজন মাত্র বাংলাদেশিই কিন্তু আমাদের সমস্ত বাংলাদেশ-বাংলাদেশিদের গর্বিত করে।

মেরিনারদের নিয়েও এ রকম দুটি ঘটনা বলি। প্রায় এক যুগ আগে বিদেশি কোম্পানির জাহাজে এক বাংলাদেশি তার সিনিয়র অফিসারকে মারার জন্য তাড়া করেছিল বলে রিপোর্ট করা হয়! ফলে সেই কোম্পানি চিরতরে বাংলাদেশিদের নেয়া বন্ধ করে দেয়।

একইভাবে জাহাজে করে তথাকথিত উন্নত দেশে পালিয়ে গিয়ে বাকি হাজার হাজার জাহাজির ভালো কোম্পানিতে চাকরির সুযোগ বন্ধ করার জন্য মাত্র একজন বাংলাদেশি জাহাজিই যথেষ্ট।

অপরদিকে, কয়েক বছর আগে চায়নার একটা বড় শিপিং কোম্পানি একজন বাংলাদেশি ক্যাপ্টেনের দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে আরও বাংলাদেশি জুনিয়র অফিসার নিতে আগ্রহী হয়েছে, নিয়োগ দিয়েছে। মাত্র একজন বাংলাদেশি ক্যাপ্টেনের চমৎকার আচরণ আর দক্ষতার জন্য আরও ১০ জন বেকার জুনিয়রের চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। অর্থাৎ আমার-আপনার মতো মাত্র একজন নগণ্য জাহাজি বাকি জাহাজিদের পথ যেমন সুগম করতে পারেন, তেমনি দুর্গমও করতে পারেন।

দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশি মেরিনাররা বছরে মিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েও সরকারিভাবে তেমন কোনো বাড়তি বা বিশেষ সুবিধা পান না। নিজেদের দেশে আমরা মূল্যহীন, শিকড়হীন। অথচ দেশের বাইরে বা ভিনদেশিদের সামনে দেশের জন্য, দেশের বাকি জাহাজিদের জন্য ‘একজন আমি’ অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

জাহাজে এসে যখন বিদেশিদের কাছে একজন বাংলাদেশি সম্পর্কে কোনো ভালো কথা বা তার ভালো অভিজ্ঞতার কথা শুনি তখন স্বাভাবিকভাবেই সেই অচেনা, অজানা বাংলাদেশির প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে ওঠে, শ্রদ্ধা জন্মে।

আবার এর বিপরীতে বাংলাদেশিদের নিয়ে কেউ খারাপ অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেও লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে, অস্বস্তি লাগে। আমাদের মনে রাখা উচিত, জাহাজে একজন জাহাজির মাত্র ৬/৯ মাসে তৈরি করা ইমেজ কিন্তু শুধু ৬/৯ মাস, আর এই ২০-২৫ জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং সেই ইমেজ ২০-২৫ জনের মাধ্যমে প্রচারিত হতে থাকে হয়ত অন্য কোনো বাংলাদেশি জাহাজি বা তাদের স্বজাতির কারো কাছে।

তাই আমাদের প্রত্যেকের অবস্থান থেকে প্রত্যেকের এমন একটা ইমেজ তৈরি করা উচিত যেন পরবর্তীতে কোনো বাংলাদেশি জাহাজি কোনো ভিনদেশির কাছে আমার-আপনার গল্প শুনে গর্বিত হন, লজ্জিত বা নীচু না হন। এই কথাগুলো প্রবাসী সমস্ত বাংলাদেশিদের জন্যও সমান প্রযোজ্য।

প্রকাশিত: মেরিনারের সামনে দেশের ব্র্যান্ডিংয়ের চ্যালেঞ্জ (newsbangla24.com)


লেখক: এক্স ক্যাডেট (বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি ৪৭তম ব্যাচ)

Share