মে দিবস এবং জুমাবারে বিশ্বজুড়ে নাবিকদের স্বীকৃতি ও স্মরণের ডাক: ড. রেজাউল করিম চৌধুরী ও কাজী মো. আবু সাইদ
ড. রেজাউল করিম চৌধুরী: মেরিটাইম পরামর্শদাতা, আইনজীবি, বর্তমানে ইউনির্ভাসিটি অব মালয়েশিয়া, তেরেঙ্গানুতে গবেষণায়রত।
কাজী মো. আবু সাইদ: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে ইউনির্ভাসিটি অব মালয়েশিয়া, তেরেঙ্গানুতে গবেষণায়রত।
এ বছরের মে দিবসের মধ্যাহ্নে, নীল সাগরে ভেসে চলা জাহাজগুলোর মাথার উপর দিয়ে দিনের সূর্যটা যখন স্থানীয় দ্রাঘিমা রেখাটি পার হবে, ঠিক সে সময়ে জাহাজগুলোকে হর্ন বাজিয়ে/শিঙ্গার ধ্বনিতে সম্মান জানাতে বলা হয়েছে বিশ্বের ষোল লক্ষ নীল জলের নাবিকদের।
এই আহ্বান যৌথভাবে জানানো হল আইটিএফ (আন্তর্জাতিক পরিবহন কর্মী ফেডারেশন) এবং আইসিএস (আন্তর্জাতিক শিপিং চেম্বার)-এর পক্ষ থেকে।
কভিড-১৯ এর মহামারীতে বৈশ্বিক অচলায়তনে জরুরি সরবরাহ সচল রাখতে দৃষ্টিসীমার বাইরে নাবিকদের নিরন্তর কর্মযজ্ঞের স্বীকৃতি প্রদানে এ মধ্য দিবসে শিঙ্গার নিনাদ।
এক বার্তায় আইসিএস সেক্রেটারি জেনারেল গাই প্ল্যাটেন বলেন, “আমাদের নাবিকেরা বিশ্ব বাণিজ্যেরর বিস্মৃত বীর, প্রতিদিন দেশে দেশে জরুরি সরবরাহ অব্যাহত রাখতে তাদের অবদান আমরা অস্বীকার করতে পারি না। বন্দরের জাহাজগুলোয় যখন শিঙ্গা ধ্বনি বাজবে তা হবে নাবিকদের আত্মত্যাগের কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার উত্তম উপায়। কারণ নাবিকেরাই সাগরের নায়ক।”
আইটিএফ সেক্রেটারি জেনারেল স্টিফেন কটন তারবার্তায় বলেন, আইটিএফ এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছে এবং নাবিকদের শিঙ্গায় নিনাদ তুলে বৈশ্বিক একাত্মতা প্রকাশের অনুরোধ করছে। কিন্তু গুরুত্বের সঙ্গে নিশ্চিত করা প্রয়োজন- নাবিকরা কতটা অপরিহার্য পৃথিবীজুড়ে জরুরি সরবারাহ সচল রাখতে এমন দুর্যোগপূর্ণ দিনে। সরকারের উচিত হবে নাবিকদের মুক্ত চলাচল, বাড়িফেরা এবং নতুন কর্মস্থলে যোগদেয়ার সহায়তা অবারিত করা যাতে সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখা সম্ভব হয় এমন অভূতপূর্ব সময়ে।
কভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় বিভিন্ন দেশে গৃহীত পদক্ষেপের ফলে নাবিকদের চলাচলে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করতে আইটিএফ এবং আইসিএস যৌথভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে সরকারগুলোর সঙ্গে।
এদিকে পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে বাংলাদেশী নাবিকরা নিজ নিজ ধর্মমতে দোয়া এবং স্মরণ করবে স্বদেশী নাবিকদের আত্মত্যাগ।
প্রবীণ নাবিক ক্যাপ্টেন এফআর চৌধুরীর আহ্বানে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ৮ মে বাদ জুমা দোয়ার মাধমে যেসব বাংলাদেশী নাবিক যারা দেশ ও বিশ্বমানবতার সেবা প্রদান করতে গিয়ে কর্মস্থলে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন বা মারা গেছেন অথবা অসুস্থ আছেন এবং বর্তমানে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে রয়েছেন তাদের স্মরণ করা হয়। সবার আত্মত্যাগ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে সবার জন্য নিজ নিজ অবস্থান থেকে দোয়া করার অনুরোধ জানিয়ে একটি সার্কুলার ইস্যু করা হয়েছে।
বিওএমএমএ দোয়া আয়োজনের পাশাপাশি ৬০টি অধিক হাসপাতালে পিপিই (পুনঃব্যবহারযোগ্য) সহ বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে, বন্দরে ও রাজধানীতে আটকে পড়া নাবিকদের সহায়তা দিচ্ছে এবং অনিশ্চয়তায় থাকা নাবিক পরিবারদের জন্য দেওয়া হচ্ছে কিছু সহায়তা।
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, “এই কঠিন সময়ে আমরা কিছু করতে চেয়েছি, এটা ছিল আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা।”
কভিড-১৯ মহামারীর দুঃসময়ে এই সব স্বীকৃতি এবং স্মরণ আশার আলো জ্বেলে রাখুক নীলজলের নায়কদের মনে।
কাকতালীয়ভাবে বলা চলে এ শিঙ্গার ধ্বনি মানব সভ্যতার ইতিহাসে সম্ভ্রান্ত এক অনুষঙ্গ। এর রয়েছে পৌরাণিক, ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য। শিঙ্গার ধ্বনির সঙ্গে রয়েছে ন্যায়বিচার এবং ক্ষমতার সম্পর্ক।
ইসলামে বলা হয়েছে ইস্রাফিলের শিঙ্গার ধ্বনিতে থেমে যাবে জগতের কোলাহল, আর শিঙ্গার ধ্বনির পর শেষ বিচারের দিনে মহান আল্লাাহ চূড়ান্ত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পূর্ণক্ষমতা এবং মালিকানার আদালত বসাবেন। পৃথিবীর কোলাহলে মজলুমের যে ফরিয়াদ তিনি শুনেছেন অথবা নিভৃতে মানুষ যেসব ভাল-মন্দ কাজ করেছে সবকিছুর প্রতিদান তিনি দিবেন।
কভিড-১৯ মহামারীর সময়ে কোলাহল থামা পৃথিবীতে শিঙ্গা ধ্বনিতে নাবিকদের স্বীকৃতি ও সম্মান জানানো যেন সভ্যতার ইতিহাসে লাখো নাবিকের গোপন বলিদানের এক প্রতীকী প্রতিদান।
পুরানেও রয়েছে রয়েছে গরুর শিঙের উপর সমগ্র পৃথিবীর অবস্থানের কথা, পবিত্র কোরান জানাচ্ছে জুলকারনাইন (দুই শিংওয়ালা) নামে এক মহান ন্যায়বিচারক বাদশাহর খবর যিনি পূর্ব-পশ্চিমে সূর্যের উদয় অস্তের দিকে ভ্রমণ করেছেন এবং উত্তরে ভ্রমণ করে ইয়াজুজ-মাজুজের পথে লোহা ও তামা দিয়ে দেয়াল নির্মাণ করেছিলেন। যার কথা উল্লেখ আছে বাইবেলের নিউ এবং ওল্ড টেস্টামেন্টে। ইতিহাসে সিরিয়া ও পারস্য সম্রাজ্যজয়ী বাদশাহ সাইরাস দি গ্রেট, তিনি কৃষ্ণ সাগরের কালো জলে সূর্যকে ডুবতে দেখেছেন আর সূর্যোদয় প্রত্যক্ষ করেছেন কাস্পিয়ানের নীল জল হতে।
রাজদরবারে রাজার আগমন ঘোষণায়, যুদ্ধ অভিযানে কিংবা কুচকাওয়াজে প্রধান অতিথিকে অভিবাদন জানাতেও শিঙ্গা ধ্বনির ব্যবহার হয়ে থাকে। কভিড-১৯ মহামারীরকালে সমগ্র বিশ্ব যখন থমকে গেছে, তখন দেশে দেশে খাদ্য-জ্বালানির নিরাপত্তা কিংবা প্রাণরক্ষাকারী ওষুধ ইত্যাদির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে নাবিকের নিরন্তর কর্মদ্যোগ ও আত্মত্যাগ প্রমাণ করে এই পেশার সক্ষমতা এবং সম্ভ্রান্ত হওয়া।
শুভহোক শিঙ্গা ধ্বনিতে এবং দোয়ার মাধ্যমে নীলজলের নাবিকদের স্মরণ ও স্বীকৃতি।
Recent Comments