করোনা সংকট: নাবিকদের জন্য চাই রাষ্ট্রীয় সমর্থন – ড. রেজাউল করিম চৌধুরী(25N), কাজী আবু সায়ীদ(44E)

করোনা সংকট: নাবিকদের জন্য চাই রাষ্ট্রীয় সমর্থন – ড. রেজাউল করিম চৌধুরী(25N), কাজী আবু সায়ীদ(44E)

বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে স্বাভাবিক জনজীবন ব্যাহত হয়েছে গোটা দুনিয়ায়। দেশে দেশে লকডাউন, চলাচলে বিধিনিষেধ, অফিস-আদালত ছুটি, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে এ ভাইরাসের বিস্তার রোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এমন পরিস্থিতিতেও স্বাস্থ্যকর্মী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মতো মেরিনাররাও জীবনবাজি রেখে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। বিশ্ব অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য করোনা অতিমারী উপেক্ষা করে নাবিকদের অনবরত কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে সারা পৃথিবীতে। মিসরের সুয়েজ খালে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা প্রমাণ করে দিয়েছে পৃথিবীকে বাঁচতে হলে এই সামুদ্রিক পরিবহন ব্যবস্থাকে বাঁচাতে হবে। আর এই সামুদ্রিক পরিবহন ব্যবস্থা যাদের মাধ্যমে টিকে আছে, তারাই মেরিন অফিসার ও ইঞ্জিনিয়ার।

এশিয়ার চীন থেকে ইউরোপের ইতালি, স্পেন কিংবা আটলান্টিকের ওপারে আমেরিকা মহাদেশ হোক, সর্বত্র অত্যাবশকীয় পণ্য (মেডিকেল পণ্য, খাবার এমনকি করোনাভাইরাসের টিকা তৈরির রসদও) বহন অব্যাহত রেখেছেন মেরিনাররা। বিশ্বে সরবরাহ ব্যবস্থার ৯০ শতাংশের বেশি পণ্য সমুদ্রগামী জাহাজের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়। একজন নাবিক সাধারণত চার থেকে নয় মাসের জন্য জাহাজে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত হন। মহামারীর এই প্রাদুর্ভাবের কারণে বৈশ্বিকভাবে চলাচলে ব্যাপক বিধিনিষেধ থাকলেও মেরিটাইম ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ দেশগুলো তাদের নাবিকদের জাহাজে যোগদান বা দেশে ফিরে আসার পথে কোনো বাধা রাখেনি, চাকরিরত সময়ের পুরো সময়টাই নাবিকরা সুমদ্রে অবস্থান করেন, অনেকটাই আইসোলেশনে থাকেন, কভিড অতিমারীতে বন্দরে অবস্থানকালীন জাহাজে বাইরের লোকজনের প্রবেশে রয়েছে কঠোর আনুশাসন। এছাড়া নাবিকদের জাহাজে যোগদানের পুরো বিষয়টি ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের জারীকৃত জাহাজ থেকে সাইন অন/অফ-সংক্রান্ত প্রটোকল মেনে করা হয় বিধায় সংক্রমণের শঙ্কা খুবই কম। চাকরির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরে নাবিকদের বন্দর থেকেই বিশেষ ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সরাসরি বিমানবন্দরে পাঠানো হয়।

আন্তর্জাতিক শিপিং সেক্টরে বাংলাদেশী নাবিকরা অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে চাকরি করে আসছেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে আমদানি-রফতানির উদ্দেশ্যে মেডিকেলসামগ্রী, খাবার, পোশাক পণ্য, জ্বালানি ও ভোজ্যতেলসহ যাবতীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ অক্ষুণ্ন রেখে মানবসভ্যতার কল্যাণে অবদান রেখে চলেছেন, যা এই করোনাকালীনও থেমে নেই।

তবে ইদানীং বিশ্বজুড়ে লকডাউন আর আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ থাকার কারণে জাহাজে কর্মরত নাবিকের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া সত্ত্ব্বেও তারা জাহাজ ত্যাগ করতে পারছেন না এবং নতুন করে কেউ জাহাজে যোগদানও করতে পারছেন না। ফলে কিছু নাবিক যেমন জাহাজে আটকে আছেন, তেমনি সমানসংখ্যক নাবিক দীর্ঘদিন ধরে দেশে আছেন চাকরিহীনভাবে। ফলে সার্বিক বিষয়টা মানবিক সংকটের আকার ধারণ করেছে, যা এ খাতের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশেষ করে বিভিন্ন বন্দরে আটকে পড়া নাবিকরা এবং ফ্লাইট বন্ধ থাকার কারণে যেসব নাবিক চাকরির মেয়াদ পার হয়ে যাওয়ার পরেও সমুদ্রে আটকে আছেন, তাদের জন্য বিষয়টি একটি মানবিক বিপর্যয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ সংকট উত্তরণে জাতিসংঘ মহাসচিবের আহ্বানে এরই মধ্যে বাংলাদেশসহ ৪৬-৫২টি দেশের নাবিকদের ‘কি ওয়ার্কার’ বা অত্যাবশকীয় কর্মী ঘোষণা করা হয়েছে। নাবিকদের অত্যাবশ্যকীয় কর্মী ঘোষণা করাার উদ্দেশ্য ছিল তাদের জাহাজে যোগদান এবং প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে যাবতীয় বিধিনিষেধ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা। যেহেতু করোনা পরিস্থিতির জন্য মেরিনাররা যোগদান বা প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে সরাসরি বিমানবন্দর থেকে নৌবন্দরে বা নৌবন্দর থেকে বিমানবন্দরে যাতায়াত করেন এবং বাণিজ্যিক জাহাজগুলো সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন থাকে।

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ রাখার কারণে অনেক মেরিনার জাহাজে যোগদান করতে পারছেন না। ফলে বিদেশী জাহাজের মালিকরা ভারতীয় বা ফিলিপাইনের মেরিনার নিয়োগে মনোনিবেশ করছেন। আরো কিছুদিন এভাবে চললে বাংলাদেশী মেরিনারদের আন্তর্জাতিক শিপিং মার্কেটের চাকরির ক্ষেত্র কমে যাবে। বাংলাদেশ হারাবে বছরে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটা বড় খাত। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে বাংলাদেশী মেরিন অফিসাররা সারা বিশ্বের বিভিন্ন সমুদ্রবন্দরে পরিবার-পরিজনদের ছেড়ে তারা মাসের পর মাস কাজ করেন নীরবে নিভৃতে। দেশের জন্য বছরে রেমিট্যান্সে তাদের অবদান ৪০০ মিলিয়ন ডলারেরও অধিক। অথচ আজকে সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন থেকে সর্বত্র যোগাযোগ করেও এখন পর্যন্ত নাবিকদের শর্তহীনভাবে জাহাজে যোগদান এবং ফেরত আসার ব্যাপারে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। মেরিটাইম ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ দেশগুলো নাবিকবান্ধব বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এই করোনাভাইরাসের সময়কে কাজে লাগিয়ে ফিলিপাইন সরকার বিশ্বের জাহাজ মালিকদের ফিলিপিনো নাবিক নিতে আকৃষ্ট করতে নাবিকদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকার ব্যবস্থা করেছে। আমাদেরও তাই করতে হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশী জাহাজ মালিকদের কাছ থেকে আমাদের অফিসার, নাবিকদের ভ্যাকসিনেশন সনদের ব্যাপারে বারবার প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে খুব দ্রুত বাংলাদেশী সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিকরা টিকা না নিলে আমাদের নাবিকদের চাকরির বাজার রক্ষা করা কঠিন হবে। বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এই সোনালি খাতকে বাঁচাতে হলে মেরিন অফিসার বা নাবিকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কভিড-১৯ টিকা প্রদান করা এবং স্বাভাবিক ফ্লাইটের মাধ্যমে জাহাজে যোগদান ও প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করার কোনো বিকল্প নেই। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে অনেক বড় বিপর্যয় আসতে পারে মেরিনারদের চাকরির বাজারে। এ অবস্থায় আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের সার্কুলার অনুযায়ী আমাদের বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৫২টি দেশের নাবিকদের জরুরি সেবা কাজে নিয়োজিত বিধায় ‘কি ওয়ার্কার’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ বহরের (সরকারি-বেসরকারি) প্রায় ৬৩টি সমুদ্রগামী জাহাজসহ দেশী-বিদেশী জাহাজে নিয়োজিত প্রায় ১৬ হাজার বাংলাদেশী নাবিক (১১০০০ মেরিন অফিসার ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ও ৫০০০ মেরিন ক্রু)। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এসব নাবিকের সম্মিলিত জোগান বার্ষিক ৪০০ মিলিয়ন ডলার। চুক্তিবদ্ধ হয়ে দেশে ও বিদেশের বন্দরে যোগদান এবং চুক্তির মেয়াদান্তে দেশে পরিবারের কাছে ফিরে আসা একান্ত প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সার্বিক স্বার্থে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাংলাদেশের সমুদ্রচারীদের বিশেষত আকাশপথে চলাচল সহজতর করা আবশ্যক।

বাংলাদেশের মেরিনার্স কমিউনিটির সোনার ছেলেরা যখন স্বপ্ন দেখছে অচিরে প্রতি বছর অর্ধবিলিয়নের বেশি মার্কিন ডলার আয় করে সোনার বাংলাদেশ গড়ায় অবদান রাখবে, ঠিক তখন সরকারের নীতিনির্ধারণ এবং প্রশাসনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবহেলায় মেরিনারদের শ্রমবাজার অন্য দেশের কাছে হাতছাড়া হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। কাজেই কয়েকটি দেশের শ্রমবাজারে বাংলাদেশী কর্মীরা যেভাবে কাজের-চাকরির সুযোগ পায়, সেভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের জাহাজে সাইন ইন ও সাইন অফের ক্ষেত্রে যেন নাবিকরা বিশেষ সুবিধা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে। সব ধরনের রাষ্ট্রীয় সমর্থনে করোনাজনিত হতাশায় বিপর্যস্ত নাবিকরা আবার ঘুরে দাঁড়াবে— এটাই প্রত্যাশা।

প্রকাশিত: নাবিকদের জন্য চাই রাষ্ট্রীয় সমর্থন (bonikbarta.net)


ড. রেজাউল করিম চৌধুরী: মেরিটাইম পরামর্শদাতাআইনজীবী, বর্তমানে ইউনির্ভাসিটি অব মালয়েশিয়া তেরেঙ্গানুতে গবেষণারত

কাজী আবু সাইদ: মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে ইউনির্ভাসিটি অব মালয়েশিয়া, রেঙ্গানুতে গবেষণারত

Share