চলেন দোল খাই – রেফায়েত ইবনে আমিন (২০ই)

চলেন দোল খাই – রেফায়েত ইবনে আমিন (২০ই)

আমাদেরকে সাবধানে হাটাচলা করতে হতো রেলিং ধরে ধরে। সব জিনিসপত্র বেঁধেছেদে রাখতে হতো, জাহাজের ভাষায় বলে সিকিউর (secure) করা। চেয়ার-টেবিল, স্যুটকেস, কম্পিউটার, খাতা-কলম, গ্লাস-প্লেট-বোতল, টুথব্রাশ, ড্রাম, টুল্‌স্‌-যন্ত্রপাতি তাবৎ সবকিছুই। বিশ্বাস করুন, রোলিং-এর সময়ে কলমের ছোট্ট একটা ঢাকনা বা পেন্সিল যদি ড্রয়ারের এদিক থেকে ওদিকে গড়াতে থাকে, তাহলে তার চেয়ে বিরক্তিকর কিছুই নাই (ঘুমের মাঝে মশারীর ভিতরে মশার গুনগুনানির মত)।

সব মেরিনারকেই একটা কমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় – জাহাজে দুলুনী হয় না? সেখানে থাকেন কি করে? হ্যা, জাহাজে দুলুনী হয়, হবেই। আদিকাল থেকেই হয়ে আসছে, ভবিষ্যতেও হবে ইনশাআল্লাহ্‌। দুলুনী কমানোর জন্য এখনো পর্যন্ত কোনো ঔষধ বের হয় নাই যে, জাহাজকে খাইয়ে দিবো, আর তার দুলুনী থেমে যাবে। আমরা এমনও পেয়েছি যে, দিনের পর দিন জাহাজ চলছে, কোনো দুলুনীই হয়নাই। বড় মহাসাগরও অনেক সময়ে শান্ত পুকুরের মত থাকে। আহ্‌ কী আরাম! আবার এমনও হয় যে, সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিতে চায়।

প্রথমেই জানার চেষ্টা করি দুলুনী কেনো হয়। সমুদ্রে কয়েকটা ফ্যাক্টর কাজ করে – সামুদ্রিক-বাতাস, ঢেউ, স্রোত, পৃথিবীর-ঘূর্ণন, মাধ্যাকর্ষন-শক্তি ইত্যাদি। এছাড়াও, স্থলসীমার দূরত্ব, স্থানীয় ভূ-প্রকৃতি, জোয়ার-ভাটা আরো অনেক কিছুই আছে। ঢেউ আর স্রোতের মধ্যে পার্থক্য আছে। খুবই সহজ করে বলতে পারা যায় – সামুদ্রিক-বাতাস পানির সঙ্গে ঘর্ষনের ফলে ঢেউ তৈরী হয়। আর স্রোত তৈরী হয় পানির তাপমাত্রা ও লবনাক্ততার তারতম্যের কারনে – বিষুবরেখার গরমপানি আর দুই-মেরুর ঠান্ডাপানি, সেই সঙ্গে সমুদ্রের লবনাক্ততার বৈষম্য, ল্যান্ড-স্ট্রাকচার ইত্যাদি নানান কারনে। পৃথিবী যে ঘুরছে, তার প্রভাবও সমুদ্রের পানির উপর ভীষণভাবে পড়ে। তার উপরে আছে বাতাস – সেটা কখনো নির্মল মৃদুমন্দ হাওয়া; আবার কখনো এমনই ঝড়ো-বাতাস হবে যে, গ্যারান্টি দিতে পারবো, সেই সময়ে আপনি কোনো রেলিং না ধরে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে থাকলে, প্লেনের টিকিট ছাড়াই বেশ কিছুটা ফ্লাই করতে পারবেন। (অসুবিধা হলো – কোথায় ল্যান্ড করবেন তার হদিস কেউই বলতে পারবে না)।

এতকিছুর অবতারনা করলাম একারনে যে, সমুদ্রে জাহাজ চলার সময়ে এর উপরে চারিদিক থেকে নানান শক্তি কাজ করে। শুধুমাত্র বাতাসের কথাই চিন্তা করুন – প্রবল ঝড়ো-বাতাস ধাক্কা দিলে, জাহাজ তো নড়বেই বা কাৎ হবেই। জাহাজ তো শক্ত মাটির রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে নাই। আর একেকটা জাহাজ দশ-বারো তলা উঁচু – পানির তলাতেও থাকে প্রায় পাঁচ-ছয়তলা। সুতরাং বাতাস তার ঝাপটা মারার জন্য প্রচুর সারফেস-এরিয়া পায়। শুধুমাত্র বাতাসের কারনেই এরকম। এবারে যোগ দিন ঢেউ এবং স্রোতের ব্যাপারটা। ইউটিউবে দেখবেন – ঝড়ের কবলে পড়লে জাহাজের কি অবস্থা হয়। বড় বড় জাহাজই খোলামকুচির মত আছড়া-পাছড়ি করতে থাকে, আর ছোট জাহাজের কথা চিন্তাই করতে পারবেন না।

Type of Ship Motion

এবারে, দুলুনী কয়রকম সেটা বলি। খুবই কমন হলো রোলিং, যেটা সকলেই জানেন। জাহাজ একবার ডানে কাৎ হচ্ছে, তারপরেই আবারো বামে। ঘড়ির পেন্ডুলামের মতই। ঢেউ পাশ থেকে আঘাত করলে এরকম হবে। ঢেউ যদি সামনে বা পিছে থেকে আসে তখন হবে পিচিং (pitching)। আপনি একজায়গায় দাঁড়িয়ে, পা না নড়িয়ে যদি ডানে-বামে হেলেন-দুলেন সেইটা রোলিং। আর সামনে কুর্ণিশ করেন আর পিছে মুড়ে যান, তাহলে সেটা হবে পিচিং। আপনি কিন্তু এখনো পা নাড়াননাই। তাহলে এবারে কোমড় থেকে বডিটাকে মোচড় দিয়ে চক্রাকারে ঘুরালে, সেটাকে বলবো ইওয়িং (yawing)। পুরা চক্কর ঘুরতে হবে না – ডানেবামে দশ-পনের ডিগ্রী ঘুরলে যা হবে, তাতেই জাহাজের টাল্টু বের হয়ে যাবে। কিন্তু দুনিয়া এত সহজ নয়, (অথবা বলা চলে সমুদ্র এত সহজ নয়)। এতক্ষণ আপনি পা নড়ান নাই। এবারে আপনাকে সামনে-পিছে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারে, তাহলে সেটাকে বলবে সার্জিং (surging)। তারপরে বামে ডানেও ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারে, সেটা হলে বলবেন স্বোয়েয়িং(swaying)। আচ্ছা, ডানে-বামে সামনে-পিছ তো দুললেন, এবং হঠলেনও; কিন্তু উপরে তুলে নিয়ে আবার নীচে আছড়ে ফেলতে পারে, তখনো যদি আপনার সম্বিত কিছুটা থাকে তাহলে সেটাকে বলবেন হীভিং (heaving)। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো কর্কস্ক্রুয়িং (corkscrewing) – জাহাজ কিছুটা স্পাইরাল প্যাঁচের মত চক্কর খাবে। সত্যি বলছি, আপনি কখনোই চান না যে, আপনার জাহাজে কর্কস্ক্রুয়িং হোক। আসলে, আমরা কেউই চাইনা উপরের কোনোটাই হোক। কিন্তু সমুদ্র ও প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতেই আমরা নাবিক। এবং এগুলো কিন্তু একা একা হয় না, উন্মত্ত সমুদ্রে প্রায়ক্ষেত্রেই রোলিং-পিচিং-ইওয়িং-স্বোয়েয়িং-হীভিং সবগুলোই একসাথেই চলতে থাকে।

জাহাজের বডি তো লোহার। প্রচন্ড ঢেউয়ের আঘাতে জাহাজ কিছুটা বাঁকে আবার সোজা হয়। জাহাজের ডিজাইনই এরকম রাখা হয়, যাতে একটুখানি বাঁকা হয়, তা নাহলে খুবই স্টিফ স্টীলের হলে, ঢেউয়ের আঘাতে মট, করে ভেঙ্গে যাবে। তলার থেকে ঢেউয়ের আঘাতে, জাহাজের মাঝখান যখন উপরে বেঁকে যায়, আগা আর পাছা থাকে নীচে, তখন তাকে হগিং (hogging) বলে। আর উল্টাভাবে, মাঝখান নীচে নেমে গেলে স্যাগিং (sagging) বলে। সেজন্য দুলুনী ও ঢেউ শুরু হলে জাহাজ থেকে নানানরকম ক্যাঁচ-কোঁচ আওয়াজ বের হয়। খুব বেশী হগিং-স্যাগিং হলে, তাহলে কিন্তু আসলেই জাহাজে ফাটল ধরতে পারে।

জাহাজ দুললে, আমাদের কি হয় তখন? একটাই বলতে পারি – জাহাজ তখনও থেমে থাকেনা; এবং আমাদের কাজও থেমে থাকেনা। কাজ স্বাভাবিকভাবেই চলতেই থাকে। কেউ কেউ কিছুটা অস্বস্তিবোধ করে, কেউ হয়তো একটু বেশীই অসুস্থতা বোধ করে – মাথা ধরে থাকে, বমি-বমি ভাব হয় বা ক্রমাগত বমি হতেই থাকে। আবার অনেকেই আছে, যাদের কিছুই হয়না, তারা সহজ-স্বাভাবিক। আমি ডাক্তারী বুঝিনা, কিন্তু Motion sickness-এর সঙ্গে কানের ভিতরে ব্যালান্সের কিছুটা সম্পর্ক আছে। এছাড়া দেখতাম ছোট ছোট বাচ্চারা রোলিং-পিচিং-এর সময়ে বেশী ভুগতো না, তারা দিব্যি মজাতেই আছে। মহিলাদের কষ্ট একটু বেশী হয়, জাহাজে ভাবীরা বেশ কাহিল হয়ে পড়তেন।

আমাদেরকে সাবধানে হাটাচলা করতে হতো রেলিং ধরে ধরে। সব জিনিসপত্র বেঁধেছেদে রাখতে হতো, জাহাজের ভাষায় বলে সিকিউর (secure) করা। চেয়ার-টেবিল, স্যুটকেস, কম্পিউটার, খাতা-কলম, গ্লাস-প্লেট-বোতল, টুথব্রাশ, ড্রাম, টুল্‌স্‌-যন্ত্রপাতি তাবৎ সবকিছুই। বিশ্বাস করুন, রোলিং-এর সময়ে কলমের ছোট্ট একটা ঢাকনা বা পেন্সিল যদি ড্রয়ারের এদিক থেকে ওদিকে গড়াতে থাকে, তাহলে তার চেয়ে বিরক্তিকর কিছুই নাই (ঘুমের মাঝে মশারীর ভিতরে মশার গুনগুনানির মত)।

রোলিং হলে কি হবে, খাওয়াদাওয়া তো চলবে, কুক ঠিকই রান্না করছে। ডাল বা স্যুপ রান্না করা কষ্টের – পাতিলের মধ্যেই জোয়ার-ভাটা শুরু হয়ে যায়। খাবার-টেবিল যদি সুন্দর-মসৃণ থাকে, তাহলে রোলিং হলে, হঠাৎ দেখবেন আপনার প্লেট সাঁ করে গড়িয়ে অন্যের সামনে চলে গেছে; আর অন্য একজনেরটা আপনার সামনে। সেজন্য অনেক সময়ে টেবিলে কাপড় বিছিয়ে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেয়, Stiction-এর জন্যে।

কীভাবে দুলুনী কমাবেন? জাহাজের গায়ে, পানির অনেক নীচে, বিল্‌জ্‌ কীল (bilge keel) বলে একধরেনের লোহার লম্বা পাত দেওয়া থাকে, যেটা ঢেউ ভেংগে দিয়ে এন্টি-রোলিং-এ সাহায্য করে। মাল না থাকলে, খালি জাহাজে রোলিং বেশী হতে পারে। তাই জাহাজে অনেকগুলো ট্যাঙ্ক থাকে, যেগুলোতে সমুদ্র থেকে পানি ভরে ভরে জাহাজের ওজন বাড়ানো হয়, একটু স্ট্যাবল করার জন্য। এগুলোকে বলে ব্যালাস্ট-ট্যাঙ্ক। পরে মাল লোডিং-এর আগে সেই পানি ফেলে দিলেই হলো। আজকাল অবশ্য “ইধারকা পানি উধার” করার ব্যাপারে অনেক আইন-কানুন আছে। এছাড়া আছে এক্টিভ-ট্যাঙ্ক-সিস্টেম, যেখানে রোলিং-এর বিপরীতে পানি পাম্প করে দুই ট্যাঙ্কের ভারসাম্য রক্ষা করে জাহাজের রোলিং কমানো হয়। আরো দামী ও সফিস্টেকেটেড হলো রোল-স্ট্যাবিলাইজিং ফিন। জাহাজের দু’পাশে, পানির তলায়, প্লেনের ডানার মত থাকে। ঢেউয়ের অবস্থান ও গতি বুঝে, সেগুলোর এঙ্গেল ঠিক করে ঢেউ ভেঙ্গে দিয়ে রোলিং কমানোর চেষ্টা করা হয়। সম্পূর্ণ রোলিং বন্ধ করা যায় না, কিন্তু কিছুটা হলেও কমে। ক্রুজ-শীপে এগুলো থাকে।
আপনাদের বলতে পারি, পার্কে দোলনায় দোল খেতে যেতে পারেন, বা রোলার-কোস্টার চড়তে পারেন। কিন্তু কোনো মেরিনারের কাছে জাহাজে দোল খেতে যাওয়ার আবদার করেন না। সে এক ভয়ানক ব্যাপার।

আমার একটা অনুরোধ – কারো যদি কোনো বিষয়ে কোনো কৌতুহল থাকে, তাহলে আমাকে refayet@yahoo.com ই-মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।

চলেন দোল খাই – দৈনিক আজাদী (dainikazadi.net)


রেফায়েত ইবনে আমিন (২০ই), টলিডো, ওহাইও, ২০২২
refayet@yahoo.com

Share