দেশি কোম্পানিতে জুনিয়র মেরিন অফিসার, ক্যাডেটদের কষ্টগাথা: আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ (৪৭তম ব্যাচ)
ব্যবসায় শিক্ষার মূলনীতি থেকে আমরা জানি ‘জোগান বাড়লে চাহিদা কমে আর জোগান কমলে চাহিদা বাড়ে।’ দুর্ভাগ্যক্রমে গত সাত-আট বছরে মেরিন ক্যাডেটদের জোগান চাহিদার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। ফলে মার্কেটে ক্যাডেটদের চাহিদা কমে গেছে, কমেছে মূল্যায়নও।
প্রায় প্রতিটি পেশাতেই ন্যূনতম বেতন স্কেল নির্দিষ্ট করা আছে। এমনকি লোকাল বাসেও দেখা যায় ‘সর্বনিম্ন ভাড়া’র উল্লেখ দেখা যায়। রিকশায় করে এক মিনিটের হাঁটা দূরত্বে গেলেও ১০ টাকার নিচে দেয়া যায় না। অন্যভাবে বলা যায়, রিকশার সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সবার ধারণা করা ‘রয়েল প্রফেশন’ মেরিন ইঞ্জিনিয়ার/অফিসারদের কোনো সর্বনিম্ন বেতন কাঠামো নেই!
প্রতিবার জাহাজে যোগ দেয়ার আগে অনেকটা মাছের বাজারের মতো দরাদরি করে, হার-জিতের লড়াই শেষে একটি সমঝোতায় আসতে হয় ।
ব্যবসায় শিক্ষার মূলনীতি থেকে আমরা জানি ‘জোগান বাড়লে চাহিদা কমে আর জোগান কমলে চাহিদা বাড়ে’। দুর্ভাগ্যক্রমে গত সাত-আট বছরে মেরিন ক্যাডেটদের জোগান চাহিদার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। ফলে মার্কেটে ক্যাডেটদের চাহিদা কমে গেছে, কমেছে মূল্যায়নও।
২০১৩ সালে যেখানে আমি ২০০ ডলার পেয়েছি ক্যাডেট হিসেবে, এর কয়েক বছর পরেই তা ১০০ থেকে ৫০, এমনকি শূন্যতে নেমে আসার রেকর্ডও আছে। স্কুল-কলেজে সেরা ফলাফল করে, নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে একটা ছেলে-মেয়ে মেরিন ক্যাডেট হিসেবে চান্স পান। এরপর কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় দুই বছরের ট্রেনিং শেষে তারা সমুদ্রে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। অথচ এমন কোয়ালিফাইড একজনের মাসের পর মাস গাধার মতো খাটুনির মূল্য মাত্র ‘বেঁচে থাকার খাবারটুকু’!
এই ১০০ থেকে ৫০ ডলার বা বিনামূল্যে পরিশ্রম করা ক্যাডেটদের নির্দিষ্ট সময়ের সি-সার্ভিস শেষে অফিসার হওয়ার পরীক্ষা দিতে হয়। বিভিন্ন কোর্স, পড়াশোনা, রিটেন, ভাইবা শেষ করে অফিসার হওয়ার সার্টিফিকেট পেতে বছরখানেক সময় লাগে, যে সময়টাতে তাদের উপার্জনের কোনো উপায় থাকে না। কোর্স, পরীক্ষার ফি, এক বছর দেশে থাকা-খাওয়ার খরচ ধরে ন্যূনতম আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার একটা ধাক্কা সমস্ত সি-টাইম শেষ করা ক্যাডেটদের সামলাতে হয়। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, ৯৫% ক্যাডেট তাদের ক্যাডেটশিপে পাওয়া টাকা দিয়ে জুনিয়র অফিসার হওয়ার পরীক্ষা কমপ্লিট করতে পারেন না।
আর যারা নিরুপায় হয়ে বিনা বেতনের ‘কাবিখা’ প্রকল্পের গিনিপিগ হয়েছিলেন তাদের কথা চিন্তাই করতে পারি না। নিজেকে তাদের অবস্থায় ভাবতেই মাথা গুলিয়ে যায়। একটানা ১২ মাস মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করার বিনিময়ে তাদের একটা পয়সাও জোটেনি!
চাকরি পেয়ে প্রথম মাসের টাকা নিয়ে আমাদের কতজনের কত স্বপ্ন থাকে, ইচ্ছা থাকে। অথচ তাদের এমন কোনো স্বপ্ন দেখার, ইচ্ছা পোষণ করার ক্ষমতাই কেড়ে নেয়া হয়। কতটা অসহায় হলে দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের একজন ক্যাডেট এমন চুক্তিতে রাজি হতে পারেন তা অবশ্যই ভাবার বিষয়!
আগে যা বলছিলাম, ভাগ্যবান পাঁচ ভাগ বাদে প্রত্যেক ক্যাডেটকে জুনিয়র অফিসার হওয়ার পরীক্ষা দেয়ার সময় ঋণের বোঝায় জর্জরিত হতে হয়। এরা ঋণ করেন যাদের কাছ থেকে তারা আবার আরেক কপাল-পোড়া। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সি-টাইম শেষ করা এসব ক্যাডেটদের ঋণদাতা হন জাহাজের জুনিয়র অফিসাররা (থার্ড/ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার বা থার্ড/সেকেন্ড অফিসার)!
জুনিয়র অফিসারদের ‘কপাল-পোড়া’ বলার কারণ, বর্তমানে বেশিরভাগ দেশি কোম্পানির জাহাজে তাদের র্যাংকের বেতন অনেক ক্ষেত্রে রেটিংদের চেয়েও কম! ক্যাডেটের জোগান বেশি থাকায় জুনিয়র অফিসার র্যাংকেও জোগান বেড়ে গেছে। ফলে জুনিয়র অফিসারদের মূল্য কমে এখন রেটিংদেরও নীচে।
জোগান-চাহিদার সুযোগটা ব্যবসায়ীরা খুব ভালোভাবেই নিচ্ছেন। ২০১১-১২ সালে যেখানে জুনিয়র অফিসারদের বেতন ছিল ৩০০০ ডলারের উপরে, সেখানে ২০১৩-১৪ সালের পর এক ধাক্কায় জুনিয়র অফিসার র্যাংকের বেতন কমে তিন ডিজিটে নেমে এসেছে।
বর্তমান অবস্থা এমন যে, অনেক ক্যাডেট, জুনিয়র অফিসার আফসোস করেন, কেন এত পড়াশোনা করে, ২-৩ বছর সময় নষ্ট (!) করে ক্যাডেট হলেন! মাত্র ছয় মাসের ট্রেনিং নিয়ে রেটিং কেন হননি! কেননা জাহাজে যোগ দিয়ে তারা দেখেন, ছয় মাস ট্রেনিং করা একটা ছেলে প্রথম কন্ট্রাক্টে ওএস/ফায়ারম্যান হিসেবে ৪০০ ডলারের বেশি বেতন পান, অথচ ক্যাডেটদের বেতন ১৫০-২৫০ ডলার।
ফ্রেশ কিংবা এক্সপেরিয়েন্সড থার্ড অফিসার/ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ারদের বেতন এবি, অয়েলার (জাহাজের রেটিং) থেকেও কম। এটা অবশ্যই বাংলাদেশি মেরিনারদের জন্য, মেরিন কমিউনিটির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক একটি ব্যাপার যার কোনো সমাধান গত আট বছরেও হয়নি।
ছোট্ট এ জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি এ দেশে জোর গলায় আন্দোলন না করলে, রাস্তায় না নামলে কোনো যৌক্তিক দাবিও পূরণ হয় না। যেহেতু আমরা ‘ভাসমান’ একটি ছোট্ট কমিউনিটি এবং আমরা শান্তিপ্রিয় ‘রয়েল মেরিনার’, তাই রাস্তায় নেমে আন্দোলন করা আমাদের দ্বারা হয়ে ওঠে না। তাছাড়া, অন্যান্য কমিউনিটির মতো এসব ক্ষেত্রে আমাদের শক্তিশালী একতাও নেই যে, আমরা কর্মবিরতিতে যাব দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত।
কেউ একজন কম বেতনে যাবে না বললে আরেকজন লুফে নেবে সে প্রস্তাব! এমনকি ২০-৫০ হাজার টাকা উৎকোচ দিতেও অনেকে কার্পণ্য করবেন না। আর আমাদের যারা ঠকাচ্ছেন তারা এ ব্যাপারগুলো ভালোভাবেই জানেন।
আমাদের পেশাটি যেহেতু ‘আন্তর্জাতিক’, তাই বেতনও আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী হওয়া উচিত। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর বিবেচনা অনুযায়ী, ক্যাডেটদের ন্যূনতম বেতন ৫০০ ডলার, আর জুনিয়র অফিসারদের শুরুর বেতন নূন্যতম ৩০০০ ডলার হওয়া উচিত। জাহাজের প্রকারভেদে অফিসারদের বেতন এর চেয়ে কিছুটা কম-বেশি হতে পারে।
মেরিনারদের অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা আমাদের সিনিয়রদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই এ লেখা। এখানে বেশির ভাগ দেশি কোম্পানির জাহাজে চাকরি করা ক্যাডেট এবং জুনিয়র অফিসারদের দুরাবস্থা তুলে ধরেছি, এর একটি সুন্দর সমাধানই সমস্ত বাংলাদেশি মেরিনারদের কাম্য।
লেখক: এক্স-ক্যাডেট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি (৪৭তম ব্যাচ)
Recent Comments