বাংলাদেশি মেরিনারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা: আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (৪৭/ই)

বাংলাদেশি মেরিনারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা: আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (৪৭/ই)

নিম্নোক্ত লেখার কিছু ঘটনা আমি আগে একবার শেয়ার করেছিলাম। দিন যত যাচ্ছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করার মতো মেরিনারদের সংখ্যাও তত বাড়ছে। এই লেখার মাধ্যমে আরেকবার সকলের সাহায্য-সহযোগীতার কথা ভেবে কৃতজ্ঞ হলাম। আমার বর্তমান অবস্থানে বাংলাদেশ মেরিন কমিউনিটির অবদানের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি।

বাংলাদেশ মেরিন একাডেমিতে চান্স পাওয়া আমার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা। ইন্টারের পরে কোথায় ভর্তি হবো না হবো ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বড়দার সাথে যখন আলোচনা করছিলাম তখন বড়দা বললো, যাই করিস না কেন, আমার মতো ডাক্তার হইস না! আমি তোকে ডাক্তার হতে বললে পরে আজীবন আমাকে বলবি যে জেনেশুনে কেন তোকে মেডিকেলে ভর্তি হতে বললাম। আমি বললাম, তাহলে আর্মিতে ট্রাই করি বড়দা? আর্মিতে গেলে তোর নিজের সেভাবে কোন স্বাধীনতা থাকবেনা, সবসময় একটা রুটিনমাফিক জীবনে চলতে হবে। তাছাড়া পরিবারের অনেকে তোর নাম-র‍্যাংকের অপব্যবহার করতে পারে। এরপর মেরিনার হওয়ার কথা বলতেই বললো, এটা তো খারাপ না, ট্রাই করতে পারিস। দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াবি, ৬ মাস পর পর ছুটিতে আসবি। সব ভেবে শেষমেশ মেরিনার হওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। সত্যি বলতে মেরিন/মেরিনারদের সম্পর্কে স্বচ্ছ কোন ধারণাই ছিল না একাডেমিতে ভর্তির আগ পর্যন্ত। ভর্তি হয়ে দেখলাম এটা বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি নয়, বাংলাদেশ মরণ একাডেমি! এখানে নাকি যত পাংগা তত চাংগা! সিনিয়রদের দেখে মনে হতো, এরা কিভাবে পারে আদরের ছোট ভাইদের সাথে এমন করতে!? আমার স্পষ্ট মনে আছে একাডেমিতে থাকাবস্থায় বড়দাকে চিঠিতে লিখেছিলাম, পৃথিবীর আর কোথাও এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে কিনা আমার জানা নেই!

জয়েনিং এর ৫-৬ মাস পর থেকেই সিনিয়র স্যারদের সাথে সম্পর্ক সহজ হতে থাকে আমাদের। এটাই একাডেমির ট্র‍্যাডিশান। পরে এই চাংগা করা সিনিয়রদের জন্যই কেঁদেছিলাম তাদের বিদায়ের দিনে।

এরপর SC বন্ধু (সিনিয়র ক্যাডেট) হলাম, আমরাও ট্র‍্যাডিশান অনুযায়ী ছোট ভাইদের আদর করলাম অল্প বিস্তর! আমাদের বিদায়েও হয়তো ওরা অশ্রুসিক্ত ছিল।

এই ২ বছরের একাডেমি জীবনে মাত্র ১ বছর করে সিনিয়র-জুনিয়রদের পেয়েছি। অর্থাৎ আমি ৪৭তম ব্যাচের ক্যাডেট, ৪৬ তম ব্যাচের স্যারদের সাথে একবছর আর ৪৮ তম ব্যাচের জুনিয়রদের সাথে ১ বছর কাটিয়েছি। এরমধ্যে নানা ধরনের ছুটিও ছিল। কিন্তু এত অল্প সময়ে এত গভীর সম্পর্ক আমাদের মাঝে গড়ে উঠে যেটা অবিশ্বাস্য! শুধুমাত্র ইমিডিয়েট সিনিয়র-জুনিয়রদের সাথেই নয়, একাডেমির প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের এত আন্তরিক সম্পর্ক যা সাধারণত দেখা যায়না। শুধু বললেই হলো, আমি একাডেমি ক্যাডেট,ব্যস!

পাসিং আউটের পর একাডেমি, একাডেমির সিনিয়র-ব্যাচমেট-জুনিয়র কী জিনিস খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করেছি। আমি ক্যাডেট হিসেবে জাহাজে জয়েন করার সুযোগ পাই ২৫ তম ব্যাচের এক স্যারের মাধ্যমে। স্যার আমাকে উনার ভাগ্নে পরিচয় দিয়ে ২৬ তম ব্যাচের আরেক স্যারের অফিসে পাঠিয়েছিলেন আমার জয়েনিংয়ের ব্যাপারে । উল্লেখ্য যে, আমারই এক ব্যাচমেট আমাকে সেই ২৫ তম ব্যাচের স্যারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তিতে সেই স্যারের অনুরোধে আমি একটা বাল্ক ক্যারিয়ারে জয়েন করেছিলাম এবং আল্লাহর রহমতে একটানা ১৫ মাস ১৪ দিন ইঞ্জিন ক্যাডেট হিসেবে ছিলাম!

আমি পাসিং আউটের ঠিক ৭ মাস পর জাহাজে জয়েন করেছিলাম। এই ৭টা মাস যে আমার কিভাবে কেটেছিল সেটা আল্লাহ ভালো জানেন। একদিকে আব্বার কিডনি ডায়ালাইসিসের মাত্রাতিরিক্ত খরচ, অন্যদিকে আমি বেকার বসে আছি। আমার দেখা আমাদের পরিবারের সবচেয়ে সংকটময় সময় ছিল সেটা। খুব আশা ছিল প্রথম ইনকামের টাকা আব্বার হাতে তুলে দিবো কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে আশা পূরণ করার সুযোগ পাইনি। সেই ৭ মাসের দুঃসহ সময়ে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দিয়েছিলেন ১৫ তম ব্যাচের এক স্যার। আমি হতাশায় নির্ঘুম থেকে রাত ২/৩টায় মেসেজ দিয়ে দেখতাম ভোর ৬ টায় স্যার রিপ্লাই দিয়েছেন! স্যারকে সময় অসময়ে মেসেজের পর মেসেজ দিয়েছি কিন্তু কখনো বিরক্ত হননি। বড়দা বলতেন, একমাত্র তোদের প্রফেশনেই হয়তো এমন মানুষ হয়। আমাদের কোন সিনিয়র তো মেসেজ/মেইল পড়েও দেখবেনা, রিপ্লাই তো দূরের কথা! সেই স্যার অনেকভাবে অনেকবার তার সিনিয়র-ব্যাচমেটকে বলেছিলেন আমার জবের জন্য কিন্তু উপযুক্ত সুযোগের অভাবে জয়েনিং হয়নি। তবে স্যারের আন্তরিকতার এতটুকু কমতি ছিলনা।

পাসিং আউটের পর থেকে এই ১২ বছরে কতভাবে যে কত সিনিয়র-ব্যাচমেট-জুনিয়রের সাহায্য পেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। কয়েকটা ঘটনা বলি…

১০ তম ব্যাচের এক স্যার সিংগাপুর থাকেন। ঢাকাতে উনার ব্যবসা আছে। স্যার সিংগাপুর থেকে ফোন করে আমাকে বলেছিলেন, আমি চাইলে আপাতত জয়েন করতে পারি তার ঢাকা অফিসে। এরপর জাহাজে জয়েনিং এর সুযোগ হলে চলে যাবো যেকোন সময়। উনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনেন না, শুধু একাডেমির জুনিয়র হিসেবেই এ সুবর্ণ সুযোগ দিয়েছিলেন।

২৫ তম ব্যাচের এক স্যার আমাকে পাসিং আউটের পর থেকেই সাপোর্ট দিচ্ছেন সেই সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে! যখন যেভাবে পেরেছেন আমাকে সাহায্য করেছেন। অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রায়ই ফোন দিয়েছেন। বলেছেন যদি কখনো টাকার দরকার হয় স্যারকে যেন জানাই! যেখানে নিজের অনেক আত্মীয়স্বজন থেকেই বিপদের সময় ৫ হাজার টাকা পাইনি সেখানে স্যার আমাকে ৫০ হাজার টাকা দিতে চেয়েছেন শুধুমাত্র একাডেমির জুনিয়র হিসেবে! তাও সে সময় যখন আমার সামনে কোন আশা-ভরসা নেই। পরিচয়ের প্রায় ১০ বছর পর গত সেপ্টেম্বরে আমি অস্ট্রেলিয়াতে আসার পর স্যারের সাথে সামনাসামনি প্রথম দেখা হয়েছে।

২৪ তম ব্যাচের এক স্যার মার্কস লাইনের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। স্যার মার্কসে এমন কোন কাজ নেই করেননি আমাকে জয়েন করানোর জন্য! উনি আমাকে প্রতিনিয়ত মেসেজের রিপ্লাই দিতেন এত ব্যস্ততার মাঝেও। স্যারের সাথে প্রথম যেদিন ধানমণ্ডিতে কাকতালীয়ভাবে দেখা হলো সেদিন আমার স্ত্রী সাথে ছিল। স্নেহের নিদর্শন স্বরূপ ভাবী (স্যারের স্ত্রী) আমার সহধর্মিণীকে নিজের স্বর্ণের আংটি পরিয়ে দিয়েছিলেন! অথচ স্যারের সাথে আমার পরিচয়-কথাবার্তা হোয়াটসঅ্যাপে শুধুমাত্র একাডেমির একজন জুনিয়র হিসেবে।

২০১৫ সালে ক্লাস-থ্রি সিওসি পাবার পর যখন জুনিয়র অফিসারদের চাকরির বাজারে হাহাকার তখন ২৯ তম ব্যাচের এক স্যার আমাকে সরাসরি ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ট্যাংকার এক্সপেরিয়েন্স না থাকা সত্ত্বেও সিঙ্গাপুরের একটা রিনাউন্ড কোম্পানিতে চাকরি দিয়েছিলেন র‍্যাংকের সেরা বেতনে। উনাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না, শুধুমাত্র হোয়াটসঅ্যাপে বিভিন্ন সময়ে একটা চাকরির জন্য অনুরোধ করেছিলাম।

২৪ তম ব্যাচের আরেকজন স্যার সিঙ্গাপুরে থাকেন। ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে প্রথম জাহাজে কাজ করার পর আমাকে প্রায় ৯ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এরপর স্বল্পভাষী সেই স্যারের আন্তরিকতার জন্য ইউএস ভিসা করানোসহ দ্বিতীয় কন্ট্রাক্ট করার সুযোগ পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে এই ইউএস ভিসা থাকায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এল.এন.জি কোম্পানি, নাকিলাতে ইন্টারভিউ দিয়ে পার্মানেন্ট এমপ্লয়ি হবার সুযোগ পাই।

বেশ কয়েকবছর আগে আমার এক আত্মীয়ের জরুরি কিছু টাকার দরকার হয়েছিল। আমি জাহাজ থেকে পাঠাতে গেলে সময়-ঝামেলা দুটোই বেশি হবে ভেবে ৩৪ তম ব্যাচের এক স্যারকে মেসেজ দিয়েছিলাম। স্যার আমাকে তৎক্ষণাৎ রিপ্লাই দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কবে কত টাকা লাগবে! জানানোর ১ দিনের মধ্যেই স্যার ১০০০ ডলার ট্রান্সফার করে দিয়েছিলেন অথচ টাকা দেয়ার আগে কখনো দেখাই হয়নি স্যারের সাথে।

২০১৮-১৯ সালে সিংগাপুরে ক্লাস টু দেয়ার সময়ে ৪৪, ৪৫, ৪৬ তম ব্যাচের স্যারদের আর ৪৮ তম ব্যাচের একমাত্র জুনিয়রের আন্তরিকতার কথাও কখনো ভুলার নয়।

২০২০ সালে করোনার লকডাউনে আমার পরিবার অস্ট্রেলিয়া বেড়াতে গিয়ে আটকা পড়লে অস্ট্রেলিয়াতে থাকা ১০ তম ব্যাচের এক স্যার বলেছিলেন, “If your family needs any help please let me know.” বিপদের সময় এমন ছোট্ট একটা মেসেজ যে কত বড় মানসিক সাপোর্ট তা বলে বোঝানো যাবেনা।

২০১৭ সালে ক্যামিকেল ট্যাংকারে এক কন্ট্রাক্ট করার পরেই আমার গ্যাস ট্যাংকারে জয়েন করার আগ্রহ তৈরি হয়। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করার প্রায় ৪ বছর পর, ২০২১ সালের অক্টোবরে ২৯ ব্যাচের একজন সিনিয়রের আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এল.এন.জি কোম্পানিতে ইন্টারভিউ এবং চাকরি করার সুযোগ পাই। স্যারকে লিংকড-ইনে খুঁজে পেয়েছিলাম এবং কোন পূর্ব পরিচয় ছাড়া শুধু একজন জুনিয়র হিসেবেই এপ্রোচ করেছিলাম।

গতবছর অস্ট্রেলিয়ায় আসার আগে একটা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আমার বেশ বড় অংকের টাকার দরকার হয়। তখন একাডেমির মাত্র ৪ জন ব্যাচমেট থেকে ১১ লাখ টাকার সাহায্য পাই কোন শর্ত ছাড়া। সময়ে অসময়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে একাডেমির ব্যাচমেটদের নিজের ভাইয়ের মতো যেভাবে পাশে পাই-সেটা ভাবলে নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে হয়।

২০২৩ সালে অস্ট্রেলিয়া আসার প্রসেসিং শুরুর পর থেকে আজ পর্যন্ত এডিলেইডে থাকা একজন সিনিয়রের যে আন্তরিকতা আর ভালবাসা পেয়েছি তা কয়েকপেইজ লিখেও শেষ করা যাবেনা। এডিলেইডে আসার আগে আমার জন্য বাসা ইন্সপেকশন থেকে বাসার অগ্রীম ভাড়া দিয়ে কনফার্ম করার কাজও স্যার করেছেন। এডিলেইড এয়ারপোর্টে পা রাখার পর আমাদের প্রথম সপ্তাহ ভাবীর রান্না করা সুস্বাদু খাবার খেয়েই কেটেছে। স্যার অস্ট্রেলিয়ার একজন সিনিয়র মেরিন সার্ভেয়ার হয়েও আমাকে দিনের পর দিন নিজের গাড়িতে করে ঘুরিয়ে, সময় দিয়ে সমস্ত কিছু কেনাকাটা করে গুছিয়ে দিয়েছেন। স্যার এবং ভাবীর যে আন্তরিকতা আমার পরিবারের প্রতি সেটা অকল্পনীয়। অথচ ৯/১০ মাস আগেও তাদের চিনতাম না।

উপরোল্লিখিত এডিলেইডের যে স্যার আমাকে নিজের সন্তানের মতো দেখভাল করছেন, তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আরেকজন উদারমনা সিনিয়র। ১৪ তম ব্যাচের সেই স্যার পার্থে থাকেন এবং স্যারের সাথে ২০১৯ সালে হোয়াটসঅ্যাপে পরিচয় হয় কোন একটা ব্যাপারে আলোচনার জন্য। আমার অস্ট্রেলিয়া আসার প্ল্যান আছে শুনে স্যার বলেছিলেন যেকোন ব্যাপারে সাহায্য লাগলে যেন নি:সংকোচে জানাই। এরপর এডিলেইডে আসবো জানালে স্যার এডিলেইডে থাকা সেই সিনিয়রের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন যেজন্য আমার অস্ট্রেলিয়ার জীবনযাপন অত্যন্ত সহজ আর পরিকল্পিত হয়েছে।

আমার স্ত্রী-কন্যাকে অস্ট্রেলিয়ায় একা রেখে ৪ মাসের কন্ট্রাক্ট করা বেশ কষ্টসাধ্য, বিশেষ করে আমার স্ত্রীর জন্য। নিজের ক্লাস-পড়াশোনা, বাসার বাজার-সদাই, মেয়েকে স্কুলে আনা-নেয়া থেকে সবকিছুই ওকে একা হাতে করতে হয়। এমতাবস্থায় অস্ট্রেলিয়াতে একটা জব করার সুযোগ হলে সবদিক থেকেই একটু সুবিধা হবে ভেবে সিনিয়রদেরকে সুইট্যাবল একটা জব পেতে সাহায্য করতে অনুরোধ করি। মাসখানেক আগে হঠাৎ করেই ৩৯ তম ব্যাচের এক স্যার আমাকে অস্ট্রেলিয়ার একটা অন্যতম সেরা অফশোর কোম্পানিতে রেফার করেন। স্যার অস্ট্রেলিয়ান স্ট্যান্ডার্ডে আমার সিভি রেডি করে কোম্পানিতে ফরোয়ার্ড করা থেকে আমার ইন্টারভিউ প্রিপ্রারেশনেও সাহায্য করেন। পরবর্তীতে আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি সিলেক্টেড হই। বর্তমান সময়ে জীবনের নানা ব্যস্ততায় যেখানে আমরা দম ফেলার সময় পাইনা সেখানে স্যার যেভাবে আমার জন্য সবকিছু করেছেন তার জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ।

ক্যাজুয়াল এমপ্লয়ি হিসেবে প্রথমবার কাজ করার জন্য আমাকে মেলবোর্ন যেতে হয়েছিল। সময় এবং সুযোগের স্বল্পতায় সেখানে থাকা অনেকে এসে দেখা করতে না পারলেও ৪১ তম ব্যাচের একজন সিনিয়র তার মূল্যবান সময় নষ্ট করে আমার মতো এক জুনিয়রের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার কালচারে অস্ট্রেলিয়ানদের সাথে কাজ করার বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছিলেন, পরবর্তী করনীয় ব্যাপারে গাইড করেছিলেন।

কিছুদিন আগেই সিঙ্গাপুরে পরীক্ষা দেয়ার জন্য ভিসার আবেদন করতে সেখানকার PR বা পাসপোর্ট হোল্ডার একজনের একটা লেটার দরকার হচ্ছিল যা ২৯ ব্যাচের একজন স্যার দিয়েছেন অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে।

দু:খজনকভাবে সিঙ্গাপুর ভিসা পেতে লেইট হওয়ায় আমি নির্ধারিত দিনে পরীক্ষায় এটেন্ড করতে পারিনি এবং আমার ক্লাস-টু সিওসি রিনিউ করার প্রয়োজন পড়ে। রিনিউয়ালের জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে ১০০ ডলারের কম পেমেন্ট ট্রান্সফার করতে না পারায় সিঙ্গাপুরে থাকা ২৮ তম ব্যাচের এক স্যারকে জানাই। স্যার বিনাবাক্যে আমার ৯৩ ডলার পেমেন্ট করতে রাজি হয়ে যান। এখানে টাকার পরমাণটা মূখ্য না, কিন্তু যেভাবে স্যার সাথে সাথে সাহায্যের জন্য রাজী হয়েছেন সেটাই ভালো লেগেছে।

সিওসি রিনিউ করার পর তাড়াতাড়ি হাতে পেতে ৪৮ ব্যাচের এক জুনিয়রকে অনুরোধ করি যে ক্লাস-টু পরীক্ষা দিতে সিঙ্গাপুর ছিল। সেই জুনিয়র সিওসি রেডি হবার সাথে সাথে MPA অফিসে গিয়ে সিওসি কালেক্ট করে DHL এ পাঠিয়ে দেয় এবং মাত্র ২২ ঘন্টায় তা আমার হাতে এসে পৌঁছায়।

অস্ট্রেলিয়ার ইকুইভ্যালেন্ট সার্টিফিকেটের জন্য পরীক্ষা দেয়ার পরিকল্পনা আছে জেনে ৪৬ ব্যাচের একজন সিনিয়র তার এত ব্যস্ততার মাঝেও মূল্যবান পরামর্শ, নোট আর গাইডলাইন দিয়ে যেভাবে সাহায্য করছেন তা যে-কেউ করবেনা।

শুধু যে একাডেমির সবাই আন্তরিক তেমন না। একাডেমি ছাড়াও অনেক মেরিনারদের সাহায্য-ভালোবাসা পেয়েছি যাদের প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ।

সিলেট ক্যাডেট কলেজের এক্স-ক্যাডেট একজন চিফ ইঞ্জিনিয়ার স্যার ২০১৫ থেকে বিভিন্নভাবে আমাকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন। আমার জব দেয়া থেকে ইউ.এস ভিসা করানোর জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছিলেন।

সিংগাপুরে ক্লাস টু দেয়ার সময় পহেলা বৈশাখের প্রোগ্রামে নিয়ে যেতে এক স্যার নিজে আমাদের বাসার নিচে এসেছিলেন পিক করতে। ভাবী-ভাতিজিদের সাথে আমাদেরকে একই গাড়িতে করে নিয়ে গিয়েছেন আবার নামিয়ে দিয়েছেন। কতটুকু আপন মনে করলে নিজের পরিবারের সদস্যদের সাথে জুনিয়রদের নিয়ে একটা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন তা সহজেই অনুমেয়।

করোনা মহামারীর সময়ে মেরিন ফিশারিজ একাডেমির একজন সিনিয়র স্যার যেভাবে তার হোটেলে ১৪ দিন থাকার সুযোগ দিয়েছিলেন তা আজও স্মরণীয়।

এমন আরো অসংখ্য ঘটনা আছে মেরিনারদের নিয়ে যা বলে বা লিখে শেষ করা যাবেনা। সবার আন্তরিকতা দেখে আমি প্রতিনিয়ত অবাক হই। সবাই এত বিনীত, এত বিনয়ী! ভাবি, যদি আমিও হতে পারতাম তাদের মতো। আমার মতো একজন জুনিয়রকে যে এত ব্যস্ততার মধ্যেও সবসময় রিপ্লাই দেন এটাই তো আমার জন্য কত বড় প্রাপ্তি !

ভালো খারাপ দুনিয়ার সবখানে আছে-থাকবে এটাই নিয়ম। আমাদের একাডেমি বা প্রফেশনের শতভাগ যে ভালো সেটা না। আমি নিজেও বেশ কয়েকজন খারাপ এক্স-ক্যাডেট, মেরিনারদের দেখেছি যারা জুনিয়রদের নিয়ে ব্যবসা করে, সিনিয়র বলে সবসময় জুনিয়রদের থেকে বিভিন্নভাবে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করে জুনিয়রদের অজ্ঞতা বা বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে। কিন্তু সেসব গুটিকয়েক মেরিনার, এক্স-ক্যাডেটদের জন্য বাকি হাজারো সাদা মনের মেরিনারদের ভালো ব্যাপারগুলো প্রকাশ না করাও আমার কাছে অন্যায় বলে মনে হয়। সবখানে, সব ব্যাচেই কিছু অপ্রত্যাশিত ভাইরাস থাকে যা ফিল্টারিং এর সুযোগ নেই। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যতটুকু দেখেছি, মেরিনারদের মধ্যে সে খারাপের অনুপাত খুবই নগন্য। হয়তো হাজারে ৮-১০ জন! হয়তো এই ৮-১০ জনের জন্যই বাকিরা কত ভালো তা সহজে উপলব্ধি করতে পেরেছি।

আমি অত্যন্ত গর্বিত বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির একজন ক্যাডেট হতে পেরে, বাংলাদেশ মেরিন কমিউনিটির একজন হতে পেরে। আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ পৃথিবীতে অদ্বিতীয় এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাংগা খেয়ে চাংগা হওয়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য।

মহান আল্লাহ আমাদের বাংলাদেশি মেরিনারদের মধ্যকার এই ভ্রাতৃত্ববোধ আরও হাজার বছর টিকিয়ে রাখুন, আগামীতে আমাকে এই কমিউনিটির প্রয়োজনে উল্লেখযোগ্য কিছু করার মতো যোগ্যতা দান করুন…. আমীন।


লেখক: আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ, এক্স-ক্যাডেট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, ৪৭তম ব্যাচ

Share