অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন ব্যবস্থাপনা – শামস উজ জামান (১১ন)

অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন ব্যবস্থাপনা – শামস উজ জামান (১১ন)

নদীমাতৃক বাংলাদেশে বহুকাল ধরে অভ্যন্তরীণ কার্গো/তেলবাহী জাহাজ, বাল্কহেড, ইঞ্জিনচালিত নৌকা এবং লঞ্চ-স্টিমারে করে মালামাল ও যাত্রী পরিবহনের বিশাল এক কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হয়ে আসছে। এসবের সঙ্গে আছে অসংখ্য ট্রলার এবং ছোট ছোট নৌকা/নৌযানের নানাবিধ ব্যবহার।
সমুদ্রগামী জাহাজ দেশের ‘মার্চেন্ট শিপিং অর্ডিনেন্স-১৯৮৩’ (এমএসও-১৯৮৩) এবং আন্তর্জাতিক আইনকানুন মেনে চলাচল করে। বাকি নৌযানগুলো ‘ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিনেন্স-১৯৭৬’ (আইএসও-১৯৭৬) দ্বারা পরিচালিত হয়। বর্তমানে নৌ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ‘ডিপার্টমেন্ট অফ শিপিং’ (ডিওএস) মাত্র ৫-৭ জনের একটি ঊর্ধ্বতন পেশাজীবী লোকবলের (সার্ভেয়ার) সমন্বয়ে, সরকারি-বেসরকারি এসব নৌযানের আইনকানুন/বিধিমালা তৈরি, বিদেশগামী এবং অভ্যন্তরীণ জাহাজের নাবিকদের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ, জাহাজের নকশা অনুমোদন, সার্ভে ইত্যাদি কাজগুলো দেখাশোনা করেন। বিষয়টি জটিল এবং এত কমসংখ্যক পেশাজীবীর জন্য এতকিছু দেখে রাখা একটি দুরূহ কাজ। এ কাজগুলোর বেশিরভাগই তাই টেবিলে বসে করা সম্ভব, বাস্তবে নয়। এছাড়াও আছে সময়োপযোগী আইনকানুনের অভাব।

কিছুদিন আগে একটি পরিপত্র জারি করে ছোট ছোট নৌযানগুলোর (৬০ ফুটের কম লম্বা-ইঞ্জিনচালিত বোট) জন্য মাস্টার ড্রাইভার রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মাস্টার ড্রাইভার না পাওয়া গেলে ছয় মাস পর্যন্ত ডিস্পেনশনের ব্যবস্থা আছে। ওদিকে এসব মাস্টার ড্রাইভারের সংখ্যা হাতেগোনা মাত্র ক’জন। এত কমসংখ্যক লাইসেন্সপ্রাপ্ত মাস্টার ড্রাইভার দিয়ে কোনোভাবেই এ আইনটি কার্যকর করা সম্ভব নয়। ছয় মাস অন্তর ঢাকা এসে ডিস্পেনশন নেওয়ার কাজটি হয়রানিমূলক এবং ব্যয়বহুল।

এ সমস্যার একটি যুগোপযোগী সমাধান হতে পারে, এসব নৌযানে কর্মরত হাজার হাজার সুকানি ড্রাইভারদেরকে একটি ‘ক্রাশ প্রোগ্রামের’ মাধ্যমে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রামের মতো শিপিং অফিসগুলোতে অল্প বিস্তার পরীক্ষা গ্রহণ করা সাপেক্ষে অন্তত পাঁচ বছরের জন্য অস্থায়ী সনদ বা ডিস্পেনশন প্রদান করা। এ কাজে লিখিত কোনো পরীক্ষা বাঞ্ছনীয় নয়। কারণ বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এসব নাবিকের অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক তেমন কোনো লেখাপড়ার অভিজ্ঞতা নেই। প্রয়োজনে কিছু প্রতিষ্ঠান দিয়ে এসব সুকানি-ড্রাইভারকে ন্যূনতম কিছু মৌখিক ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

আজকাল যাতায়াতের জন্য অনেক ছোট-বড় লঞ্চে হাজার হাজার যাত্রী চলাচল করে। এসব লঞ্চের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রিকৃত যাত্রী ধারণক্ষমতা অনেক কম। ওদিকে কোনো দুর্ঘটনা হলেই আইনের বেড়াজালে ‘অতিরিক্ত ধারণক্ষমতায় যাত্রী বহনের’ কথা বলা হয়ে থাকে। শুনেছি অনেক মালিকও নাকি ‘ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথোরিটিকে’ (আইডব্লিউটিএ) যাত্রী প্রতি নির্ধারিত ‘নৌ-দুর্যোগ তহবিল ট্রাস্ট বোর্ড’ এ প্রদেয় টাকা কমিয়ে রাখার জন্য যাত্রীসংখ্যা কম দেখিয়ে জাহাজের রেজিস্ট্রেশন করিয়ে থাকেন। এ বিষয়টি সঠিক কিনা ভেবে দেখা উচিত। আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে, বড় কোনো অঘটন ঘটার পরে ‘যাত্রী সংখ্যা কমিয়ে রাখা সিদ্ধান্তটি’ আত্মঘাতি হয়ে দেখা দিতে পারে। এ ঘটনাটি ছোট ছোট লঞ্চের বেলাতেও সত্য ।

কার্গো জাহাজের ক্ষেত্রেও ‘ধারণক্ষমতা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি লক্ষ্য করেছি, মালামাল বোঝাই অবস্থায় বে ক্রচিং জাহাজসহ (সমুদ্রপথে ভোলা জেলার ইলিশা থেকে চট্টগ্রাম বহির্নোঙ্গর পর্যন্ত) অন্য অনেক কার্গো জাহাজের ‘ফ্রি বোর্ড’ অর্থাত্ পানির উপরিভাগ থেকে জাহাজের মেইন ডেক পর্যন্ত জায়গাটি নিতান্তই কম। প্রায়শই এ জাহাজগুলো নাকে-মুখে মালামাল বোঝাই করে চলাচল করে। বাস্তবতার নিরিখে এ বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে। দুই ফুট ফ্রি বোর্ড বাড়ালে নির্মাণ খরচ খুব বেশি বাড়ে না। যেটুকু বাড়ে বাড়তি নিরাপত্তা বিবেচনায় সে খরচ কিছুই না। এসব জাহাজগুলোকে সম্ভব হলে বাধ্যতামূলক বীমার আওতায় আনাও জরুরি।

বর্তমানে চলাচলরত পুরানো এবং ছোট আকারের অনেক জাহাজ এবং লঞ্চের কাঠামোগত সমস্যা আছে এবং এসব সমস্যা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এসব নৌযানগুলোকে নথিভুক্ত করার পাশাপাশি, এগুলোর নির্মাণ ত্রুটিগুলো নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্মাণ ত্রুটিগুলো সংশোধন করা সাপেক্ষে এসব নৌযানের ফিটনেস, ধারণক্ষমতা, ফ্রি বোর্ড ইত্যাদি সংশোধন করা গেলে ভবিষ্যতে অনেক দুর্ঘটনা কমে আসবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের নদীনালায় যেদিন পর্যন্ত দুই-চার ফুট পানিও থাকবে, সেদিনও কিন্তু ‘তুলনামূলক সস্তা পরিবহণের মাধ্যম’ হিসেবে নৌপথই বিবেচিত হবে। এ কথাটা পৃথিবী জুড়ে সব দেশের জন্য সত্য। আশার কথা, যে দেশে হাতুড়ি ‘জোগান’, গ্যাস কাটার ও ওয়েল্ডিং মেশিন ব্যবহার করে একটি জাহাজ বানানো হয়, সেখানে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ সেক্টরটি ভবিষ্যতে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

 

এই  লেখাটি ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় – ২৭ জুন ২০১৮।

http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/opinions/2018/06/27/285380.html


লেখক :মাস্টার মেরিনার ও শিপিং কনসাল্টেন্ট

Share