জাহাজে ঈদ – রেফায়েত ইবনে আমিন (২০ই)
আমি হয়তো ডিউটি শেষে কেবিনে এসে সময় কাটানোর চেষ্টায় ব্যস্ত থাকতাম। এখন তো ইন্টারনেট, ওয়াই-ফাইয়ের যুগে, সকলেই সবসময়েই পরিবারের সঙ্গে অডিও-ভিডিও চ্যাট করছে। অবশ্য মাঝে মাঝে চিন্তা করি, আমাদের সময়ে কোনকিছু ছাড়া পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকাটার কষ্টটা বেশী?
সমুদ্রের মাঝে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে সুখে-দুঃখে আমাদের দিন কাটে; দুনিয়ার সব মানুষের মতই, কোনোদিন হাসিখুশিতে পার করি, আবার কোনোদিন হয়তো কষ্ট হয়, মনভারাক্রান্ত থাকে কোনো কারণে। কিন্তু, জাহাজে ঈদের দিনগুলোতে দুঃখের পরিমাণ মনে হয় অনেকখানি বেড়ে যায়, বিশেষ করে যদি গভীর সমুদ্রে থাকি। আরো সঠিকভাবে বললে বলতে হবে, ঈদের কয়েকদিন আগের দিনগুলো হয় সবচেয়ে কষ্টের। নিশ্চয়ই সহজেই অনুমান করতে পারছেন, কেন? পরিবারের সকলের সঙ্গে একসাথে উৎসব-আনন্দের ঈদের দিনটা যখন জাহাজে করতে হয়, তখনকার বুক হু-হু করা শূণ্যতা কাউকে বলে বুঝানো যাবে না। আমি নিশ্চিত যে, আমাদের ক্ষেত্রে যেমন ঈদ; ঠিক একইভাবে একজন খ্রীষ্টানের জন্যে ক্রিস্টমাস-ইস্টার, হিন্দু-বৌদ্ধদের জন্যে পূজা-পার্বন, অথবা অন্যরা যে যা পর্ব-উৎসব পালন করে, সেসমস্ত দিন যদি জাহাজে থাকা অবস্থায় হয়, তাহলে তাদেরও একই অনুভূতি হয়।
বাংলাদেশী জাহাজে তেমন অসুবিধা হয় না। হ্যা, অবশ্যই আপনি ঈদের দিন আপনার পরিবার-পরিজনকে হয়তো কাছে পাবেন না। কিন্তু তবুও তো বাংলাদেশী কয়েকজন মিলে ঈদ করতে পারবেন। আর ভিনদেশী জাহাজ হলে, তখন তো ঈদ চিন্তাও করা যায় না। যদি সেই ভিনদেশী জাহাজটা মুসলিম কোন দেশের হয়, (ইরান, কুয়েত ইত্যাদি) তাহলে হয়তো সেখানেও কিছুটা ঈদের আমেজ পাবেন। আরেকটা হতে পারে, যেই দেশের জাহাজই হোক না কেন, আপনার সঙ্গে বেশ কয়েকজন মুসলিম রয়েছে; ভাগ্য আরো ভালো হলে বাংলাদেশী সঙ্গে রয়েছে, তাহলে ঈদের দিন, কিছুটা হলেও পালন করতে পারবেন। সবচেয়ে কষ্ট হয়, যদি আপনি একা কোনো জাহাজে পড়ে যান, তখন। আমার নিজেরই তখন নিজেকে এতিম, এতিম মনে হয়।
আমার মেরিনার জীবন শুরু হয় ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশানে ক্যাডেট-ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে। সে বছর দুইটা ঈদেই জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ছিলো বলে বাসায় গিয়ে ঈদ করতে পেরেছিলাম। চট্টগ্রামে বাসা ছিলো বলে, সেই সুবিধা পেয়েছিলাম। কিন্তু যাদের বাসা অন্য শহরে, তাদের বেশ কষ্ট হয়। অনেকেই চেষ্টা করে ছুটি নিয়ে বাসায় যেতে। কিন্তু, সকলেই তো একসাথে ছুটি নিতে পারবে না; তাই কেউ পায়, কেউ পায়না। আমিও চেষ্টা করতাম ঈদের দিনে আমাদের বাসায় কাউকে সঙ্গে এনে তার কষ্ট কিছুটা কমাতে।
প্রথম বছরে, ক্যাডেট লাইফে ক্বুরবানী ঈদের কথা মনে আছে, “বাংলার কিরণ” জাহাজে ছিলাম। জাহাজটা তখন পদ্মা ওয়েল কোম্পানি ও সিমেন্ট-ফ্যাক্টরীর মাঝে রিভার-মুরিং-এ ছিলো। আগের রাতে ডিউটি শেষ করে ঝট করে রেডি হয়ে বের হতে হতেই রাত দশটা বেজে গেলো। ততক্ষণে সবধরনের যানবাহনই বলতে গেলে রাস্তা থেকে উঠে গেছে – সকলেই পরেরদিন ঈদের প্রস্তুতি নিতে গেছে। একটা রিক্সা পেয়ে অনুরোধ করলাম, আমাকে যতদূর পারে আগিয়ে দিতে। কিছুদূর গিয়ে নেভীর দ্বিতীয় গেটের কাছে দেখি একজন অজানা ব্যক্তি একটা বেবী-ট্যাক্সির চালককে অনেক অনুরোধ করছেন। আমিও রিক্সা থেকে নেমে, সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে যোগ দিয়ে ট্যাক্সী-ড্রাইভারকে রাজী করিয়ে দুইজনে একসঙ্গে উঠলাম। সে ইপিজেড-এর গেইটে এসে আমাদের নামিয়ে দিলো, আর যাবে না। সঙ্গের ভদ্রলোক ওয়াসার-মোড় পর্যন্ত যাবেন; আর আমি যাবো বায়জীদ-বোস্তামী, শেরশাহ্ কলোনিতে। ইপিজেড-এর সামনে একটু অপেক্ষা করে, একটা খালি প্রাইভেট কার পেয়ে সেটার ড্রাইভারকে পটিয়ে আগ্রাবাদ পর্যন্ত এলাম। সেখানে একটা শহর এলাকা বাসে টাইগার-পাস পর্যন্ত। সেখান থেকে আবার একটা রিক্সায় চড়ে আমরা দুইজনে লাল-খান বাজার মোড়। ভদ্রলোকের সঙ্গে এতক্ষণ ধরে আছি, অল্পস্বল্প কথাবার্তায় বের হলো, উনিও একজন মেরিনারের দূর-সম্পর্কের আত্মীয়। লাল-খান বাজারের মোড়ের হোটেলে উনি আমাকে চা না খাইয়ে ছাড়লেন না। ১৯৮৫ সালের দিকে দিনকাল অল্পকিছুটা হলেও ভালো ছিলো। রাত এগারোটা-বারোটার সময়েও, অপরিচিত লোকের সঙ্গেই ট্যাক্সী-রিক্সায় চলেছিলাম, হোটেলে চা খেয়েছিলাম – খুব বেশী ভয় করে নাই। এবারে আমি আরেকটা রিক্সা নিয়ে একদম শেরশাহ কলোনি বাসায় পৌঁছলাম। কিন্তু পৌঁছলেই তো হবে না, বাসায় তো ঢুকতে হবে। রাত দেড়টার সময়ে, সব গেইট বন্ধ, সকলেই পরেরদিন ঈদের নামাজের জন্য তাড়াতাড়ি উঠতে হবে বলে ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক ডাকাডাকি ও দরজা ধাক্কাধাক্কি করে, অবশেষে গেইট খুলানো গেলো। এই গভীর রাতে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে পেয়ে সকলেই খুশী; তাই কাঁচাঘুম বা গভীর ঘুম ভাঙ্গানোর অপরাধ মাফ হয়ে গেলো। নিজ পরিবারের সঙ্গে ঈদ করবো বলে, কত কষ্ট করে, কত ভিন্নভিন্ন ধরনের যানবাহন করে বাসায় এসেছিলাম সেবার, সেটা চিন্তা করলেই মনে হয়, সেবারের ঈদ স্বার্থক হয়েছিলো।
আরেকটা ঈদের কথা মনে আছে। আমি তখন বৃটিশ কোম্পানী CI Shipping-এর Mistral জাহাজে। সেখানে আমরা দুইজন বাংলাদেশী অফিসার ছাড়া সকলেই বৃটিশ; কিন্তু ক্রু সবাই বাংলাদেশী। ব্রাজিল থেকে সাউথ আফ্রিকা হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছিলাম। আমার মনে আছে রোজার মাসে সাউথ আফ্রিকায় থেমেছিলাম, এবং জাহাজে অনেক কাজের জন্যে বেশ কিছু রিপেয়ার টেকনিশিয়ান এসেছিলো। তাদের মধ্যে একজন প্রচুর খাটাখাটুনি করেছিলো। চেহারা দেখে ধারনা করছিলাম, সম্ভবতঃ তিন-চার জেনারেশান আগে তার পূর্ব-পুরুষেরা ভারতবর্ষ থেকে গিয়েছিলো। পরে দেখি সে ইফতারি করলো, রাতে সেহ্রী খেলো। সে যেই পরিমাণ পরিশ্রম করেছিলো, আমার কল্পনাতেও আসে নাই, তার পক্ষে রোজা রাখা সম্ভব। যাহোক আমরা রমজান মাসের শেষের দিকে ওমানের সালালাহ্ বন্দরে পৌঁছালাম। আগামীকাল ঈদ, জাহাজের বৃটিশ ক্যাপ্টেন, বৃটিশ চীফ-অফিসার দুইজনেই সালালাহ্র লোকাল এজেন্টকে অনেক করে অনুরোধ করলো, আমরা যারা মুসলিম আছি, তাদের মসজিদে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে। সে বললো, অবশ্যই করবে। পরদিন সকালে যারা যারা ঈদের নামাজে যেতে চায়, তারা যেন রেডি থাকে।
সেই অনুযায়ী আমরা প্রায় পনের-বিশজন ঈদের প্রস্তুতি নিলাম – সকালে গোসল করে, পাজামা-পাঞ্জাবী পড়ে তৈরী। কিন্তু এজেন্টের আর কোনো দেখা নাই। দুই-তিন ঘন্টা অপেক্ষা করার পর বুঝা গেলো, সে আর আসছে না। অতঃপর আমরা নিজেরাই একটা জামাত করে নামাজ পড়লাম, একজন একটু খুৎবা দিলো। ক্রু সবাই বাংলাদেশী; সেজন্যে চীফকুক আর সেকেন্ড-কুক মিলে দেশী স্টাইলে ঈদের রান্নাবানা করলো – সেমাই, পোলাও-কোর্মা ইত্যাদি। কিন্তু, সেটা ছিলো এক বিষন্ন ঈদের দিনের কাহিনী। আমি মনে মনে চিন্তা করলাম, এজেন্ট কী কথা দিয়ে কথা রাখলো না? সেটা কি তার দোষ? নাকি সালালাহ্ পোর্ট কর্তৃপক্ষ তাকে আসতে দিলো না? দুইটার কোনোটাকেই মেনে নিতে পারছিলাম না। কয়েকজন মুসলিম ঈদের নামাজ পড়তে যাবে, সেটা কেন করতে দিলো না। মাঝখানে আমরা জাহাজের বৃটিশদের কাছে একটু ছোট হয়ে গেলাম। আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্যে বৃটিশ চীফ-অফিসার সারাক্ষণই সঙ্গে ছিলেন, কারণ ক্রুদের দায়িত্ব তার কাছে। সে-ও একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলো, একজন লোক কথা দিয়ে কথা রাখলো না দেখে। আমি চিন্তা করি, আমরা একেকজন প্রত্যেকে একেকটা কারণে, একেক জায়গায় আনঅফিসিয়াল এম্বাস্যাডরের দায়িত্ব পালন করি। আমার ব্যবহার, আচার-আচরন, কাজকর্ম, আমাকে অন্যদের সামনে আমার পরিবারের এম্বাস্যাডর, বা নন-মুসলিমদের সামনে মুসলিম-এম্বাস্যাডর, বিদেশীদের সামনে বাংলাদেশের এম্বাস্যাডর হিসাবে কাজ করবে। সেই ওমানী এজেন্ট বা পোর্ট কর্তৃপক্ষ কোন ধরনের মুসলিম-এম্বাস্যাডরের কাজ করলেন সেদিন?
এরপরের বছরগুলোর ঈদগুলোর কথা তেমন মনে নাই। প্রায় সবগুলোতেই কাজ বা ডিউটি ছিলো। গভীর সমুদ্রে থাকলে তো পরিবারের সঙ্গে কথা বলার প্রশ্নই নাই। পোর্টে থাকলে কথা বলার কিছুটা সম্ভাবনা থাকে; কিন্তু প্রায় সময়ই বাংলাদেশে লাইন পেতে ঘন্টার পর ঘন্টা চেষ্টা করতে হতো। ঈদের দিন জাহাজের কোন সহকর্মী যদি ঈদ কি জানতো, তবে সে লৌকিকতার খাতিরে একটা ঈদ-মুবারাক বলতো। আমি হয়তো ডিউটি শেষে কেবিনে এসে সময় কাটানোর চেষ্টায় ব্যস্ত থাকতাম। এখন তো ইন্টারনেট, ওয়াই-ফাইয়ের যুগে, সকলেই সবসময়েই পরিবারের সঙ্গে অডিও-ভিডিও চ্যাট করছে। অবশ্য মাঝে মাঝে চিন্তা করি, আমাদের সময়ে কোনকিছু ছাড়া পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকাটার কষ্টটা বেশী? না, এযুগের অ্যাপ্সের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু ধরা যাচ্ছে না – সেই কষ্টটা বেশী? প্রবাসীদের ঈদ কষ্টের; কিন্তু তাও তারা মসজিদে নামাজ পড়তে পারে, কয়েকজন প্রবাসী মিলে ঈদ করতে পারে। আর, গভীর সমুদ্রে মেরিনারদের ঈদ আরো বহুগুণে কষ্টের। তারা প্রবাসী এবং তার উপরে নীলসমুদ্রে নিঃসঙ্গ। বুকের গহীন থেকে তাদের জানাই ‘ঈদ মুবারাক’।
আমার নিজস্ব কোনো ছবি পেলাম না; তাই ইন্টারনেট থেকে Dr-Captain Prodip Ashfaq এবং Mohammad Kamrul Abedin Jitu-র সৌজন্যে কয়েকটা ছবি দিলাম। আমার একটা অনুরোধ – কারো যদি কোনো বিষয়ে কোনো কৌতুহল থাকে, তাহলে আমাকে refayet@yahoo.com ই-মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।
জাহাজে ঈদ – দৈনিক আজাদী (dainikazadi.net)
রেফায়েত ইবনে আমিন (২০ই), টলিডো, ওহাইও, ২০২২
refayet@yahoo.com
Recent Comments