[নোঙর 2016] খেলা : রাশেদ বিন কামাল (২৯)

[নোঙর 2016] খেলা : রাশেদ বিন কামাল (২৯)

১৯৫০ সালের ১৬ জুলাই। ব্রাজিল এর মারাকানা মাঠে বিশ্বকাপ ফুটবল এর শেষ ম্যাচ। ফাইনাল ম্যাচ হলেও সেটা ঠিক ফাইনাল ম্যাচ এর মত ছিলোনা। প্রথম পর্বের সেরা চার দল নিয়ে শেষ পর্বের খেলা হয়েছিলো সেবার। শেষ খেলা ছিল ব্রাজিল আর উরুগুয়ের মধ্যে। ব্রাজিল আগেই এক পয়েন্ট এগিয়ে থাকাতে, শেষ খেলায় ব্রাজিল এর শুধু এক পয়েন্ট দরকার ছিল। স্বাগতিক দেশ ফাইনাল এ, দরকার শুধু এক পয়েন্ট, মারাকানা ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। দর্শক সংখ্যা ছিল ১৯৯৮৫৪ জন। প্রত্যাশিত জয় শুধু সময়ের অপেক্ষা মনে হচ্ছিল, যখন বিরতির পরেই ব্রাজিল এক গোলে এগিয়ে গেলো। কিন্তু  উরুগুয়ে খেলাটা জিতে নেয় ২-১ গোলে। ব্রাজিলের দর্শকরা কোনভাবেই এ ফলাফল মেনে নিতে পারেনি। পরাজয়ের বেদনা এতটাই তীব্র ছিল যে, কয়েকজন দর্শক গ্যালারি থেকে নিচে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল।

এটা যেমন ছিল খেলা প্রেমীদের এক রূপ, তেমনি আরেক রূপ পৃথিবী অবলোকন করেছিলো ১৯৮৫ সালের ২৯ মে। লিভারপুল আর জুভেন্তাসের ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালের আগে, দর্শকদের মধ্যে মারামারিতে ৩৯ জনের প্রানহানি হয়েছিলো। খেলা শুরুর এক ঘণ্টা আগে, লিভারপুলের সমর্থকরা জোর করে জুভেন্তাসের দর্শক দের সীমানায় ঢুকে পড়ে। জুভেন্তাস দর্শক রা তখন পালিয়ে গ্যালারির ছাদে উঠে পড়ে। দর্শক দের হুড়াহুড়িতে ছাদ আর দেয়াল ভেঙ্গে পড়ে। ৩৯ জন প্রান হারানোর পাশাপাশি ৬০০ জনের মত আহত হয়েছিলো। অথচ সবাই সেদিন মাঠে গিয়েছিল খেলা উপভোগ করতে। কিন্তু কেন জানি খেলার মাঠ পরিনত হয়েছিলো এক যুদ্ধক্ষেত্রে যেখানে খেলোয়াড়রা লড়াই করতে নামার আগে, দর্শকদের যুদ্ধে হারিয়ে গিয়েছিল প্রায় অর্ধ শতাধিক প্রাণ।

খেলার মাঠের এমন উন্মাদনার হাজারো উদাহরণ আমরা দেখেছি। ১৯৯৬ বিশ্বকাপ ক্রিকেট এর সেমি ফাইনাল খেলা দর্শকদের জন্য পণ্ড হয়ে যায়। ভারত আর শ্রীলঙ্কার লড়াই চলছিল ফাইনালে জায়গা করে নেবার জন্য। স্বাগতিক ভারত জয়ের জন্য ছিল শতভাগ আশাবাদী। কিন্তু হুড়মুড় করে ভারতের ব্যাটিং লাইন আপ ভেঙ্গে যায়। আট উইকেট পড়ে যাবার পর, দর্শকদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। হাতের কাছে যা ছিল, তাই মাঠে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো। গ্যালারিতে আগুন জ্বালানো হল, খেলা পণ্ড হয়ে গেলো আর শ্রীলঙ্কাকে জয়ী ঘোষণা করা হলো। দর্শকদের উগ্র মানসিকতা যেমন দেখেছিলাম তেমনি দেখেছিলাম ভিনদ কাম্বলির চোখের পানি।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের চোখের পানি দেখেছিলাম ২০১২ সালের এশিয়া কাপ হেরে যাবার পর। তেমনি ২০১৪ এশিয়া কাপ এর বাংলাদেশ- পাকিস্তান খেলায় একদম মহিলা দর্শকদের বিলাপ করে কাঁদতে দেখেছি , বাংলাদেশ এর পরাজয়ে।

এই যে আশ্চর্য এক বন্ধনে দর্শকদের ওতপ্রত ভাবে জড়িয়ে ফেলে যে কোন খেলা, এটাই বোধ হয় খেলাধূলার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। দল, মত নির্বিশেষে কি এক আশ্চর্য বন্ধনে দর্শকদের এক সুতায় বেঁধে ফেলে খেলা! ছোট বেলা থেকেই খেলার উন্মাদনায় উত্তাল হয়ে জীবন চলার গতিরেখা নির্ধারণ করে যায় এই খেলার মায়া। ছোট বেলার খেলা দেখা ঘিরে সেই সব মধুর সৃতিময় দিনগুলি আজো যখন ভাবি, এক অদ্ভুত ভাল লাগা মন ছুঁয়ে যায়।

পছন্দের দলের খেলার দিন বাড়ির ছাদে পতাকা ওড়ানো, দলের জার্সি গায়ে সারাদিন ঘোরাঘুরি করা, খেলা শুরুর ৪/৫ ঘণ্টা আগে মাঠে গিয়ে পছন্দের যায়গা নিয়ে খেলা দেখতে বসা, বন্ধু-বান্ধবদের জন্য জায়গা দখল করে রাখা, খেলায় জিতলে ফকিরকে টাকা দেবার মানত করা, কায়মনো বাক্যে দলের সাফল্য কামনা করা, প্রিয় দল জিতে গেলে ঈদ ঈদ মনে হওয়া, খেলায় হেরে গেলে বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়া, খেলার পর ক্লাব এ গিয়ে প্লেয়ার দের সাথে কথা বলা, খেলে হেরে হতাশ হয়ে বিপক্ষ দলের দর্শক দের সাথে হাতা হাতি/ মারা মারি লাগানো, পুলিশ এর কাঁদানে গ্যাস খেয়ে পাগলের মত এদিক ওদিক ছুটে পানির খোঁজ করা, দিনে গুলিস্তান ক্রিকেট খেলা দেখে রাতে ফুটবল দেখার জন্য মিরপুর ছুটে যাওয়া, খেলা শেষে বাদুরের মত বাসে ঝুলে বাসায় ফেরা, দলবদলের সময় ক্লাব এ গিয়ে প্রিয় প্লেয়ারদের পাহারা দিয়ে রাখা- এমন অসংখ্য মধুর স্মৃতিতে কাটানো ছেলেবেলার দিনগুলি সত্যি জীবনের সেরা দিন হয়ে আছে। আজো বন্ধু বান্ধব মিলে বাংলাদেশ এর ক্রিকেট খেলা দেখতে বসলে সেই দিনগুলোর মাঝে ফিরে যাই আমরা। খেলা নিয়ে আমাদের এই উন্মাদনা এতোটুকুও কমেনি আর কখনই কমবেনা।

———————–

Rashed Bin Kamal 29
রাশেদ বিন কামাল (২৯): পড়াশোনা করেছেন বাংলাদেশ মেরীন একাডেমিতে। কাজ করছেন, BTS Tankers এ অপারেশনস ম্যানেজার হিসেবে।

Share