[নোঙর 2016] সিলি ফাউডার : গাজী আবু তাহের (১৭)
ফ্যডাগালপিয়ার পর বহুবার নানান বন্দরে মারুফ জাহাজ নিয়ে গেছে। উঠেছে নেমেছে নানা ধরনের কার্গো। কখনো জামার্নীর কীল ক্যানাল রেখে উঠে গেছে আরো উত্তরে শীতল বরফময় অক্ষাংশে। সী-টাইম ও হয়েছে সময়ের সাথে সাথে। প্রফেশনাল পরীক্ষা দিয়ে পাশ ও করেছে। এরই মধ্যে ছুটিতে থাকতেই মারুফ খবর পেল দু’মাসের একটা ভয়েজে তাকে যেতে হবে। খুব বেশী দিন হয়নি ওদের ঘর আলো করে প্রথম সন্তান এসেছে। নানান ব্যস্ততা। চীফ অফিসার পাওয়া যাচ্ছে না তাই সত্ত্বর তাকে চট্টগ্রামে পৌছানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিছুটা অবাক এবং অস্বস্তি হলেও কাজের খাতিরে ঐ দেড় মাসের ছেলেকে রেখেই অফিসে রির্পোট করল মারুফ। সাইন অন করার জন্য ৫/৬ সেট চিঠি টাইপ করা হয়েছে। ও পৌছাতেই দেখে আরো ২/৩ জন চীফ অফিসার জিএম সাহেবের কক্ষে ঢুকেছেন এবং অল্পক্ষনেই বেরিয়ে এসেছেন। সহকারী ব্যবস্থাপক ওকে আশ্বস্ত করলেন, মাত্র ২ মাসের ভয়েজ। কার্গো ডিসচার্জ করেই জাহাজ আবার চট্টগ্রামে ফিরে আসবে। জাহাজের সনদগুলো এক্সপায়ার হয়ে যাচ্ছে। ফিরতেই ডকিং সহ নানা মেরামতের কাজ আছে। আচমকা ওর পিঠেপিঠি ব্যাচের এক সিনিয়র ভাইয়ের সাথে দেখা। তাঁরও ডাক পড়েছিল তবে তিনি ও বের হয়ে এসেছেন কৃতকার্যতার সাথে। মারুফ বড়ই দ্বিধান্বিত হল এমন কি ঘটনা। চীফ অফিসার ভাই একটু আলাদা করে ডেকে বল্লেন, ‘রাজী হয়ো না একে বারে খাটারা জাহাজ আর কালই সেইল করবে’। ওর কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। যারা ঢুকলেন এবং বের হলেন সবাই জ্যাক পার্টি তার উপর ওর নামে চিঠি প্রস্তুত তাহলে ওনারা জিএম সাহেবের সাথে সাক্ষ্যাৎই বা করলেন কেন?
কিছুক্ষণ পর মারুফের ডাক পড়ল। মহাব্যবস্থাপক স্মরন করেছেন। প্রবেশ করতেই ওকে বলা হলো, ‘আমাদের জাহাজ সেইল করাতে হবে। তুমি চিন্তা করো না। জানি তোমার বাচ্চা ছোট, দু’মাস পরেই তোমাকে আবার ছুটিতে পাঠিয়ে দেব’। সিনিয়রের পন্থা অবলম্ব করে অসম্মতি জানিয়েও তেমন কোন কাজ হল না। সবই সেট করা।
দরজার বাইরে আসতেই ৫ সেট সাইন অন চিঠি ওর হতে ধরিয়ে দেয়া হল। অফিস থেকেই তাড়াতাড়ি করে বাসায় ফোন করার ব্যবস্থা করে দেয়া হল। করিডোরে ঐ জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং চীফ ইঞ্জিনিয়ারের সাথে দেখা, সবাই বড় সুহৃদ জন। চীফ ইঞ্জিনিয়ার ওকে ডেকে বল্লেন, ‘মন খারাপ করো না, দুই মাসেরই তো ব্যাপার। জাহাজ পুরানো তবে ক্রাউড চমৎকার। মনে করে বেশী বেশী সিমেন্টের বস্তা নিয়ে নিত্ত। এখনই বলে দাও’।
অপারেশন ডিপার্টমেন্টকে বলে সিমেন্টের ব্যবস্থা হল। অনেকটা ভি.আই.পির মত গাড়ীতে করে ওকে জাহাজে পৌছে দেয়া হল। শিপিং অফিসের কাজ শেষ করে। ভোর বেলায় পাইলট এলেন। দড়ি /কাছি খুলে শীতকালের শেষ ভাগে ওরা রওনা হল বন্দর ছেড়ে। চমৎকার সাগর, নিস্তব্ধ, নম্র। গন্তব্য লাতাকিয়া, সিরিয়া,। জাহাজে উঠার পরই মারুফ বুঝতে পারল কেন আগের চীফ অফিসার ইমার্জেন্সী ভাবে নেমে গেছেন। জাহাজ কেবল পুরানোই নয় নোংরাও বটে। শুরু হল পুর্নোদ্দমে সাফ সাফাইয়ের কাজ। কিন্তু তেমন বেশী কিছু হল না। ডেকে চিপিং করতে গিয়ে ছিদ্র বের হওয়া শুরু করল এবং সেগুলোকে বন্ধ ও করা হল। হ্যাচ কভার এবং হ্যাচ কোমিং এর ও একই অবস্থা। বঙ্গোপসাগরে দিনগুলো সুন্দর ভাবেই পার হয়ে গেল কিন্তু শ্রীলঙ্কার ডোন্ড্রার পর থেকে জাহাজের গতি ভীষনভাবে বিঘ্নিত হল। জাহাজ যেন চলেই না। কত দিন যে লাগবে সিরিয়া পৌছাতে! প্রতিদিন সন্ধ্যায়, ট্রাফিক না থাকলে ওরা তিন জন হাটাহাটি করে। বেশীর ভাগ সময়ে ডেকের উপর হাটে। প্রায়ই তড়িৎ প্রকৌশলী এসে যোগ দেয় তাতে করে চার জনের একটা স্কোয়াড হয়ে যায়। ডেকে কোন কার্গো না থাকায় নির্বিঘ্নে হাঁটা যায়।
জাহাজ পুরানো হলে সবাই যেন ঢিলা হয়ে যায়। সবাই রিল্যাস্কড। সুন্দর করে সূর্য উঠে সারাদিন আলো দিয়ে অস্তাচলে হারিয়ে যায়। এখন আর মিনিকয় দ্বীপের কাছে যাওয়া লাগে না। জি.পি.এস ই পথ বাতলে দেয়। ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করার দ্বিতীয় দিন থেকে শুরু হল বৃষ্টি-একেবারে জোরে সোরে। মারুফের মনে ভয় হয় – বৃষ্টির পানি হোল্ডের ভিতর যাচ্ছে না তো?
কপাল ভালো একদিন পরই বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল। ভেল্টিলেশন ও বন্ধ। ‘আদেন’ পর্যন্ত আর বৃষ্টি হয়নি। সাউন্ডিং অনুযায়ী প্রতিটা বিলজে বেশ পানি জমেছে। পানি বের করার পর একদিন যেতে না যেতেই আবারো পানি দেখা দিল। শঙ্কা বোধ হয় অসত্য নয়।
লোহিত সাগরে যেমন রোদ তেমনই উচ্চ তাপমাত্রা। হ্যাচের ভিতর ভ্যাপসা গরম,। সে দিনগুলোয় জলদস্যুদের উৎপাত ছিল না, তাহলে ওরাই হতো সবচেয়ে উপযুক্ত শিকার। অল্প ফ্রিবোর্ড তার উপর ধীর গতি। দরজা, পোর্টহোল সব খোলা। এসি তো দূরের কথা ফ্যান গুলো ও মৃতবৎ। এভাবে বিলজের পানি বের করতে করতে ওরা সুয়েজ প্রণালীর মুখে প্রবেশ করল। রেড সি থেকে এখানে ভিএইচএফ এ কোলাহল আরো বেশী। যাকে তাকে বানর আর খচ্চর বলে ডাক আর সাথে নানান ঢংয়ের গলার আওয়াজ। মারুফের ভোরের ওয়াচ চমৎকার কাটে। “রাসগরীব” পাড়ী দিয়ে ওরা সুয়েজ বহিঃনোঙরে এসে নোঙর করল। রফিকদের দল এরই ভিতর জাহাজের দুপাশে অবস্থান নিয়েছে। কি আপনজনের মত ডাকছে ভিএইচএফ এ-অবশ্য তাদের পরিচয় না দিয়ে। মারুফের পরিচিত এজেন্ট। প্রতিবারের মত এবার ও অনেক গুলো চিঠি পেল। পড়তে অনেক সময় লাগলো। প্রথমই তার শিশুর সংবাদ জানা প্রয়োজন । বাড়ীর সবাই ভালো জেনে আনন্দেই মারুফ কাজে মন দিলো। চমৎকার ভাবে সুয়েজ খাল পাড়ি দিয়ে ওরা লাতাকিয়া দিকে মুখ ঘুরালো। পথ আর বেশী বাকি নেই।
১৯৮৫ র পর বেশ কিছু বছর ঐ বন্দরে যায়নি মারুফ। অনেক স্মৃতিই ওর মনে ভীড় জমাতে লাগলো। তিন দিন পর লাতাফিয়ায় জাহাজ বাঁধা হল, অভিনব কৌশলে নোঙর ব্যবহার করে। কিছুটা ভীত কম্পিত মনে হ্যাচ কভার খুলবার জন্য সারেংকে হুকুম দিল মারুফ তার পর পরই সেও ডেকে হাজির হল। প্রচন্ড শব্দে পন্টুন গুলো খুলে ষ্ট্যাকিং পজিশনে যাচ্ছে। কার্গোর উপরের স্তরে কয়েক জায়গায় দাগ দাগ দেখা যাচ্ছে। আর পন্টুনের ধাক্কায় জং এবং ময়লা পড়তে থাকলো পাটের গাইটের উপর। একটা বার্জে করে এসে কার্গো খালাসের গ্যাং জাহাজে উঠল। বন্দরের ফেসিলিটির কোন পরিবর্তন হয়নি। প্রথম স্তর কার্গো খালাসের পর বাকি কার্গো পরিস্কার দেখে মারুফের মনে স্বস্তি ফিরে এল। ৪/৫ দিনের কার্গো অথচ সপ্তাহ চলে গেলে ও তেমন মালামাল খালাস হয়নি। সারাদিনে একটা বা দু’টা বার্জ আসে তার পর ছুটি। সবাই পরমানন্দে নিকটবর্তী শহরে যায়। সময় কাটায়। এভাবে তিন সপ্তাহ চলে গেল। কার্গো প্রায় পূর্ণ খালাসের পথে আর তখনই এলো সমস্যার দিন।
তিন নম্বর হোল্ডের শেষ দুই স্তরে পাটের বস্তা খালাসের সময় বৃষ্টির মত করে পানি ঝরাতে ঝরাতে গেল। কিছুক্ষন মাতার (আরবী ভাষায় বৃষ্টি) গুঞ্জনে সব কাজ বন্ধ হয়ে গেল। রিসিভার ভেজা পাট নেবে না। এক দিকে মাস পেরিয়ে যাবার অবস্থা অন্যদিকে জাহাজের সনদগুলো ও এক্সপায়ারের উপক্রম। সর্বদিকের চাপ আসতে শুরু করল। ক্যাপ্টেন সাহেবকে চিন্তিত মনে হল। তবে কি জাহাজ দেশে ফিরতে পারবে? এই সূদূর পথ আর সুয়েজ খালের খাজনা আদায় করে কি লাভ কোম্পানী গুনেছিল জানা নেই। কোর্টের আদেশ টাঙানো হল। আর মালামাল খালাস করা যাবে না। শুরু হল অফিস ও জাহাজের বার্তা আদান-প্রদান। আরো বেশী উদ্বিগ্ন, জাহাজ এর পর কোথায় যাবে? জাহাজ জেটিতে ভিড়ানো হল। একটু হতাশার ভাব বড়দের ভিতর, বিশেষ করে কিছু নাবিকদের, দেখা দিল। তরুন অফিসারদের মধ্যে অবশ্য তেমন কোন আলামত পাওয়া গেল না।
একদিন হঠাৎ করেই ভিজা পাটের বস্তা গুলো খালাসের কাজ শুরু হল তবে তা জোটির পাশে সারি করে রাখা হল। রোদের তাপে সব শুকিয়ে গেছিল বটে তবে দু’একটা পেটি খুলে দেখা গেল স্থায়ী দাগ লেগে আছে।
এরই মধ্যে মারুফ একদিন একা জাহাজে। ডিউটি অফিসার এসে জানালো মেরিন কোর্টের লোকজন এসেছে। ক্যাপ্টেন সাহেব কিনারায় গেছেন চীফ ইঞ্জিনিয়ার সহ। ওর কেবিনে সবাই এলেন। বাটলারকে ডেকে রবিবারের মেনু অনুযায়ী খাবার তৈরী করতে নির্দেশ দিয়া হল। মোবাইল কোর্ট বসল। একটা চিঠি মারুফকে দেয়া হল। এজেন্ট সহ তারা এসেছেন তাই তেমন ভয় করছে না ওর। এটা বোঝা যাচ্ছে একটা দফা রফা হয়ে যাবে আজ। এজলাস বসল তথাকথিত চীফ অফিসারের ডেক অফিসে। অন্য একটা কেবিন থেকে অতিরিক্ত ফ্যান লাগিয়ে বাতাসের ব্যবস্থা হল। সিরিয়ানদের গায়ের রং অসাধারন। ফর্সা আর গোলাপীর মাঝামাঝি তার উপর ৪ জনই কালো স্যুট পরে এসেছেন। একজন মারুফকে একটা কাগজ বের করে জোরে জোরে পড়তে বলেন। মারুফ এসব সিনেমায় দেখেছে আজ নিজেই বাস্তবে বলল। জাহাজের সব সাটিফিকেট বেশ ধৈর্য্যরে সাথেই তারা দেখলেন। অফিসিয়াল লগ বইয়ের প্রতিটি পাতা চেক করলেন। কিছু কিছু নোট করলেন আজকের দিন হলে একটা মোবাইল কল দিয়েই ক্যাপ্টেন সাহেব কে পাওয়া যেত ফটো কপিয়ার থাকলে সহজেই কপি করে দেয়া যেত!
এরই মধ্যে দুপুর বারোটা বাজল। চা-কফি সাধা হয়েছিল কিন্তু এ যাবৎ কোন কিছুই তাঁরা ছুঁয়ে দেখেন নি। খুব কাচুমুচু হয়ে মারুফ বলল, যার বাংলা অর্থ, “আজ এত বড় একটা ঘটনা এই জাহাজের ইতিহাসে। স্বয়ং বিচারক সহ কত সম্মানিত ব্যাক্তিগন উপস্থিত। আমাদের কৃষ্টিতে কোন মেহমানকে খলি মুখে যেতে দেয়া হয় না”। যদি এর ভিতরে বস শোর থেকে ফিরে আসতেন! বাটলারকে উনাদের সামনে ডাকানো হল (পূর্ব পরিকল্পিত)
– What have you prepared for lunch?
– Sikin Tikka, Fee Folau, Fafadam, tidbit
– What is Sikin Tikka? একজন জিজ্ঞেস করলেন।
মারুফের পেট ফেটে যাবার উপক্রম। ও অতিথিদের বুঝিয়ে বল্ল এটা মুরগীর এক মজাদার আয়োজন। খুবই সুস্বাদু যা সারা জীবন ওনাদের মনে থাকবে। উপরের মেন্যু সম্পর্কে তাদের কোন ধারনাই নাই। এজেন্ট তাদের বুঝিয়ে বলার পর মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন হল। তারা বেশ তৃপ্তির সাথেই খেলেন। কিছু ডকুমেন্টের অনুলিপি লাগবে এর মধ্যে সেগুলো টাইপ করা হয়ে গেছে এবং সীল মোহর দিয়ে এজেন্ট নিজের কাছে রাখলেন। মারুফকে জানালেন জাহাজ রিলিজড তবে ক্যাপ্টেন সাহেবের সই লাগবে এবং তা পরে নিলেও চলবে।
বাংলাদেশের চা পাতা বিখ্যাত তাই একটা করে চা পাতার বাক্স দিতে বলল মারুফ। বাটলারে সামনেই মেহমানদের জিঞ্জেস করল –
– How did you like the food?
– Very delicious
এতদিনে এ অঞ্চলের লোকজনও ঝাল খাওয়া শিখে ফেলেছে।
– Thank You. Do you mind if I present you some spices from Bangladesh?
একজন উঠতে উঠতে জিজ্ঞাসা করলেন –
– What kind of spice?
বাটলার একটু হাত কচলাতে কচলাতে বলল –
– I have Silly Fauder
সমবেত ভাবে আওয়াজ শোনা গেল –
– W H A A A A T ????
———————————————
গাজী আবু তাহের (১৭): একজন নৈমিত্তিক লেখক। চারপাশে যা ঘটে তা থেকেই জীবনের আনন্দ খোঁজার চেষ্টা করেন। নাবিক জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সমুদ্র যাত্রার অভিজ্ঞতা নিয়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ‘প্রবাস থেকে’ কলামে নিয়মিত লিখতেন।
Recent Comments