[নোঙর 2016] বাংলা ওয়াশ : হারুন অর রশীদ (২১)

[নোঙর 2016] বাংলা ওয়াশ : হারুন অর রশীদ (২১)

বাংলাদেশ ইন্ডিয়া সেকেন্ড ওয়ান ডে। তিন খেলার সিরিজে বাংলাদেশ
১-০ এ এগিয়ে আছে। খেলাটা খুবই গুরুত্বপুর্ন। বাংলা ওয়াশ করতে
হলে আজ জিততেই হবে। হাবিব বাদাম, চিপস, কোক সব কিনে মজুদ করেছে। খেলা শুরু হলে খাবে। কোনটা কখন খাবে তা ঠিক করাই আছে। বাংলাদেশ ব্যাটিং পেলে চিপস দিয়ে শুরু করবে আর ফিল্ডিং পেলে বাদাম দিয়ে।

আম্পায়ার মাঠের অবস্থা জানিয়ে দিচ্ছে মানে এক্ষুনি টস হবে। টস হল। বাংলাদেশ টসে হারল। টসে জিতে বড় একটা স্কোর ছুড়ে দিলে খেলাটা জমত। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাদামের প্যাকেটটা নিতে গিয়ে দেখল তা নেই।

: বাদামটা আবার কে নিল?
দরজা খুলে বের হল তার এ লেভেল পড়–য়া ছেলে হিমু। হাতে বাদামের প্যাকেট।
: এত রাতে বাদাম চিবুচ্ছিস কেন?
: ইপিএল (ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ) দেখছি ড্যাড।
: ফ্রি টিভিটা তোর রুমে লাগানোই ভুল হয়েছে।
: হোয়াটস রং ড্যাড?
: দেশের ছেলে ক্রিকেট দেখবি। তা না কি সব ইপিএল দেখছিস?
হিমু এসে বাদামের প্যাকেটটা হাতে দিল।
: ক্রিকেটের জন্মও কিন্তু ইংল্যান্ডেই ড্যাড।
: যা গিয়ে তোর ইপিএল দেখ আর আমাকে খেলাটা দেখতে দে।
প্রথম ওভারেই উইকেট। হাবিব আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠল। এবার দরজা খুলে বের হল মিনা।
: এসে দেখ বাংলার দামাল ছেলেরা কি করছে?
: তুমি দেখ আর আমাকে ঘুমাতে দাও।
: রাত জেগে যখন হিন্দি সিরিয়াল দেখ তখন ঘুম কোথায় থাকে?
: একটু পর সকাল হবে। প্লীজ ঘুমাতে দাও।
: সকাল বেলা কে অফিস যাবে?  তুমি না আমি?
মিনা তার উত্তর না দিয়ে ধাম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। খেলাটা এতই জমেছে যে হাবিব খাওয়ার সিকুয়েন্স ভুলে হাতের কাছে যা পেল তাই খেল। বাদাম চিপস দুটোই শেষ। কোকে শেষ চুমুক দিয়ে ফোন দিল মামুনকে।
: গভীর রাতে ফোন পেয়ে মামুনের বুকটা ধক করে উঠল।
: রাত কটা বাজে জানিস?
: অফকোর্স জানি। কিন্তু আমি যা জানি তা তুই জানিস না।
মামুন চুপ করে আছে।
: আমরা জিতেছি দোস্ত। তার মানে শেষ খেলাটায় জিতলেই বাংলা ওয়াশ। লিকলিকে ছেলেটা যা বোলিং করল। কি যেন নাম ছেলেটার?
: মোস্তাফিজুর।
: নামটা দেখি ভালই মনে রেখেছিস।
: যে কাটার মারে, মনে না রেখে উপায় আছে?
: ও ক্রিকেট দুনিয়াকে একটা ম্যাসেজ দিল। আমাদেরকে আন্ডার ইস্টিমেট করার দিন শেষ দোস্ত।
: খবরটা সকালে জানালেও পারতিস।
: আনন্দের খবর সাথে সাথে দিতে হয়। এ মুহুর্তে তোকে ছাড়া আর কাউকে দেয়ার মানুষ পাচ্ছিলাম না।
: ভাবীকে দিতি।
: ওকে দিতে যাওয়া মানে নিজের মজাটা কমানো।
: খুব ভাল করেছিস। এখন ঘুমা। বলে মামুন লাইনটা কেটে দিল।
হাবিব ঘুমাতে গিয়ে দেখল দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ।
: মিনা দরজাটা খোল।
: ঘুমানোর দরকার নাই। ক্রিকেট নিয়েই থাক।
: ক্রিকেট না দেখে কি করব? হিন্দী সিরিয়াল দেখব? কারিশমা আণুশকার ফ্যান সাজব? সেটাওতো লাইক করবে না।
মিনার কোন আওয়াজ নেই।
: কাল তোমাকে হানিফায় নিয়ে যাব। একটা না দুই দুইটা শাড়ি কিনে দেব।
: সকালবেলা সুর পাল্টাবে। তোমাকে আমি চিনি।
মিনার দরজা খোলার কোন নামগন্ধ নেই। হাবিব ছেলের রুমে এল। টিভি বন্ধ। হিমু ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়ছে।
: কি এত রাত জেগে পড়িস? তোর বয়সে নটা বাজলেই বিছানায় যেতাম। বেনজামিন ফ্রাংকলিনের সেই বাণীটা ফলো করবি। আর্লি টু বেড অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ, মেকস এ মেন হেলদি, ওয়েলদি অ্যান্ড ওয়াইজ।
: ড্যাড আমি পড়ছি। আর তুমিতো রাত জেগে খেলা দেখছ। ঘুম জিনিসটা তোমার বয়সে বেশী দরকার।
: ট্রু। ফ্রাংকলিন দেশের প্রেসিডেন্ট না হয়েও মার্কিন ডলারে জায়গা পেয়েছে। কাজে ও যা বলেছে তার গুরুত্ব অনেক। তাকে কেউই পাত্তা দিচ্ছি না। বলে বিছানাটায় শুয়ে পড়ল।
: এখানে শুচ্ছ যে?
: মিনা ভুল করে দরজাটা লক করেছে। মাঝপথে ঘুম ভাঙলে বাকী রাতটা আর কাউকেই আর ঘুমাতে দেবে না।

হাবিবের মোবাইলে ফোন এল।
: ইয়েস চীফ। হোয়াট হ্যাপেনড?
: স্যার ইঞ্জিন কান্ট স্টার্ট। পাইলট ইজ বোর্ডিং ইন এন আওয়ার। প্লীজ অ্যারেঞ্জ রিপেয়ার।
: ডিড ইউ চেক, এয়ার অ্যান্ড ফুয়েল? ইজ এয়ার কামিং আউট ফ্রম অল দা ইন্ডিকেটর ককস?
: নট চেকড স্যার।
: চেক অ্যান্ড কল মী। বলে লাইনটা কেটে দিল।

: কে যে একে চীফ ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছে কে জানে?
: তোমার চাকুরীটা অদ্ভুদ। ফোন আসার কোন নিয়ম কানুন নেই।
: নিয়ম কানুন কখনই ছিল না। আমিওতো চীফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলাম। শক্ত কারন ছাড়া কখনই অফিসকে ফোন দেইনি। আর এখনকার চীফ ইঞ্জিনিয়াররা? একটা কাজই ভাল জানে। বাটন টিপে ফোন দেয়া। এক পোলিশ চীফ ইঞ্জিনিয়ার বলত ক্যাপ্টেনদের মগজের দাম সবচেয়ে বেশী। কারন ওদের মগজগুলো আনইউজড। এখন মনে হচ্ছে চীফ ইঞ্জিনিয়ারদের মগজের দাম ক্যাপ্টেনদের মগজের দামকে ছাড়িয়ে গেছে। হা হা হা।
: ওভাবে হাসছ কেন?
: না হেসে প্রেসারটা বাড়াব? তাহলে কাল মেডিকেল লিভ নিতে হবে। মেডিকেল লিভ নিয়েই বা কি? অফিসটাতো পিছু ছাড়বে না। বলে মোবাইলটা টেবিলে রাখল।

হিমু বই খাতা নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
: কোথায় যাচ্ছিস?
: ড্রয়িং রুমে।
: এখানেই শুতে পারবি। বলে হাবিব এক পাশে সরে গেল।
: তোমার নাক ডাকার শব্দে পড়া ঘুম কোনটাই হবে না। তারচেয়ে তুমি আরাম করে ঘুমাও।

হিমু বাতিটা নেভাল। “গুড নাইট ড্যাড” বলে শব্দ না হয় এমনভাবে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
পরদিন ঘুমঘুম ভাব নিয়ে হাবিব অফিসে এল।
সেক্রেটারি জেনী মেয়েটি বলল, ইউ লুক টায়ার্ড। ডিন্ট ইউ স্লীপ লাস্ট নাইট?
: স্লেপ্ট অ্যাট টু।

জেনী অবাক চোখে তাকাল।
: হোয়াট ডিই ইউ ডু টিল টু?
: ওয়াচড ক্রিকেট।
: হোয়াট ইজ দ্যাট?
: এ গেম। কাইন্ড অফ আমেরিকান বেস বল।
: ইউ মাস্ট বী ক্রেজি ফর ইট?
: ইয়েস। উই বিট ইন্ডিয়া লাস্ট নাইট।

ইন্ডিয়ান সুপারইন্টেন্ডেন্ট অজিত খানিক দুরে বসলেও সব শুনছে। হাবিব একটু জোরেই বলছে যাতে ও শোনে। ইন্ডিয়া জিতলে অজিতের ফুর্তি কে দেখে। আর সেটা টাইগারদের সাথে হলে সেদিন অফিসে টেকা দায়।

বসের রুমে গেল। সেখান থেকে বের হয়ে অজিতের টেবিলে এল।
: দাদা, কাল একটু দেশে যাচ্ছি।
: এইতো কদিন আগেই গেলেন। আবার কেন যাবেন?
: এবার যাব বাংলা ওয়াশ দেখতে।
: লাভ হবে না দাদা। আমাদের ছেলেরা মোস্তাফিজের ট্রিকস বুঝে গেছে। এবার শুধু চার ছক্কা মারবে।
: উইল সী। বলে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল।

বাসায় ফিরে মামুনকে ফোন দিল।
: দোস্ত একটা গুড নিউজ আছে।
: আজতো খেলা নেই। আজ আবার কিসের নিউজ দিবি?
: খেলা পরশু। দেখার জন্য দেশে যাচ্ছি।
: কদিন আগেই না দেশ থেকে এলি?
: ডাক্তার বন্ধু টিকেট পাঠিয়েছে। না করতে পারলাম না।
: এতো দেখি রবিনসনের ভাউচার পাওয়ার মত। ভাউচার পঞ্চাশ টাকার। তাকে উসুল করার জন্য পকেট থেকে খরচ আরও পাঁচশ।
: ভাউচার পাওয়া সহজ দোস্ত। কিন্তু পয়সা দিলেই টিকেট পাওয়া যায় না।
: ট্রু। কোন ফ্লাইটে যাচ্ছিস?
: বিমান।
: উইস ইউ এ সেফ জার্নি। বলে মামুন লাইনটা কেটে দিল।

পরদিন ব্যাগ নিয়ে চেক ইন কাউন্টারে আসতেই মামুন এসে হাজির।
: কষ্ট করতে আসতে গেলি কেন?
: এটা বলার জন্য যে টাইগাররা জিতলে ফোন দিস। রাত যতই হোক।
: “তার আর দরকার হবে না”, বলে পেছনে তাকাতে বলল।
মামুন ঘুরে দেখল মিনা ভাবী দাঁড়িয়ে, “ভাবী আপনিও যাচ্ছেন নাকি?”
মিনা মাথা নেড়ে হ্যা বলল। হাবিব ব্যাগগুলো নিয়ে কাউন্টারে গেল।
এই ফাঁকে মামুন বলল, “শেষমেষ আপনাকে পটাতে পারল”?
: না গিয়ে কি করি বলুন? এমন সব কান্ড করে এখানে থাকলে দু:শ্চিন্তার মধ্যে থাকব।
মামুন তাকিয়ে আছে।
: গত ছুটিতে চিটাগাং যাচ্ছি। হঠাৎ বাসটাকে রাস্তার পাশে থামাল। মসজিদে জোহরের নামাজ পড়বে। সাথে দুই চারজনকে পেয়েও গেল।
: নামাজ পড়েছে খারাপ কিছুতো করেনি।
: আপনি বন্ধু মানুষ বলেই ভাল কাজকে ভাল চোখে দেখছেন। দেশে খারাপ মানুষের অভাব নেই।
: স্টেডিয়ামে বসে যদি কোন পাগলামি করে? মাইকে আজান হলে যদি খেলা বন্ধ করতে বলে?
: ওকে যতটা পাগল ভাবেন ও ততটা পাগল নয় ভাবী। একটু খেলা পাগল এই আর কি।

হাবিব লাগেজ দিয়ে ফিরে এল।
: খুব এক্সাইটেড দোস্ত। এই প্রথম স্টেডিয়ামে বসে টাইগারদেরকে খুব কাছ থেকে দেখব।
মামুন একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বল, “এটা রাখ”।
: কি আছে এতে?
: বাইনোকুলার। এটা দিয়ে ওদেরকে আরও কাছে দেখতে পারবি।
: থ্যাংক ইউ দোস্ত।
: রাত যতই হোক। রেজাল্ট জানাতে ফোন দিস।
: “তার আর দরকার হবে না। আনন্দ শেয়ার করার জন্য ইনি আছেন”, বলে মিনাকে দেখাল।
: “জিতলে ঠিক আছে। হেরে গেলে কিন্তু তার ভাগ নিতে পারব না”, বলে মিনা হাসল।

ওরা সিকিউরিটি পেরিয়ে ভেতরে গেল। মামুন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। হাবিবের মোবাইলটা বেজে উঠল।
হিমু করেছে।
: যা বলার তাড়াতাড়ি বল। এক্ষুনি ইমিগ্রেশনে যাব।
: কাল ইপিএল বাদ দিয়ে ক্রিকেট দেখব ড্যাড।
: এই না হল বাপকা বেটা।
: মাকে একটা ব্যানার দিয়েছি। গ্যালারিতে বসে ওটা হাতে ধরে রেখ। তাহলে তোমাদেরকে আইডেন্টিফাই করা সহজ হবে।
: উই উইল। ইউ টেক কেয়ার। বলে লাইনটা কেটে দিল।

মনটা খুশীতে ভরে উঠল। পেছন ফিরে দেখল মামুন দাঁড়িয়ে আছে। বাই বাই দিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল।
—————————

Harun Or Rashid 21

হারুন অর রশীদ (২১): তার লেখা উপন্যাস “জগৎ সংসারে” বইমেলা ২০০৭ এ প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে প্রকাশিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম, রোদ কুয়াশার দিন, দুরে যাওয়া কাছে পাওয়ার গল্প, ক্রসফায়ার কেচ্ছা, দেশ থেকে প্রবাসে। তার সর্বশেষ উপন্যাস “প্রবাসে নাকি নরকে”, বইমেলা ২০১৫ এ সময় প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়। মানুষের সুখ দুখ, হাসি কান্নার সাদামাটা কাহিনী নিয়েই রচিত তার এসব উপন্যাস। পাঠকের অনুভুতিতে ছোঁয়া দেবার কেবলি এক প্রয়াস।  

Share