Remembering Life on board Banglar Moni – Refayet Amin (20E)

Remembering Life on board Banglar Moni – Refayet Amin (20E)

২০২০ সালে কোভিডের সময়ে মেসেঞ্জারে আমার সঙ্গে কথোপকথন -“স্যার, আমাকে মনে আছে? আমি আহসান, ইংল্যান্ডে থাকি। বাংলার মনি জাহাজে আপনি সেকেন্ড-ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, তখন আমি প্রথম জাহাজে জয়েন করেছিলাম ডেক-ক্যাডেট হিসাবে। আমি নিজেই এখন অনেক বছর হলো ক্যাপ্টেন; রিটায়ারও করবো অতিসত্বর। কিন্তু একটা কারণে আপনাকে এখনো মনে আছে – আমার এত বছরের সী-লাইফে আপনিই একমাত্র মেরিনার, যিনি কিংবদন্তীর মত নিজের বিয়ে নিজেই মিস্‌ করতে যাচ্ছিলেন”।

আলবৎ মনে আছে! কথাটা খুব বেশী ভুল বলে নাই বা বাড়িয়েও বলে নাই। সেরকমই হতে যাচ্ছিলো আমার কপালে। ১৯৯১-এর অক্টোবরে এন্‌গেজমেন্ট করে জাহাজে মাস পাঁচেক কাটিয়ে এসেছি। মানসিকভাবে বেশ কষ্টের ব্যাপারই বটে। এতদিন বাবা-মা-ভাইদের ছেড়ে থাকতে একধরেনের কষ্ট হতো; এখন যুক্ত হয়েছে বিশেষ আরেকজন। তাই ঠিক করলাম, বিএসসির জাহাজেই কাজ করি কয়েকটা মাস। বাংলাদেশী জাহাজ, তাই চট্টগ্রামে তো প্রায়ই আসবে, আমিও ঘনঘন বাসায় যেতে পারবো (নিজবাসা ও হবু-শ্বশুরের বাসা – দুইটাই চট্টগ্রামে)। কন্ট্রাক্ট শেষে বিয়ে করে দুজনে ইংল্যান্ডে যাবো – হানিমুনও হবে; আর চীফ-ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রীটাও নিবো। চরম ভুল হয়েছিলো – পুরা ধরা খাচ্ছিলাম।

১৯৯২-এর জুলাইতে বোম্বেতে বিএসসি-র জাহাজ, এম.ভি. বাংলার মনিতে উঠলাম। ছয় মাসেরও বেশী ছিলাম; আফ্‌সোস! একবারও চট্টগ্রামে এলোনা। বোম্বে থেকে করাচীতে এলাম। এই আমার প্রথম পাকিস্তানে আসা। আব্বা গ্ল্যাক্সোর চীফ-ক্যামিস্ট হিসাবে, ১৯৬০-এর দশকে বেশ কয়েকবছর করাচীতে ছিলেন। আমার তিনভাইয়ের জন্মও সেখানে। আব্বা-আম্মা যেরকম সুন্দর করাচীর কথা বলতেন, সেরকম কিছুই দেখলাম না। ভীষণ নোংরা, মানুষে-গাড়িতে গিজগিজে শহর। সেখানে অন্য আরেকটা বিএসসি-র জাহাজ ছিলো, আমরা কয়েকজনে মিলে ঘুরতাম শহরে। একটাই ভালো কাজ করতে পেরেছিলাম – সকলের সুপরামর্শে সেখান থেকে খুবই সুন্দর, ভারী ও দামী একটা লেহেঙ্গা কিনে ফেলেছিলাম – নিজের বিয়ের বাজারের ধারাবাহিকতা। পরে অনুষ্ঠানে সেই লেহেঙ্গা অবশ্য খুবই প্রশংসা কুড়িয়েছিলো।

করাচী থেকে আরব-সাগর ও ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের বন্দরগুলোতে গেলাম – কেনিয়ার মোম্বাসা, তাঞ্জানিয়ার দার-এস-সালাম, জাঞ্জিবার। সেখানে কর্মরত প্রচুর ভারতীয় এবং কিছু কিছু বাংলাদেশীদের সঙ্গেও দেখা-সাক্ষাৎ হলো। বাংলাদেশী এক পরিবার আমাদেরকে তাদের বাসায় দাওয়াত দিয়ে খাইয়েছিলেনও। জাঞ্জিবার ও দার-এস-সালামে এখনো মানব-ইতিহাসের কালো-অধ্যায়ের ভয়ঙ্কর স্মৃতি হিসাবে রয়েছে ক্রীতদাস বেচা-কেনার বাজার।

কেনিয়া, তাঞ্জানিয়ার উত্তরেই রয়েছে সোমালিয়া। গত বিশ-পঁচিশ বছর ধরে সেখানে চলছে জলদস্যুদের ত্রাসের রাজত্ব। ওদের সীমানার আশেপাশে যে কোনো জাহাজ গেলেই, আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দ্রুতগামী স্পীডবোটে এসে জাহাজ আক্রমণ করে, আটক করে মুক্তিপণ আদায় করে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক জাহাজের ক্ষতি হয়েছে, মেরিনাররা মারা গেছে বা আহত হয়েছে। অনেকেই বন্দীদশা কাটিয়েছে। তবে ১৯৯১/৯২-এর দিকে তেমন উপদ্রব ছিলো না; তাহলে আমরাও নিরাপদে সেখান দিয়ে যেতে পারতাম না। সেসময়ে ইন্দোনেশিয়া-মালেশিয়া-সিঙ্গাপুরের মালাক্কা-স্ট্রেইটে জলদস্যু বেশী ছিলো। আমি অবশ্য নিজদেশে, মংলা-বন্দরে জলদস্যুদের আক্রমণে পড়েছিলাম। একদম দিনের আলোয়, বেলা তিনটা-চারটার দিকে। সুন্দরবনের দিক থেকে দেশী নৌকায় চড়ে এসেছিলো। আমরা হাতের কাছের ভারী যন্ত্রপাতি, লাঠি-সোটা নিয়ে ধাওয়া শুরু করলে, তারা আশী-একশ’ফুট উঁচু থেকে ঝাঁপ দিয়ে পানিতে পড়ে সাঁতরে পালিয়ে গিয়েছিলো।

যাহোক, আবারো বাংলার মনি জাহাজে ফিরে আসি। এটা ১৯৮৩-তে জার্মানীতে তৈরী জেনারেল কার্গো জাহাজ। আমরা যখন মেরিন একাডেমীতে পড়ছি, তখন বিএসসি এই ঝকঝকে নতুন জাহাজ কিনেছিলো। আমরা পূর্ব-আফ্রিকার দেশগুলো ছেড়ে ইয়েমেনের আল-হুদাইদাহ, এডেন, আল-মুকাল্লা বন্দরে গেলাম। সেখান থেকে ওমানের সালালাহ্‌ হয়ে দুবাই হয়ে ইরানের বন্দর-আব্বাস ও বন্দর-ইমাম-খোমেনী। ইয়েমেনে বেশী কিছু করার নাই, সেখানের হোটেলের গরম কাবাব-রুটির কথা মনে পড়ে। আর একটা জিনিস খুব চোখে পড়েছিলো – তাদের বিল্ডিং-এর স্ট্রাকচারগুলো। আমার কাছে মনে হতো ক্বুরআনে বর্ণিত পাহাড়ের গায়ে মাটির তৈরী আবাস্থসলের মত – এটা সম্পূর্ণ আমার মতামত। এখন নিশ্চয়ই অনেক উন্নত বিল্ডিং তৈরী হয়েছে; যদিও সেখানে গৃহযুদ্ধ চলছে গত কয়েক বছর ধরে।

দুবাইতে আমার চেনা-পরিচিত এক পরিবার থাকেন – ডাঃ আতিয়ার রহমান ও ডাঃ শামস রহমান। শামস আপার আব্বা-আম্মা চট্টগ্রামে আমাদের প্রতিবেশী। আগেও প্রচুর ওনাদের বাসায় গিয়েছি। আবারো গেলাম ওনাদের সঙ্গে দেখা করতে। খুবই খুশী হলেন। ওনারা ১৬ই ডিসেম্বরের স্থানীয় এক অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন; আমিও গেলাম। সুন্দর একটা সন্ধ্যা কাটালো প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাঝে। এরপরে, বন্দর-আব্বাসে, ছয়-সাতদিন একনাগাড়ে থাকার কারণে সেখানেও অনেক ঘুরেছি। আবারো একটা বাংলাদেশী জাহাজ পেয়েছিলাম – আমরা সকলে একসঙ্গে বের হতাম, ঘুরে বেড়াতাম, পালা করে দুই জাহাজে দাওয়াত খাওয়া হতো। খুব মজাতেই দিন কাটছিলো।

অফিস থেকে খবর এলো সৌদি আরবের জেদ্দা ও জর্ডানের আকাবা যেতে হবে। আমার আবার এদিকে বাসায় ফেরার সময় এসে যাচ্ছে। পাঁচমাস কাজ করলেই প্রয়োজনীয় সী-টাইম হয়ে যাবে চীফ-ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষার জন্যে। সেই হিসাবে প্ল্যানও করেছিলাম এবং বিএসসি-র সঙ্গে কন্ট্রাক্টও করেছিলাম পাঁচমাসের। জাহাজে সাধারণতঃ দু-একসপ্তাহ এদিক-ওদিক হয়, কিন্তু এখন পাঁচমাসের অনেক বেশীই হয়ে যাচ্ছে। দেশে সকলে আমার কাছে ফেরার তারিখ জানতে চায় – তাহলে সেই মত বিয়ে-বৌভাত ইত্যাদির তারিখ ঠিক করবে, কার্ড ছাপাবে, হল ভাড়া করবে। কিছুই করা যাচ্ছে না। কারণ, আমি নিজেই জানিনা কবে, কোথা থেকে ফেরত যাবো। আমি বারেবারে চট্টগ্রামের অফিসে মেসেজে তাগাদা পাঠাতে থাকলাম, সত্বর আমাকে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করার জন্যে। উত্তর দেয় না। লোকমুখে শুনি, আমার বদলী বা রিলিভার কোনো সেকেন্ড-ইঞ্জিনিয়ার পাওয়া যাচ্ছে না।

এদিকে জাহাজ পার্সীয়ান-গালফ থেকে হরমুজ-প্রণালী দিয়ে বের হয়ে গাল্‌ফ-অফ-ওমানে পড়লো। সেখান থেকে আরব সাগর ধরে গালফ-অফ-এডেন হয়ে“দুঃখের দরজা”বা বাব-আল-মান্দাব (Bab-al-Mandeb) দিয়ে লোহিত সাগরে। এখানে আদিযুগে প্রচুর নাবিক মৃত্যুবরণ করেছিলো বলে এই নামকরন। আবার ধারনা করা হয়, এক প্রচন্ড ভূমিকম্পে অনেকেই মারা গিয়েছিলো – সেই থেকেই এই নাম। জেদ্দায়ও দুইতিনদিন ছিলাম। অনেকবার সেদেশে গিয়েছি – জাহাজে করে কয়েকবার, পরবর্তীতে অ্যামেরিকায় কাজ করার সময়েও কয়েকটা বিজনেস-ট্রিপে, এছাড়া হজ্জ্ব-ঊমরাহও করেছি কয়েকবার। কিন্তু কখনই সৌদি সিস্টেম ও সেখানের কিছু কিছু মানুষকে (কাস্টম্‌স্‌-ইমিগ্রেশান-পুলিশ-সরকার) একদমই পছন্দ হয়নাই। বন্দরে জাহাজ ভিড়লেই একজন আর্ম্‌ড্‌-গার্ড জাহাজের সিড়ি বা গ্যাংওয়ের সাথে চব্বিশ ঘন্টা থাকবে। কাউকেই নামতে দিবে না। এমনকি, আমাদের অতি প্রয়োজনীয় ইনফরমেশান – পানির উপরে জাহাজের উচ্চতা (ড্রাফ্‌ট্‌) মাপার জন্যে ডিউটি অফিসারকেও না। মনে হতো সাদা চামড়াদের জন্যে তাদের আইন শিথিল; কিন্তু এশিয়ান, বিশেষ করে উপমহাদেশীয়দের জন্যে ভিন্ন ও কঠোর আইন। আমরা শিক্ষিত অফিসারেরা এধরনের বৈষম্য বুঝতাম। আমি সেখান থেকে দেশে ফেরার আশা করতেও পারি না।

জেদ্দা থেকে রওনা দিলাম রেড-সী ধরে। মিশরের রিসোর্ট শার্ম-এল-শেইখের কাছে ইংরেজি Y অক্ষরের মত দুইদিকে দুইটা নৌপথ চলে যায়। উত্তর-পশ্চিমে গালফ-অফ-সুয়েজ দিয়ে সুয়েজ ক্যানালে পৌঁছাবেন। আমরা ডানপাশেরটা, মানে উত্তর-পূর্বদিকে গালফ-অফ-আকাবা ধরে আকাবা বন্দরে এলাম। জর্ডান আর ইস্রায়েল কিন্তু অনেক লম্বা বর্ডার শেয়ার করে। ম্যাপে যদি আকাবা খুঁজে দেখেন, দেখবেন যে, এর ঠিক উল্টাপাশে, দুই-তিন মাইল পশ্চিমেই ইস্রায়েলের এইলাত (Eilat) বন্দর। আমরা আকাবা থেকেই তাদের শহরের গাড়ি-ঘোড়া, লাইট সব দেখতে পারছিলাম। আকাবাও বেশ উন্নত শহর।

যাহোক, আকাবাতে এসে শুনি আমার বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলেছে; অথচ আমি নিজেই জানিনা যেতে পারবো কিনা। অফিস থেকে আমার রিলিভার হিসাবে একজনের নাম দিয়েছিলো, কিন্তু তার এতই সুনাম(!) যে, আমাদের জাহাজের চীফ-ইঞ্জিনিয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে নাকচ করে দিয়েছিলেন। এবারে আমাকে একটু কঠোরতার আশ্রয় নিতে হলো। আমার রিলিভার অযোগ্য, সে কাজ পারে না, ঝামেলা হয়, সেটা আমার মাথাব্যথা হবে কেন? আমার বিয়ের তারিখ, ইংল্যান্ডে যাওয়ার তারিখ সব ঠিক হয়ে গেছে। আমাকে নামাতেই হবে। অনেক আলাপ-আলোচনার পরে সমঝোতা হলো। ঠিক হলো, সেই রিলিভারকে আনা হবে না; বিকল্প হিসাবে জাহাজের বর্তমান যে সমস্ত জুনিয়ার-ইঞ্জিনিয়াররা আছে, তাদের দিয়েই জাহাজ চালানো হবে। তবুও সেই সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার এনে জাহাজে বিপদ ঘটানোর রিস্ক নিতে চাইলেন না কেউই। অন্যদিকে আমিও বা নিজের বিয়ে নিয়ে রিস্ক নিবো কেনো? যদি আমি সময়মত দেশে যেয়ে না পৌঁছাতে পারি, আর আমার বিকল্প-বর খোঁজ করা শুরু করে দেয়? যাক, সেটা আর হতে দেই নাই – শুভ সমাপ্তি ঘটেছিলো সেবার।

বাংলার মনি – দৈনিক আজাদী (dainikazadi.net)

Share