[SMC Magazine ‘নোঙর’] এলেবেলে : মোঃ আরিফ রায়হান (২৪)
বাল্যবন্ধু টুটুল ফোন করে বলল, লেখা চাই। আরে ভাই খেলা চাইলেই কি পাওয়া যায়। “ঘর লেইপা, মুইছা, আতুরঘর বানাইয়া, ভগবানের কাছে বাচ্চা চাইলেই তো আর বাচ্চা পয়দা হয় না” বর কণের সফলতম মিলনের পরও নয় মাস দশ দিন সময় লাগে–লেখার জন্য সময় লাগে।
শুরুটা মনে হচ্ছে ভাল হলনা। একটা গল্প বলি। এক নোয়াখালীর মৌলভী মফস্বলের এক রেল ষ্টেশনে নেমে, অনেক খানি হাটার পর অতিথি হয়েছেন তার পরিচিত এক কৃষকের বাড়ীতে। কৃষক বউ তার পূর্ব পরিচিত। কৃষক বউ জানতো যে, মৌলভী সাহেব খুব ভাল বক্তা, সুন্দর করে সুর করে ধর্মের- অধর্মের গল্প বলতে পারেন। মৌলভী সাহেব পৌঁছা মাত্র, কৃষক বউ বললেন মৌলভী সাহেব এখনই “কারবালার কাহিনী” শুরু করেন।
এর মধ্যে কৃষক পাশের গ্রামের মেলা থেকে একটি ছাগী কিনে বাড়ী ফিরেছে। কৃষক বউ সেই ছাগী দেখে খুব খুশি, সাথে সাথে সে ছাগীটিকে নিয়ে গেল গোয়াল ঘরে দুধ দোয়াতে। এক ফোটা দুধ বের হলনা দেখে, কৃষক বউ বেজার। কৃষককে বলল, কী ছাগী কিনলে, এক ফোটা দুধও দেয়না। কৃষক তখন হেসে বলল, ছাগীতো হেটে হেটে হয়রান। ও দুধ দিবে কীসে? একটু দানা পানি দেও, জিরানোর ব্যবস্থা কর, দেখবে দুধ ঠিকই দেবে।
পাশের ঘর থেকে মৌলভী সাহেব সব শুনছিলেন। তিনি বললেন, কথা ঠিক। একটু দানা পানি আর জিরোবার ব্যবস্থা না পেলে আমিই বা গল্প শুরু করি কীভাবে।
বাল্য সাথী টুটুল যদি এক- আধটা সোনার দিনার (সিং ডলার এখন সোনার দিনারের সমান) এর সম্মানির আশা দিত, আমার বিশ্বাস আমার লেখা তড়তড়িয়ে বের হতো। লেখা কী খুব সহজ কাজ!
মহাজনেরা বলেন, লেখার জন্য চাই কল্পনা শক্তি। আর আমি বলি, লেখার জন্য চাই অবসর, চাই সময়। আমার কল্পনা শক্তি না হলেও চলে।
অনেক হল এবার চল যাই সিংগাপুরে। মনে পরে সেই কথা-“ঘর হতে আঙ্গিনাই বিদেশ” সিংঙ্গাপুর হল আমাদের জন্য আঙ্গিনা। বাংলাদেশ- আমাদের ঘর। তাই নয় কী? আয়তনের দিক থেকেও সিংঙ্গাপুর আঙ্গিনার সমান। সিংঙ্গাপুরকে আঙ্গিনা বলায় কী, কেউ খারাপ ভাবছেন। তা হলে থাক- অন্য কথা বলি।
আসিয়ান নামে যে একটা জোট আছে, একবার ম্যাপের দিকে তাকিয়ে দেখুন তো- জোট বদ্ধ দেশ গুলির মধ্যে সিংঙ্গাপুর কতটুকু। সিংঙ্গাপুর অরুন্ধতী তারার মত। আকাশের ক্ষুদ্রতম তারা। অরুন্ধতী যখন সপ্তার্ষীর সাতটি তারার একটি হয়ে আকাশে দেখা দেয় তখন মনে হয় এই ক্ষুদ্রতম তারাটি না থাকলে সপ্তর্ষী অসুন্দর, সপ্তর্ষী অসম্পূর্ণ। সিংঙ্গাপুরও তেমনি অরুন্ধতী । নাহ্- তুলনাটা যুতসই হল না, মনে দোলা দিলো না। একটু রসময় হলে ভাল লাগবে।
আসিয়ান জোটে, সিংঙ্গাপুর হল প্রিয়ার চিবুকে কালো তিল। কি বিশ্বাস হচ্ছে না, ভাবছেন কল্পনা করে বলছি? একদম না। ম্যাপটা আরেকবার দেখুন, বুঝবেন আমার কল্পনা শক্তি একটি “তিল” দানার সমানও না। কল্পনা করে কিছু বলি নাই। বাস্তবের সহজ সরল বর্ণনা দিলাম মাত্র।
পাঠক ক্ষমা করবেন। একটু নিজের কথা বলি। জীবিকার জন্যে জলে জলে- বন্দরে ঘুরি। ভাবলাম আর কত? সুযোগ সুবিধা আছে, সিংঙ্গাপুরে বসবাস শুরম্ন করি, সুপারেন্টেডেন্ট এর চাকুরী নিয়ে সুপারম্যান হয়ে যাই। সে আর হয় নাই- হবেও না এ জীবনে। কারন আমি খুব দুর্বল চিত্ত্বের মানুষ। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে পারি না। কী হয়? কী না হয়? ইংলিশে, একে কি ইন্কন্সিস্টেন্সি (প্রতি নিয়ত মত বদলানো) বলে?
আমি পরেছি দোটানায়- ঘরে থাকবো, না আঙ্গিনায় থাকব। আঙ্গিনা খুব ভাল। সিংঙ্গাপুর ইজ এ ফাইন সিটি। খোলামেলা, আলো বাতাস, বাগান, সবকিছুই আঙ্গিনাতে। কিন্তু ঝড় বাদল, আর খরতাপে তো আর আঙ্গিনায় থাকা যায় না। তার জন্য ঘর চাই। বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ। আংঙ্গিনা হল কাজের জায়গা। বিশ্রামের জন্য, মিলনের জন্য, অবসরে গান আর কবিতার জন্য, দরকার ঘর। বাংলাদেশ, আমার সেই ঘর।
বড্ড ম্যারম্যারে কথা হচ্ছে। রসহীন। সময় নষ্ট করে কে লেখকের ব্যক্তিগত কথা পড়বে? (হুমায়ুন আহমেদের কথা আলাদা। ওঁনার প্রতিটি ব্যক্তিগত লেখাই যাদুকরি) যাক, ঐ যে ইন্কন্সিস্টেন্সির কথা বলছিলাম না- সেটা নিয়ে এক গল্প নয়, সত্য ঘটনা আছে। সেটাই বলি। রবীঠাকুর তখন বিলেতে। বিলাতের এক সংবাদপত্র তাঁর সাক্ষাৎকার নিবে। সাংবাদিক রবীঠাকুরকে প্রশ্ন করলেন-
ক) হোয়াট ইজ ইয়োর মোষ্ট ফেভারিট ভার্চু (আপনার সবচেয়ে প্রিয় পূর্ন্যচার কি) —-রবীঠাকুরের উত্তর ছিল এক শব্দে- ইন্কন্সিস্টেন্সি।
খ) হোয়াট ইজ ইয়োর বেষ্ট ফেভারিট ভাইস? (আপনার সবচেয়ে প্রিয় পাপাচার কি)—–রবীঠাকুরের উত্তর ছিল এক শব্দে- ইন্কন্সিস্টেন্সি।
আমার মত লোক, ইন্কন্সিস্টেন্সি-তে ভুগলে লোকে বলে, দূর্বল চিত্ত। রবীঠাকুর ইন্কন্সিস্টেন্সি-তে ভুগেও মহাজন, গুরুদেব।
আমরা যখন নিজের স্বার্থের জন্যে, কাপুরুষের মত, সুযোগ সন্ধানীর মত, সত্য আর সুন্দরের সাথে আপোষ করি, সত্য পথ ত্যাগ করি, তখন আমাদের ইন্কন্সিস্টেন্সি পাপ।
আবার যখন নিজের ভুল বুঝতে পারি, সত্য-সুন্দরের আলোয় আলোকিত হয়ে, ভুল ত্যাগ করে সঠিক পথ-মতের দিকে ফিরে যাই তখন ইন্কন্সিস্টেন্সি পূন্য।
পাপ পূন্য নিয়ে অনেক কথা হলো। ভাবছি কিছু এলেবেলে কথা বলে এ লেখা শেষ করবে। ২০১১ সালে আমরা সপরিবারের বেড়াতে গিয়েছিলাম সিংঙ্গাপুরে। তখন আমার ছেলে সুদিপ্ত-র বয়স ৫। এয়ার পোর্টে নেমেই, ও সিংঙ্গাপুরের ভক্ত হয়ে গেল। সিংঙ্গাপুরের সবকিছু ভাল তার কাছে। স্বপ্নে দেখা শহর। পরদিন সাত সকালে আমরা দাড়িয়ে আছি মেরীটাইম হাউজের সামনে- ট্র্যাক্সীর জন্য। (সুদীপ্ত প্রায়-ই আমাকে বলে মেরীটাইম হাউজ, ২০০ ক্যান্টনমেন্ট রোড- এ আমরা কবে আবার বেড়াতে যাব) যথারীতি ট্যাক্সী পেলাম, দরজা খুলতেই, দেখি ড্রাইভার এক শিখ সরর্দারজী। আমার আগেই জানা ছিল একজন সর্দারজীর সাথে কীভাবে সৌজন্য বিনিময় করতে হয়- বললাম “ সাত্ শ্রী (আ)কাল”। সামান্য বিস্মিত চোখে সর্দারজী প্রতিউত্তর করল। আমরা চললাম- গন্তব্য মেরীটাইম হাউজ থেকে জুরং বার্ড পার্ক। চলতে শুরু করার কিছুক্ষন পর সুদিপ্ত আমাকে বলল, ট্যাক্সী ড্রাইভার নাকি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মত দেখতে। আমি বললাম, কথা ঠিক। একেতো জাত ভাই তার উপর ট্র্যাক্সী ড্রাইভারের চেহারা- ছবি অবিকল না হলেও মোটামুটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমান মনমোহন সিং এর মত (দাড়ীগোফ, টারবানের কথা বলা বাহুল্য) যাইহোক টুকটাক কথা বার্তা চলছে আমদের মাঝে। কিছুক্ষন পর আমরা জুরং বার্ডপার্কে পৌছে গেলাম। আমি ট্র্যাক্সীর ভাড়া দিয়ে রিসিট নিয়ে ট্র্যাক্সী থেকে নেমে যাচ্ছি ততক্ষনে সুদিপ্ত ট্র্যাক্সি থেকে নেমে ও মা বোনের সাথে ফুটপাতে দাড়িয়ে আছে। দেখি ট্র্যাক্সী ড্রাইভার গাড়ী থেকে সুদিপ্তকে আদর করে দিয়ে বলছে তার জীবনের সবচেয়ে ভাল কমপ্লিমেন্টা, সে সুদিপ্তের কাছ থেকে পেয়েছে। সিংঙ্গাপুরে আমাদের অবস্থান সুন্দর হোক- সেই কথা বলে সর্দারজী বিদায় নিল। এটা এমন কোনো ঘটনা নয় যে, সবার কাছে গল্প করা যাবে। কিন্তু আমি যে জন্য বলছি তা হলো- ৫ বছরের সুদিপ্তের ধারনা সিংঙ্গাপুরে সে, শ্রীমান মনমোহন সিং-এর ট্র্যাক্সীতে করে ঘুরেছে।
বার্ড পার্কের সামনে নানান অর্কিড। জীহ্বা মোচর খায় এমন একটা নাম বলে আমার মেয়ে শৈলী জানালো, অর্কিড- সিংঙ্গাপুরের জাতীয় ফুল। আমার জানা ছিল না।
ফুলের কথা যখন আসল, তখন এই ফুল নিয়ে সিংঙ্গাপুরে, আমার এক কষ্টের কথা বলি। ১৯৯৯ সাল। আমি আর আমার প্রাণসাথী শাওন, সেন্তোসাতে ঘুরছি, ফিরছি, অনেকটা- “ কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া— রামধনু আঁকা পাখা উড়াইয়া” এর মত করে। আমাদের সেন্তোসা ছেড়ে আসার আগে সর্বশেষ জায়গা ছিল “ ইমেজেস অব সিংঙ্গাপুর” দেখার। এখানে গেলে সিংঙ্গাপুরের ইতিহাস জানা যায়। আমরা ইতিহাস জেনে একটু ক্লানত্ম হয়ে বসলাম ”ইমেজেস অব সিংঙ্গাপুর“ দালানের সামনে বোগেনভিলার নিচে। অদ্ভুত সুন্দর, নানান রং এর বোগেনভিলার গাছ এক সাথে, বড় সর একটা ঝোপ। ফুলের ঝোপ। পাতা কই। পাতা নাই বললেই চলে। শুধু ফুল আর ফুল। বোগেনভিলা। রংধুনুতে থাকে সাত রং আর ফুলের ঝোপে ছিল সাতটিরও বেশী রং এর বোগেনভিলা। যারা আমাদেরকে মুগ্ধ করে ছিল। কিন্তু হায়, ২০১১ সাল। এবার যখন গিলাম, দেখি সব আছে, শুধু বোগেনভিলা নাই। বড় কষ্ট পেয়েছি। ইমেজেস অব সিংঙ্গাপুর- এর কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করে জেনেছি, প্রাকৃতিক বয়সের কারনে বোগেনভিলার বাগান মারা গেছে। সবার শেষ আছে—সব কিছুর সীমা আছে। আমরা সবাই “শেষ“-র দিকে ভ্রমন করছি। আমাকেও এই লেখার সীমা টানতে হবে।
আপনজনকে মানুষ সব কর্ম-অকর্মের অংশীদার করে। আমাকে, আপনারা (সিংঙ্গাপুরের বসবাসকারী সকল বাংলাদেশী) আপনাদের মহৎ কাজে অংশ নেবার সুযোগ দিয়েছেন, সে জন্য আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ।
রবীঠাকুরে ভর করে বলি, “অকারণ বেদনার ছাঁয়া ঘনায় মনের দিগনেত্ম, ছল ছল জল এনে দেয় নয়ন পাতে”- চোখের কোনে জল কেন? আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
——————————
[আরিফ রায়হান (২৪)। জন্মঃ গাইবান্ধা। কাজ করছেন মার্সক লাইনে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে। বিবাহিত জীবনে এক কণ্যা আর এক পুত্র সন্তানের জনক। থাকেন ঢাকায়। ভালবাসেন পড়তে, গান শুনতে, সময় কাটাতে বাচ্চাদের সাথে। বিশেষ আগ্রহ আছে ইতিহাস আর সুফিবাদে।]
Recent Comments