[SMC Magazine ‘নোঙর’] কথোপকথন – আতাউল মজিদ (২৬)
মাঠ পেরোতে পেরোতেই সন্ধ্যা নেমে এল। চায়ের দোকানের বাতিটা ক্রমশই এগিয়ে আসতে থাকলো। কথা বলতে বলতে পথ এগুতে থাকলো ওরা। বিশাল এই মাঠে আর কোন প্রাণী চোখে পরেনা। ওরা ছাড়া আর কেউ নেই এখানে। মাঝে মাঝে ঘন নিঃশ্বাস পরার শব্দ শোনা যাচ্ছে। আকাশে মেঘ করেছে। অন্ধকার ক্রমশই গাঢ় হতে লাগলো। হিম শীতল ঠাণ্ডা বাতাস যেনও গা ছুঁয়ে যায়। “বৃষ্টি আসছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে”। হাটার গতি বাড়িয়ে দিল ওরা।
উজ্জ্বল ও মঞ্জু মনিপুর স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। রোজ একই সাথে স্কুলে যাওয়া আসা করে ওরা। আজ ফিজিক্সের প্রাকটিকাল ক্লাস ছিল, তাই স্কুল ছুটি হতে দেরি হয়ে গেছে। ওদের দুজনের বাড়ি প্রায় কাছাকাছি। সামনের মোড় থেকেই দুজনের বাড়ির রাস্তা আলাদা হয়ে গেছে। আর মাত্র বিশ পা হাঁটলেই তিন রাস্তার মোড়।
যাইরে মঞ্জু; কাল আবার দেখা হবে। “যাই” বলে মঞ্জু ওর বাড়ির পথ ধরল। দেখতে দেখতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো ও। চায়ের দোকানের সামনে দু’ একজন লোক বসে আছে। বৃষ্টির ভাব দেখে রাস্তা ঘাট এমনকি দোকান গুলোও প্রায় জন-মানব শূন্য। হাজীর বাড়ির বাঁশ ঝোপটির পাশ দিয়ে যাবার সময় গা টা কেমন যেন ছম ছম করতে লাগলো। এই বুঝি……। মনে মনে দোয়া ইউনুস পরতে থাকল ও। আজ বেশি ভয় করছে। একেতো মানুষ নেই, তার উপর বাঁশপাতা গুলো কেমন যেন অদ্ভুত একটা শব্দ করে নৃত্য করছে। ভয়ে গা কাঁটা দিয়ে উঠছে। দৌড়াতে চেষ্টা করলো ও, পা দুটো যেন লোহা কাঠের মতো শক্ত হয়ে মাটিতে গেঁড়ে বসেছে। বাঁশঝোপটি কোনও রকমে ঘুরতেই যেনও একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছারলো ও। আ হ !!!। মা এদিকেই আসছেন। “কি রে আজ এত দেরী করলি যে? খুব চিন্তা হচ্ছিল”। মা’র কথা গুলো যেন ওর কানে মধুর মত বাজতে থাকলো। মায়ের গা ঘেসে হাটতে থাকলো ও। কোন কথাই বলল না……………
বাসায় ফিরে কাধের ব্যাগটা প্রতিদিনের মত খাটের উপর ছুঁড়ে দিল ও। “ব্যাগটা জায়গামত রাখতে কি কষ্ট হয়?” মায়ের কথা ওর কানেই ঢুকল না। শরীরে ক্লান্তি নামের বিশ কিলো ওজন যেন ভর করে আছে।
মিষ্টি একটা শব্দ, দ্রুত এগিয়ে আসছে। ঝম ঝম ঝম! বৃষ্টির শব্দে কত হাজার সুর হবে? কেউ কি বলতে পারে? কি মধুর সুর। কান খাঁড়া করে শুনছে ও। বৃষ্টির ঝাপটা ঘরের বারন্দায় আছড়ে পড়ছে সমস্ত শক্তিতে। বড় বড় ফোটাগুলো ঝুপ করে পরে ছিটকে পরছে চারিদিকে। টুপটাপ, টুপটাপ শব্দ যেন অন্তসারশূন্য হৃদয়ে দোলা দিয়ে যাচ্ছে নীরবে। হাত দুটো বের করে দিয়ে বৃষ্টির ছোঁয়া পেতে চাইছে মন। আর তখনি বিজলী চমকে উঠল। পুরো পৃথিবীটাই চোখ মেলে দেখে নিলো ও সেই আলোতে। ব্রজ্রপাতের বিকট আওয়াজে বারন্দার গ্রিলটা ঝর ঝর শব্দে কেঁপে উঠলো। “আলেয়া! জানালা গুলো তাড়া তাড়ি বন্ধ করে দে, বৃষ্টিতে তো ঘর ভিজে যচ্ছে”। ঝুপ করে চারিদিকে অন্ধকার ছেয়ে গেল। বৃষ্টির সাথে কারেন্টের যেন একটা অদ্ভুত সম্পর্ক আছে। “আলেয়া! হারিকেনটা জ্বালা। তোদের সব সময় বলি সন্ধ্যা হলেই হারিকেনটা রেডি রাখবি। আজকেও ভুলে গেছিস। কোন ধ্যানে যে থাকিস”? মা সেই কখন থেকে আলেয়া কে বকেই চলছেন।
“বেলা গড়িয়ে গেল, এখনও উঠছিস না কেন? উঠ। স্কুলের সময় হয়ে গেল যে”। কাল রাতে যে কখন ঘুমিয়ে পরেছে ও, বলতেও পারবেনা। “আর কত দিন খাবার মুখে তুলে খাওয়াব? বড্ড জ্বালাস তুই। তুই কি বড় হবিনা”? মার অভিমানী সুরের কথা শুনতে ওর খুব ভাল লাগে। আহ্লাদি ভঙ্গিতে মাকে জড়িয়ে ধরল ও। “ ছাড়! আর আহ্লাদ করতে হবে না, বুড়ো খোকা”।
হাই তুলতে তুলতে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলো ও। “নাস্তা রেডি আছে, হাত মুখ ধুয়ে খেতে আস”। আজ স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না ওর। তার উপর সিরাজ স্যার এর পড়া মুখস্ত হয়নি। আজ নির্ঘাত মাইর আছে কপালে। বিকেলে জোড়া তাল গাছের মাঠে ফুটবল খেলা আছে। স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।
উজ্জ্বল, উজ্জ্বল বলে কে যেন সেই তখন থেকে ডেকে যাচ্ছে। এতো সকালে কে ডাকছে ওকে? সাইফুদ্দিন? কি হয়েছে? “তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নীচে আয়”। কি হয়েছে? ও জিজ্ঞাসা করলো। মঞ্জুদের বাসার সামনে দেখলাম অনেক লোকজন ভীড় করে আছে’। কেন? বলে প্রশ্ন ছুড়ে দিল ও। “জানিনা। চল গিয়ে দেখে আসি”। ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছিল ও। “কোথায় যাচ্ছিস”? এই আসছি, বলে ও বেরিয়ে পড়লো। “খেয়ে যা”?
মঞ্জুদের বাড়িটা রাস্তা থেকে বেশ উঁচুতে। বন্যার পানি প্রতি বছরই রাস্তা ডুবিয়ে দেয়। নৌকা করে এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যেতে হয়। দূর থেকেই বাড়িটা নজরে পরে। আজ ওদের বাড়ির সামনে অনেক মানুষ ভীড় করে আছে।
মঞ্জু মঞ্জু বলে বেশ কয়েকবার জোরে জোরে ডাকল ও। লোকগুলো অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো। সবাই ওর দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে কেন? কি হয়েছে? ও তো কোনও অন্যায় করেনি।
ঘরের ভিতর থেকে কান্নার আওয়াজ শোনা গেলো। মঞ্জুর বাবা, মা কারও কিছু……। কি সব আবোল তাবোল ভাবছে ও। কি হয়েছে? এতো মানুষ? কান্নার আওয়াজ? ও আবারও মঞ্জুর নাম ধরে ডাকতে থাকলো। লোকগুলো দ্বিগুণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল। খুব ভয় পেয়ে গেল ও। ওর চোখদুটো ছল ছল করে উঠলো। “মঞ্জু তোমার বন্ধু”? কথা না বলে মাথা নেড়ে উত্তর দিল ও। ওর উত্তর শুনে লোকটি হাউ মাউ করে ছোট বাচ্চার মত কাঁদতে লাগলো। লোকটির কান্না দেখে ও আর কান্না ধরে রাখতে পারল না। কিন্ত ও কেন কাঁদছে?
ভয়ে ভয়ে, ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে গেলো ও। ওর শিশুতোষ মনে হাজারও প্রশ্নের ঝড় বয়ে চলল। কি হয়েছে? দূর থেকে ও কে দেখতে পেয়েই ছুটে আসলেন মঞ্জুর মা। “আমার বাবা, আমার বাবা, তুই কোথায় চইল্লা গেলি, আমার বাবা”? আমার মঞ্জু, আমার মঞ্জু বলতে বলতে তিনি নিস্তেজ হয়ে পরলেন। সবাই তার চোখে মুখে পানি দিচ্ছিল। মঞ্জুর বাবা ঘরের এক কোনাই বসে আছেন। কোনও কথা বলছেন না তিনি শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। তার দৃষ্টি যেন কোন এক অজানায় গিয়ে থেমে গেছে। কঠিন পাথরের মত দৃষ্টিহীন চোখে গড়িয়ে পরছে অথই সাগরের জল। চোখ ঘুরাতেই ওর প্রিয় মুখটি দেখতে পেলো ও। মঞ্জু, সাদা কাপড়ে আপাদমস্তক আবৃত। কান্নার নোনা জলে চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো ওর। নিথর দেহটি, ঠোঁটের কোনে এক চিলতে মিষ্টি হাসি ছুয়ে আছে। কি আনন্দে ঘুমিয়ে আছে ও। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল উজ্জ্বল।
-“কি রে কখন এলি তুই”? সেই কখন। কতক্ষণ ধরে তোকে ডাকছি, তুই জবাবই দিলি না। লোকগুলো এমনভাবে দেখছিল, যেন তোকে ডাক দিয়ে আমি মহা অন্যায় করেছি। -“ওরা তোকে চিনতে পারেনি। ওরা তো জানেনা, তুই যে আমার বন্ধু”। তোর মার কি হয়েছে? উনি খুব কাঁদছিলেন। -“মা আমাকে অনেক ভালবাসেন তো, তাই। ঐ দেখ বাবা আমার দিকে কিভাবে তাকিয়ে আছেন, যেন কতদিন দেখেননি”। এই গরমে গলায় মাফলার পরে আছিস কেন? ঠাণ্ডা লেগেছে? -“না। কাল রাতে বাসায় এসে দেখি, আব্বা বাজার থেকে অনেক আখ নিয়ে এসেছেন। বেশ আয়েশ করেই আখ খাচ্ছিলাম। তার পর যে কি হল জানিনা। ঘাড়ে প্রচণ্ড ব্যাথা হচ্ছিল”। তারপর? -“তারপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি”। বলিস কি? কেন? -“জানিনা। আব্বা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। ডাক্তাররা সবাই মিলে তো অনেক চেষ্টা করলো। আজ স্কুলে যাবি না?” তুই যাবি না? -“না”? বন্ধুরা যদি জিজ্ঞেস করে কেন এলিনা? তুই তো জানিস শাকিল স্কুলের গেটে দেখা হলেই জানতে চাইবে, মঞ্জু কোথায়? কি বলবো? ফরহাদ সারের ক্লাসটা তো মিস করবি? আর সিরাজ সার, গোল গোল ভূগোল। মুচকি হাসিতে ঠোট কেঁপে উঠল ওর। কিছু বললি না যে? -“কি”? ওরা যদি জানতে চায় স্কুলে আসলি না কেন? -“বলে দিস। মঞ্জু আর কখনই স্কুলে যাবেনা….”
PDF Version [Published at SMC Magazine “নোঙর” May 2014]
—————————————-
[ক্যাপ্টেন আতাউল মজিদ (২৬)ঃ আগ্নিঝরা এক ভোরে জন্ম তার, সন ১৯৭১। তারপর শৈশব, কৈশোর কাটিয়ে যৌবনে ম্যারিন একাডেমী হয়ে সামুদ্রিক জীবনের শুরু ১৯৯২ সনে। দীর্ঘ ১৭ বছরের সমুদ্র প্রেম ছিন্ন করে আজ তিনি সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। বর্তমানে একটি শিপ ম্যান্যাজমেন্ট কোম্পানিতে সিনিয়র ম্যারিন সুপারিন্টেনডেন্ট এর দায়িত্ত্বে নিয়োজিত আছেন।]
Recent Comments