[SMC Magazine ‘নোঙর’] সাগর জলের কালি : মিনার রশীদ  (২১)

[SMC Magazine ‘নোঙর’] সাগর জলের কালি : মিনার রশীদ (২১)

আমি তখন ইরানি জাহাজে কর্মরত৷ ১৯৯৬ সাল৷ রাজনীতির আকাশটিতে সামান্য একটু ঝড়ো হাওয়ার পর গনতান্ত্রিকভাবে প্রথম ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে৷ বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতা থেকে ‘আউট’ হয়েছেন৷ আর ‘ইন ‘ হয়েছেন শেখ হাসিনা ওয়াজেদ৷ ইরানিয়ান এক ফিটার তখন আমাকে জিজ্ঞেস করে, “আগা ( জনাব ), তোমার দেশে হয়েছেটা কি? এক ভদ্রমহিলা ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছেন৷ সাথে সাথে অন্য আরেক জন ক্ষমতায় এসে পরেছেন৷ সত্যি করে বলতো দেখি, তোমাদের দেশে কি আসলেই কোন পুরষ নাই?”

বললাম, “থাকবে কীভাবে বলো? ঘর সংসার, বাচ্চা-কাচ্চা, রাষ্ট্র ইত্যাদি চালানোর ভার নারীদের উপর অর্পন করে আমরা সব পুরুষেরা যে জাহাজে চলে আসি৷”

একটা ম্যারাথন হাসি ছড়িয়ে পরলো পুরো কন্ট্রোলরুম জুড়ে৷ বললাম, দেখো এই জাহাজ চালানোটি আসলেই কঠিন৷ বিপরীতক্রমে রাষ্ট্র চালানো পানির মত সহজ৷ জাহাজের অটো-পাইলটের চেয়ে দেশ চালানোর অটো-পাইলট মেকানিজমটি আরো বেশি অটোমেটিক৷ কাজেই ড্রাইভিং সিটে কোন লিঙ্গের ড্রাইভার বসলো সেই চিন্তা অমূলক ৷ আমাদের দেশের জনগণ কখনই অন্যান্য দেশের জনগণের মতো নিজেদের চাল-ডাল-নূন-তেল সংক্রানত ছোটখাট সমস্যা নিয়ে ভাবে না ৷ তারা ব্যস্ত থাকে কে স্বাধীনতার ঘোষ, কে স্বাধীনতার পক্ষে এই ধরনের জটিল সমস্যা নিয়ে৷ বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধির শতকরা ৯৯ ভাগ খরচ হয় এই সব সমস্যার পেছনে৷ ফলে কম্যান্ড সেন্টারে বা ড্রাইভিং সিটে জনতার কোন চাপ নাই৷ নারী হোক ,পুরুষ হোক – এই সিটে বসায় কোন হেরফের নাই৷ অর্থাৎ পুরুষ বসলেও যাই করতো৷ নারী বসেও এখন তাই করছেন৷

আমাদের ক্যাডেট লাইফে জনৈক অফিসারের হাবভাব দেখে আমাদের নিশ্চিত ধারনা জন্মালো যে উনার উপরের চেম্বারে কিছু গোলমাল রয়েছে৷ আমাদের ইমিডিয়েট সিনিয়র ব্যাচের একজন জাহাজের ক্যাডেট মহলে ঘোষণা করলেন, ‘বাছারা, পিতৃদত্ত এই প্রাণটির প্রতি যদি সামান্য মায়া অবশিষ্ট থাকে তবে দিনের বেলায় না পরলেও রাত আটটা থেকে বারোটার সময় লাইফ-জ্যাকেটটি পড়ে থেকো ৷’ কারন ঐ সময়টিতে তিনি ব্রীজের ডিউটিতে থাকেন৷

ঐ নেভিগেটরের যে সব আলামত দেখে আমরা কয়েকজন এই লাইফ জ্যাকেট পরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তার চেয়েও মারাত্মক ধরনের সিম্পটম দেখা যায় রাষ্ট্ররূপী এই জাহাজটির বিভিন্ন নেভিগেটরদের মাঝে৷ জাহাজের মগজটি ত্রুটিযুক্ত হয়ে পরলে নেভিগেটর কিংবা প্রকৌশলী হিসাবে জাহাজের কাজ চালিয়ে যাওয়া কঠিন৷ কিন্তু ঘাড়ের উপর থেকে পুরো মাথাটি বিলকুল গায়েব হয়ে গেলেও মনে হয় রাষ্ট্র চালানোতে কোন সমস্যা হবে না৷

সঙ্গত কারনেই সবাই এই সব নেভিগেটরদের ঘৃণা করে৷ আবার এই ঘৃণা থাকার কারনেই ভালো ও দক্ষ নেভিগেটররা ‘পলিটিক্স’ নামক ব্রীজটিতে পা রাখতে চান না৷ মনের মাঝে থাকে সবসময় বিশ্ব সুন্দরী কিন্তু সর্বক্ষণ ঘরে থাকে বিশ্ব পেত্নী৷ আমরা টিকেট কাটি থার্ড ক্লাসে কিন্তু ভ্রমণ করতে চাই ফার্ষ্ট ক্লাসে৷ খুব কম জায়গা থেকেই বলা হয় ভালো মানুষদের, ভালো ছেলেদের রাজনীতিতে আসা দরকার৷

পরিণামে তৃতীয় শ্রেণীর নেভিগেটররাই জাহাজের ব্রীজটি দখল করে ফেলে৷ কিন্তু মন চায় লি-কূয়ান ইউ না হলেও মাহাথিরের মতো কোন দক্ষ নেভিগেটর আমাদের এই জাহাজটি চালাক৷ এ এক আজব চাওয়া৷ এ চাওয়ার জন্যেই এক-এগারেতে আকাশ থেকে কিছু ফেরেশতা নেভিগেটর নেমে আসল ৷ বাইবেলে বর্ণিত মানুষের বেশে দুনিয়ায় আসা ফেরেশতাদের অবস্থার মতো করুণ পরিণতিও দেখতে হলো এক-এগারোর ফেরেশতাদের৷

আগে মাঝে মাঝে লিখলেও এই সময়টিতেই আরো শক্তভাবে কলমটি নিয়ে নেমে পড়লাম ৷ মনের ভাবনাগুলি কাগজে লিখে তখনকার বহুল প্রচারিত যায় যায় দিনে পাঠিয়ে দিই৷ পত্রিকাটিও তা অকৃপণভাবে ছাপাতে থাকে৷ পাঠকদের অভুতপূর্ব সাড়া পাই৷ পত্রিকাটি তাদের রেগুলার কলামিস্ট হিসাবে এই অধমকে বেছে নেয়৷ আমার লেখায় একটু নোনতা স্বাদ পেয়ে কলামটির নাম রাখা হয় ‘ সাগর জলের কালি’ ৷ শফিক রেহমানের কাছ থেকে যায় যায় দিন ছিনিয়ে নেওয়ার পর বলা হয় এই ধরনের নোনতা লেখা আর লেখা যাবে না৷ বললাম,আমাকে যদি নির্দেশ দেওয়া হয় কী লিখতে হবে তাহলে আর লিখবই না৷ কারন লেখা আমার পেশা নয়, নেশাও নয়। শুধু ভেতরের একটা তাগিদ থেকেই লিখে থাকি৷

আমাদের ব্যাচের মইনুল পরামর্শ দেয় লেখায় বেশী বেশী জাহাজের কথা থাকলে আমি জাহাজের মানুষ হিসাবে টাইপড হয়ে পড়ব৷ সাধারনের কাছে তা গ্রহনযোগ্যতা হারিয়ে ফেলবে৷ পরামর্শটি দামী হলেও কেন যেন ছাড়তে পারি না৷ কারন জীবনের প্রথম প্রেমিকা ‘ নৈতিকতা ‘ এবং আরো একটু পরে জীবনে আসা সঙ্গীনি – এই উভয়ের সম্মুখে শিরদাড়াটি কিছুটা মজবুত রাখতে পেরেছি এই মেরিন একাডেমির কারনেই৷ অর্থাৎ আমার ‘সাগর জলের কালি’ তার শক্তিটি পেয়েছে এই মেরিন প্রফেশনটির কাছ থেকে ৷

ঢাকা কলেজে বাংলার শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলাম অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাইয়িদ সহ আরো কয়েকজন আলোকিত মানুষকে৷ হৈমন্তী গল্পটি যে স্যার পড়াতেন তিনি তার ক্লাসের সকল ছাত্রকে হৈমন্তীর স্বামী অপুর মতো রোমান্টিক বানিয়ে ফেলতেন৷ সবার মনের জানালাগুলি এমনভাবে খুলে ফেলতেন তাতে অপুর মনের দখিনে হাওয়া গুলি একই শিহরন ছড়িয়ে আমাদের সবার উপর দিয়েই বয়ে যেত৷
কাজেই যখন মেরিন একাডেমিতে চান্স পেলাম তখন মনে হল এখন রঙধনু থেকে লাল রঙ এনেও স্বপ্নের নায়িকার পায়ে আলতাটি পরাতে পারবো৷ এমন একটা রোমান্টিক মুড নিয়েই চলে আসি পাহাড় ঘেরা জুলদিয়ার সেই মেরিন একাডেমিতে৷

শাবানা,ববিতা,রোজীনা প্রমুখ নায়িকাগন বয়সে সামান্য বড় হলেও তা ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না৷ তাদেরকে গড়পরতা স্বপ্নের নায়িকা বলেই গণ্য করতাম৷ কাজেই সবচেয়ে ধাক্কাটি খেলাম যখন দোস্তদের সাথে বিশেষ প্যারেড সহকারে গাইতে হলো, ‘মেরিন একাডেমিতে এলাম গো , ববিতা খালা -রোজিনা খালা বাঁচাও গো৷’ এভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের যত নায়িকা আছে সবাইকে খালা ডাকা শুরু করতে হলো৷ যাদেরকে খালা ডেকেছি তারা শুনতে পেলেও নির্ঘাত জলে পড়ে মরত৷

শরীরের কষ্ট সহজেই ভুলে যাওয়া যায়৷ মনের এই কষ্টগুলি সহজে ভোলা যায় না৷ দেখলাম সিনিয়ররা একশত ভাগ স্মার্ট৷ আর আমরা জুনিয়ররা একশত ভাগ আনস্মার্ট৷ আরও যন্ত্রণাদায়ক স্মার্ট ছিলো কয়েকজন স্টুয়ার্ড৷ নিয়ম মতো সিনিয়রকে দেখামাত্রই স্বরযন্ত্রের ভলিউম সর্বোচ্চ দিয়ে বলতে হতো , স্লামালিকুম স্যার৷ সবকিছু ঠিকই ছিল কিন্তু গোলমাল পাকিয়েছে এই ওভার স্মার্ট স্টুয়ার্ডগণ ৷ বেতালে হয়তো কোন সিনিয়রকে উইশ করতে ভুলে গেছি , আবার তালে পড়ে এরকম কোন স্টুয়ার্ডকেও উইশ করে বসেছি – স্লামালিকুম স্যার৷

টেরোরাইজড হয়ে দেখলাম পেছন থেকে কয়েকটা ছায়া গর্জে ওঠলো, ব্লাডি হেল, হোয়াই উইশিং স্টুয়ার্ড ? অর্থাৎ মারাত্মক গলদ হয়ে গেছে৷ সেই ভুলের জন্যেই শুরু হলো কোর্ট মার্শাল৷

শুরু হলো ফ্রগ জাম্প, ফ্রন্ট রোল, স্টার জাম্প, এলিফ্যান্ট ওয়াক,ফ্রন্ট রোল,সাইড রোল ৷ ফার্ষ্টফুডের মত একেক বাহারি নাম৷ টের পায় যাদেরকে এগুলি খেতে হয়৷ এ্যাটেনশন হয়ে দাড়িয়ে থাকলেও শরীর ও হাতের মধ্যে সিনিয়র মহাশয় হাত ঢুকিয়ে বলেন, ‘হোয়াই গ্যাপ?’ দেখলাম দুনিয়ার আদি পাপের মতোই এই গ্যাপটি রাখাও একটা পাপ ৷ আমাদের তারেক এই গ্যাপ যথাসম্ভব বন্ধ করতে গিয়ে একদা এক সিনিয়রের হাত আটকে ফেলে ৷ সিনিয়র মহোদয়ের নিজের হাতটি বের করতে কষ্ট হলেও বলে যাচ্ছেন, হোয়াই গ্যাপ? এমন করুণ ও মজার দৃশ্য দেখেও নাকি হাসা যাবে না৷ একটু হাসলেই রিপোর্ট -টু-মি-ওয়ান- টু- থ্রি ..৷ মানে রাত একটা -দুইটা -তিনটার সময় পারস্যের কবি হাফিজের কোন গজল বা শের গেয়ে সিনিয়র মহোদয়ের ঘুমটি ভাঙাতে হবে৷

পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হলো এই সিনিয়ররা যারা উঠতে বসতে জ্বালিয়েছে পরবর্তিতে তারা কেউ শত্রু  হিসাবে গণ্য হন নাই৷ অধিকাংশই পরম বন্ধু হয়ে পড়েছেন ৷ জুনিয়র-সিনিয়রের এরকম থোকা থোকা হয়ে অনেক দীর্ঘ হয়ে পড়েছে এই গাছটি৷

পেছনে তাকালে এই থোকা বা সেগমেন্ট থেকে অনেক প্রিয় সাথী কিংবা প্রিয় সিনিয়র-জুনিয়র ঝরে পড়ার বেদনাটিও সকলের মনে বেজে ওঠে৷ এই বেদনার সারিটিও নেহায়েত খাটো নয়৷ জুলদিয়ার পাহাড়, পারকির চরের হাইকিং, ফোর-মেইন-মিজান টপ ও পাশের গ্রাউন্ডগুলিতে অনেক স্মৃতি ফেলে এসেছি৷

জানি না, প্রকৃতির কোন গোপন ক্যামেরায় গচ্ছিত সেই দৃশ্যগুলি ফিরে পাওয়ার কোন যন্ত্র আবিস্কার হলে মানব সভ্যতায় সবচেয়ে দামি আবিস্কার হবে, নাকি আমাদের আবেগ ও স্মৃতিগুলিকে বিবর্ণ করার দায়ে অভিযুক্ত হবে সেই যন্ত্রটি ৷

PDF Logo_2PDF Version [Published at SMC Magazine “নোঙর” May 2014]
————————

Rashid_21
[মিনার রশিদ (২১): প্রকৃত নাম আব্দুর রশীদ হলেও মিনার রশীদ নামেই সমধিক পরিচিত। বিভিন্ন  পত্রপত্রিকা এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে তার লেখা কলামগুলি সুধীজনের মনোযোগ আকর্ষন করেছে I স্ত্রী আফরোজা খানম( শিউলী) গৃহিনী।    একমাত্র ছেলে এ এম শাহরুজ রশীদ (সিয়ান)  এংলো চাইনিজ (ইন্ডিপেন্ডন্ট) এ সেকেন্ডারি  ফোরে অধ্যয়নরত।  ম্যানশিপ প্রাইভেট লিঃ এ টেকনিকেল ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত। ]

Share