[SMC Magazine ‘নোঙর’] স্মৃতি : সবিনা সুজা

[SMC Magazine ‘নোঙর’] স্মৃতি : সবিনা সুজা

১৯৬৪ সাল;
লাহোরের আনারকলি মার্কেটের সামনে চকচকে নীল রঙের ভক্সওয়াগনটা থামতেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসলেন এক সুদর্শন যুবক – নাম তার মুনির। বয়স আনুমানিক ২৬ বা ২৭, সাথে তার সুন্দরী স্ত্রী যাহিরা আর দুই বত্সরের শিশুকন্যা। লাহোরের ধুসর রাস্তায় যেন একরাশ শান্তির হওয়া ছড়িয়ে তারা একটু এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে মার্কেট ভবনে প্রবেশ করলেন। শীতের শেষে লাহোরের মোলায়েম আবহাওয়া ক্রমেই তপ্ত এবং রুক্ষ হয়ে উঠেছে। ছোট ছোট বামন আকৃতির কাঁটা গাছগুলোতে কেমন যেন গরম হওয়া বইছে। আর রাস্তার ধারের ধুলিকণা কেমন গোল ঘুর্নির চক্কর বেঁধে বেঁধে এপাশ ওপাশ ঘুরছে।

পাকিস্তান আর্মিতে কমিশন প্রাপ্ত বাঙালী ডাক্তার মুনির তার স্ত্রী ও শিশুকন্যাকে তার নতুন কর্মস্থল লাহোরে নিয়ে এসেছেন। লাহোরের নতুন পরিবেশে যাহিরা ভীষণ মুগ্ধ। নতুন সংসার, আশে পাশের লোকজন ভীষণ বন্ধুভাবাপন্ন। মনেই হয়না নিজের জন্মভূমি, পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে বহুদূরে আছেন। শহর দেখার অংশ হিসেবে আজ রবিবার বিকেলে বের হওয়া।

বেশ কয়েকঘন্টা ঘোরাঘুরির পর আনারকলি মার্কেটে এসে পৌঁছালেন তারা। মূঘলদের স্মৃতি সমৃদ্ধ লাহোর শহরটাই যেন এক যাদুঘর। সবখানেই কিছু না কিছু মূঘল নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। আর প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়ে দিয়েছে শহরটিকে। ব্রিটিশ ভারতের একটি অন্যতম শহর এই লাহোর। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বিখ্যাত রাভী নদী। এখানকার খাওয়া দাওয়াও যেন তুলনাহীন। ঝাল গোস্ত এবং মিষ্টি পরাটার তুলনা মেলা ভার, আর গরম জিলাপী ছাড়া যেন কোনো খাবারই পুরো হয় না।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে যাহিরা দোকানগুলো ঘুরে দেখতে লাগলো। এ দোকান থেকে ও দোকানে ঘুরে ঘুরে দেখছে। নানা রঙের লেইস, ফিতে আর চুড়ির দোকান। কাঁচের চুড়ি থরে থরে সাজানো। অনেক শাড়ী আর সালওয়ার কামিজের দোকান। আনমনে সে ঘুরছে আর দেখছে। কোনো কিছুই তেমন মনে ধরছে না। হঠাৎ এক কাতান শাড়ীতে তার চোখ আটকে গেল। গাড় বাদামী রঙের উপর পেটানো জরির কাজ। শাড়ীটা খুলে যখন গায়ে ধরলো, মনে হলো এই শাড়ীটা যেন তারই জন্যই। আয়নায় যে প্রতিবিম্ব সে দেখলো, মনে হলো এ যেন নতুন এক সত্ত্বা। সুখী ও আত্মবিশ্বাসী এক যাহিরা। রূপকথার সেই রানীর মত সে শুধু চেয়েই থাকলো। হঠাৎ পেছনে ফিরে দেখে মুনির নিঃশব্দে ক্যাশ-কাউন্টারে দাম পরিশোধ করছে। যাহিরা ভীষণ উদ্দীগ্ন হয়ে পড়লো। মাসের মাঝখানে ৮০ রুপী দিয়ে শাড়ীটা  কেনার কি দরকার ছিল? খুবই মৃদুভাষী মুনির তখন মিট মিট করে হেসে বলে, “শাড়ীটা তোমাকে ভীষণ ভালো লেগেছে।”

এরপর অনেক পানি গড়িয়ে যায় রাভী নদী আর কর্ণফূলী নদী দিয়ে। পৃথিবীর বুকে নতুন মানচিত্রের স্মৃষ্টি হয়। পূর্ব পাকিস্তান হয়ে যায় বাংলাদেশ। একটি নতুন দেশের জন্ম হয়। আর পাকিস্তান তার অর্ধেক ভূখন্ড আর জনসংখ্যা হারায়। আর যাহিরার কাছে লাহোর হয়ে যায় এক স্মৃতির শহর…….।

১৯৯৬ সাল;
আজ প্রায় দু’বছর হতে চলল, যাহিরা আর সব স্মৃতির সাথে মুনিরের স্মৃতিও যোগ করেছে। পুরো বাড়িতে মুরিরের রেখে যাওয়া সব স্মৃতিচিন্হ। যেখানে যায়, মুনির যেন তাকে ছায়ার মত অনুসরণ করে। স্মৃতির সাথে বসবাস করে তার একাকিত্বই যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। কোথাও যেতে যেন একদম মন সায় দেয় না। মেয়েরা যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। একমাত্র ছেলে মেরিন একাডেমিতে। সেজ মেয়েটি বেড়াতে এসেছে বাড়িতে। সে সবে মাত্র পাকিস্তান ঘুরে এসেছে স্বামীর সাথে। নানা গল্প তার……. মেয়ে বলে যায়, “মা তোমার জন্য একটা শাড়ী এনেছি করাচি থেকে। জাহাজ পোর্ট কাসিমে থেমেছিল। আমরা ট্যাক্সিতে করে পুরো করাচি ঘুরেছি। মা… মা… তোমরা যে DOHS-এ ছিলে তা দেখে এসেছি। কি হল মা…… কথা বলছ না যে…… দেখো ঠিক সেই রঙের শাড়ী, যেটা বাবা তোমার জন্য লাহোরের আনারকলি…..।”

মা আর সামনে নেই। উঠে তিনি তার রুমে চলে গেছেন। কোনো কিছুই তার সেই পুরানো স্মৃতির স্থান নিতে পারবে না। এখন স্মৃতিই তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। এই স্মৃতি তিনি কোনো কিছুর সাথে ভাগাভাগি করতে রাজি নন। একা একা ইজি চেয়ারে বসে তিনি দুরের আকাশে চেয়ে রইলেন…।

২০১২ সাল;
মা যাহিরা আজ বেঁচে নেই। সাবিহা একা মার ঘরে বসে আছে। আজ প্রায় সপ্তাহ হতে চললো শীতের ছুটিতে সে দেশে এসেছে। আজই তার সময় হলো বাবার বাড়িতে আসার। সাবিহা মার ঘরে একা বসে আছে। ছোট ভাই-এর নতুন বউ এসেছে ঘরে। খুবই সুন্দর করে পুরো বাড়িটা সাজিয়েছে। কথাও কোনো ত্রুটি নেই। মার ঘরটা এখন গেস্ট রুম, আর মার আলমারিটা এখন স্টোর রুমে। সবই সুন্দর করে গুছানো আছে। আলমারিটা খুলে দেখছিল সাবিহা। হঠাৎ চোখে পড়লো পলিথিনে মোড়ানো নেতিয়ে যাওয়া কাতান শাড়ীটা।

চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। কিছুই দেখতে পারছে না সে। চশমাটা বোধহয় গেস্ট রুমের বিছানায় ফেলে এসেছে…..। জীবনের সব ঘটনাই একদিন স্মৃতির ফ্রেমে বন্দী হয়। স্মৃতি যেন এক চালিকা শক্তি। কেউ একে উপেক্ষা করতে পারে না। এটাই নিয়তি; এটাই ভাগ্য। এক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে শাড়িটা বুকে জড়িয়ে ধরে সাবিহা বসে থাকে গেস্ট রুমে…..।

——————

Shobina Suza17

সবিনা সুজা চট্টগ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে বিএ অনার্স এবং এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর তিনি বিভিন্ন প্রাইভেট কলেজে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তিতে তিনি স্বামীর কর্মস্থল সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান। বর্তমানে তিনি BLLS স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি সিঙ্গাপুরের SEED ইন্সটিটিউট থেকে DECCE সম্পন্ন করার পর এখন PCF কিন্ডারগার্টেনে কর্মরত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই সন্তানের জননী।

Share