[নোঙর 2016] আমার সেরা বিদেশ ভ্রমন : নাফিসা মাশহুরা ইরা

[নোঙর 2016] আমার সেরা বিদেশ ভ্রমন : নাফিসা মাশহুরা ইরা

ছোট বেলা থেকে বিদেশ ভ্রমণের প্রতি আমার বিশেষ দূর্বলতা রয়েছে। বাবা মেরিনার হওয়ার সুবাদে আমার এই আশা পূরণে খুব একটা কষ্ট হয়নি। আমার বয়স যখন সবে তিন তখনি মা’কে নিয়ে প্রথম বিদেশ সফরে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য বাবার জাহাজে জয়েন করা। জাহাজ ছিল আরব আমিরাতের ফুজাইরাতে। এখন ও আমার মনে পড়ে, আমি ও আমার মা যখন দুবাই বিমান বন্দরে অবতরণ করি আমার বড় আব্বু (বাবার বড় ভাই) আমাদের অর্ভ্যথনা জানাতে অপেক্ষা করছিলেন। সেদিন বড় আব্বুর সাথে দুবাই শহরে অনেক ঘু্রেছিলাম। পরদিন বিকেলে বাবার অফিসের এজেন্ট আমাদের ফুজাইরা নিয়ে গেল। সেখানে থেকে বোট এ করে আমাদের জাহাজে নিয়ে যাওয়া হয়।
এটা ২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়। বাবার জাহাজটি ছিল অনেক বড় এর ধারণ ক্ষমতা লক্ষ টণের কাছাকাছি। জাহাজে ছোট হওয়াতে সবাই খুব আদর করতেন। জাহাজে চার মাস কাটানোর পর ২০০৭ সালের জানুয়ারী মাসে করাচি থেকে বাবা সহ দেশে ফিরলাম। চার মাসের ভ্রমণে দুবাই, কাতার, কুয়েত, ইরান, পাকিস্তান যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। দেশে ফিরে স্কুলে ভর্তি হলাম। তাই অনেক দিন আর বিদেশ ভ্রমণের সৌভাগ্য হয়নি। ২০১০ সালে তখন আমি সবে মাত্র চট্টগ্রাম ক্যান্টমেন্ট স্কুলে ভর্তি হয়েছি। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি বাবা ফিরলেন জাহাজ থেকে, তখন বায়না ধরলাম বিদেশ ভ্রমণে যাব। এবার আমাদের সাথে যোগ হল আমার দু’বছরের ছোট ভাই রিহান।
অবশেষে জুন মাসে বাবা, মা এবং আমরা দুই ভাই-বোন গেলাম মালয়েশিয়ার কুয়ালামপুরে। সেখানে তিন দিন থাকার পর সড়ক পথে রওনা হলাম মালয়েশিয়ার লঙ্কাউয়ির উদ্দেশ্যে। কুয়ালালামপুরে আমরা টুইন টাওয়ার, গেন্টিং হাইল্যান্ড, পুত্র জয়ার মত বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে গিয়েছি। লংকাউয়িতে তিন দিন কাটানোর পর আসলাম সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরে তখন চিড়িয়াখানা বার্ড পার্ক, সেন্তোসা দ্বীপ সহ অনেক দর্শনীয় স্থানে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল সিঙ্গাপুর থাকাকালীন আমার বাবার বন্ধু মাসুদ আংকেল এর বাসায় ছিলাম। তখন বাবার আরেক বন্ধু মোসারত আংকেল এর পরামর্শে বাবা সিঙ্গাপুর এ শোর জবে যোগদান করলেন। পরবতীতে ২০১০ সালে অক্টোবরে আমরা বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুর শিফট করলাম।
শুরু হলো আমার নতুন জীবন, নতুন পরিবেশ, নতুন স্কুলে, দেখতে দেখতে পাঁচটি বছর কেটে গেল। সিঙ্গাপুর আসার পরও আমাদের বিদেশ ভ্রমণ থেমে থাকেনি। ২০১২ সালে ঈদ উদযাপন করার জন্য মালয়েশিয়ার মালক্কা গিয়েছিলাম। খুব মজা করেছিলাম সবাই মিলে।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে মা এবং আমরা দুই ভাই-বোন গিয়েছিলাম অষ্ট্রেলিয়ার সিডনীতে। সিডনীতে আমার বড় মামা থাকেন। আমাদের কাছে পেয়ে উনি যেন আকাশের চাঁদ পেয়েছেন। সিডনী ভ্রমণের সময় বাবা আমাদের সাথে ছিলেন না। দশ দিনের সিডনী ভ্রমণে মামা আমাদের আশেপাশের সব দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরিয়েছেন। বিশেষ করে অপেরা হাউজ, সিডনী হার্বার ব্রীজ ব্লু মাউন্টেন উল্লেখযোগ্য।
২০১৪ সালের মার্চ মাসে আমরা গিয়েছিলাম ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে, ইন্দোনেশিয়াকে মসজিদের দেশ বলা হলেও বালিকে মন্দিরের দ্বীপ বললে ভুল বলা হবে না। কারণ এখানকার ৯০ শতাংশ মানুষই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। বালির দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে উবোদ ভিলেজ, টানাহ লট, কিন্টামানি আগ্নেয়গিরি, বাটুর লেক উল্লেযোগ্য। পুরো দ্বীপটা যেন বিভিন্ন ধরনের মন্দির দিয়ে সাজানো।
ছোট বেলা থেকে পূথিগত বিদ্যার সাথে সাথে আমাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার একটা চেষ্টা বাবার মধ্যে দেখা যায়। আমাদেরকে ইসলাম এবং এর ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা দেন। বাবার ধারণা ছোট বেলা থেকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত না হলে ভবিষ্যতে এ ধর্মীয় কাজ কর্মে আমাদের অনীহা এসে যাবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালৈ বাবা পরিকল্পনা করলেন আমাদের পুরা পরিবার নিয়ে পবিত্র মক্কা এবং মদিনায় যাবেন। পরিকল্পনা মতো জুন মাসের নয় তারিখ আমরা সিঙ্গাপুর থেকে সৌদি এয়ারলাইন্স এ জেদ্দা পৌঁছলাম। জেদ্দা বিমান বন্দরে আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে মতিন আংকেল (২৯ ব্যাচ) ছিলেন পরে আমরা মতিন আংকেল এর সাথে ওনার জেদ্দায় বাসায় রাত কাটালাম। উল্লেখ্য যে বাবার আগের কোম্পানীর অফিস ছিল জেদ্দায়। জেদ্দা অফিসে মতিন আংকেল সুপারইনটেনডেন্ট হিসেবে আছেন। পরদিন আমরা সড়ক পথে পবিত্র নগরী মদিনার পথে রওনা হলাম, পাঁচ ঘন্টার পর মদিনায় পৌঁছল যাত্রা পথে মরুভূমি এবং কিছু কিছু জায়গায় মরু জাহাজ খ্যাত উট দেখলাম। উট দেখার পর আমার ছোট ভাই রিহান এর আনন্দ ছিল দেখার মত।
মদিনা পৌঁছেই আমাদের জন্য নির্ধারিত হোটেলে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) রওজা মোবারক জেয়ারত করতে গেলাম। জেয়ারতের পর বাবা আমাদের নিয়ে গেলেন ও মসজিদ এ নববী সংলগ্ন কবরস্থান জান্নাতুল বাকীতে। যেহেতু জান্নাতুল বাকীতে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ তার বাইরে থেকে দেখলাম। এই কবরস্থানে আমাদের নবীজীর পরিবারের বিভিন্ন সদস্য ছাড়াও হাজার হাজার সাহাবীদের (যে সমস্ত মুসলিম নবীজীকে স্বচক্ষে দেখেছেন) কবর আছে। পরদিন বাবা আমাদের নিয়ে গেলেন মদীনা শরীফের কাছে ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে, বিশেষ করে উহুদের মাঠ যেখানে (উহুদের যুদ্ধে নিহত শহীদদের কবর রয়েছে), মসজিদ কোবা (প্রাচীনতম মসজিদ) এবং মসজিদ এ কেবলা তাইন (যে মসজিদে নবীজী নামাজ পড়ার সময় আল্লাহর নির্দেশে নামাজ পড়ার দিক মক্কামুখী হয়েছিল) তিন দিন পবিত্র মদিনায় থাকার পর সড়ক পথে রওনা হলাম পবিত্র মক্কা নগরীর উদ্দেশ্য।
মদিনা থেকে বাস ছাড়ার এক ঘন্টা পর একস্থানে ত্রিশ মিনিটের যাত্রা বিরতি হলো যেখানে আমার বাবা ও ছোট ভাই ইহরামের কাপড় পরল যা মক্কা শরীফে ওমরা করতে লাগে, চার ঘন্টা যাত্রার পর অবশেষে আমাদের বহু আকাংখিত পবিত্র মক্কায় পৌঁছলাম। হোটেলে ফ্রেশ হয়ে বাবা মা ও আমরা ভাই-বোন হারাম শরীফ এর ভিতর দিয়ে পবিত্র কাবা শরীফে প্রবেশ করলাম। এ যেন এক অন্য রকম অনুভূতি। বাবা আমাদের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিচ্ছিল। পবিত্র কাবা শরীফে ওমরা পালন শেষে আমরা হোটেলে পৌঁছলাম।
পরদিন আমার এক নানা ভাইয়া (সেবা চাচীর বাবা) গাড়ীতে করে মক্কার আশেপাশের ঐতিহাসিক স্থানগুলোর দেখতে গেলাম। যার মধ্যে জবলে নুর, জবলে ছুর, জবলে রহমতে, জান্নাতুল মাওলা, মিনা, আরাফাত ময়দান, মোজাদালিফ, মসজিদ এ নমিরা উল্লেখযোগ্য। বাবা আমাদের প্রত্যেক স্থানের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। আমি অভিভূত হচ্ছিলাম লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের নগরী পবিত্র মক্কা শরীফ দেখে, পাঁচ দিন পর ২০ই জুন ২০১৫ আমরা জেদ্দা থেকে সিঙ্গাপুরে উদ্দেশ্যে রওনা হলাম স্মৃতির পাতায় রেখে আসলাম অভাবনীয় সুন্দর দুটি স্থান পবিত্র মক্কা ও মদিনা। ছোট বেলা থেকে অনেক বিদেশ ভ্রমণ করলাম কিন্তু পবিত্র মক্কা ও মদিনা নগরী আমার সেরা ভ্রমন।
—————–

Nafisa
নাফিসা মাশহুরা ইরা ক্যাপ্টেন ইমরান কালাম চৌধুরীর (২৬) মেয়ে।

Share