জাহাজির ডায়েরি- ৬: মেরিন একাডেমির ক্যাডেট মানেই অবিচ্ছিন্ন বন্ধন – আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ (৪৭তম ব্যাচ)

জাহাজির ডায়েরি- ৬: মেরিন একাডেমির ক্যাডেট মানেই অবিচ্ছিন্ন বন্ধন – আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ (৪৭তম ব্যাচ)

আমার দুই বছরের একাডেমিক জীবনে মাত্র এক বছর করে সিনিয়র-জুনিয়রদের পেয়েছি। কেবল ইমিডিয়েট সিনিয়র-জুনিয়রদের সঙ্গে নয়, একাডেমির প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের এত আন্তরিক সম্পর্ক যা সাধারণত দেখা যায় না। শুধু বললেই হলো, আমি একাডেমি ক্যাডেট, ব্যাস!

বাংলাদেশ মেরিন একাডেমিতে চান্স পাওয়া আমার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এইচএসসি পাস করার পরে কোথায় ভর্তি হব, না হব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বড়দা’র সঙ্গে যখন আলোচনা করছিলাম তখন বড়দা বলল, ‘যাই করিস না কেন, আমার মতো ডাক্তার হবি না! আমি তোকে ডাক্তার হতে বললে পরে আজীবন আমাকে গালি দিবি যে, জেনেশুনে কেন তোকে মেডিক্যালে ভর্তি হতে বললাম!’

আমি বললাম, ‘তাহলে আর্মিতে ট্রাই করি?’

তাতেও তার খুব একটা আগ্রহ দেখা গেল না। এরপর মেরিনার হওয়ার কথা বলতেই বলল, ‘এটা তো খারাপ না, ট্রাই করতে পারিস। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবি, ছয় মাস পর পর ছুটিতে আসবি।’

সব ভেবে শেষমেশ মেরিনার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সত্যি বলতে মেরিন/মেরিনারদের সম্পর্কে স্বচ্ছ কোনো ধারণাই ছিল না একাডেমিতে ভর্তির আগ পর্যন্ত!

আমার দুই বছরের একাডেমিক জীবনে মাত্র এক বছর করে সিনিয়র-জুনিয়রদের পেয়েছি। অর্থাৎ আমি ৪৭তম ব্যাচের ক্যাডেট, ৪৬তম ব্যাচের স্যারদের সঙ্গে এক বছর আর ৪৮তম ব্যাচের জুনিয়রদের সঙ্গে এক বছর কাটিয়েছি।

এর মধ্যে নানা ধরনের ছুটিও ছিল, কিন্তু এত অল্প সময়ে এত গভীর সম্পর্ক আমাদের মাঝে গড়ে উঠেছে যেটা অবিশ্বাস্য!

কেবল ইমিডিয়েট সিনিয়র-জুনিয়রদের সঙ্গে নয়, একাডেমির প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের এত আন্তরিক সম্পর্ক যা সাধারণত দেখা যায় না। শুধু বললেই হলো, আমি একাডেমি ক্যাডেট, ব্যাস!

পাসিং আউটের পর একাডেমি, একাডেমির সিনিয়র-জুনিয়র কী জিনিস তা আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করেছি। আমি ক্যাডেট হিসেবে জাহাজে জয়েন করার সুযোগ পাই ২৫তম ব্যাচের এক স্যারের মাধ্যমে।

স্যার আমাকে উনার ভাগ্নে পরিচয় দিয়ে ২৬তম ব্যাচের আরেক স্যারের অফিসে পাঠিয়েছিলেন আমার জয়েনিংয়ের ব্যাপারে। পরে সেই স্যারের অনুরোধে আমি জাহাজে জয়েন করেছিলাম এবং আল্লাহর রহমতে একটানা ১৫ মাস ১৪ দিন ক্যাডেট হিসেবে ছিলাম!

আমি পাসিং আউটের সাত মাস পর জাহাজে জয়েন করি। এই সাতটি মাস যে কীভাবে কেটেছিল সেটা আল্লাহ ভালো জানেন। একদিকে আব্বার ডায়ালাইসিসের মাত্রাতিরিক্ত খরচ, অন্যদিকে আমি বেকার বসে আছি।

আমার দেখা আমাদের পরিবারের সবচেয়ে সংকটময় সময় ছিল সেটা। খুব আশা ছিল প্রথম ইনকামের টাকা আব্বার হাতে তুলে দেব, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে আশা পূরণের সুযোগ পাইনি।

সেই সাত মাসের দুঃসহ সময়ে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দিয়েছিলেন ১৫তম ব্যাচের এক স্যার। আমি হতাশায় নির্ঘুম থেকে রাত ২/৩টায় মেসেজ দিয়ে দেখতাম ভোর ৬টায় স্যার রিপ্লাই দিয়েছেন! স্যারকে সময় অসময়ে মেসেজের পর মেসেজ দিয়েছি কিন্তু কখনও বিরক্ত হননি।

বড়দা বলতেন, ‘একমাত্র তোদের প্রফেশনেই হয়ত এমন মানুষ হয়। আমাদের কোনো সিনিয়র মেসেজ/মেইল পড়েও দেখেন না, রিপ্লাই তো দূরের কথা!’

সেই স্যার অনেকভাবে অনেকবার তার সিনিয়র, ব্যাচমেটকে বলেছিলেন আমার জবের জন্য, কিন্তু উপযুক্ত সুযোগের অভাবে জয়েনিং হয়নি। তবে স্যারের আন্তরিকতার এতটুকু কমতি ছিল না।

পাসিং আউটের পর থেকে এই আট বছরে কতভাবে যে কত সিনিয়র স্যারের সাহায্য পেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। কয়েকটা ঘটনা বলি…

১০তম ব্যাচের এক স্যার সিংগাপুর থাকেন। ঢাকায় উনার ব্যবসা আছে। স্যার সিংগাপুর থেকে ফোন করে আমাকে বলেছিলেন, আমি চাইলে আপাতত জয়েন করতে পারি তার ঢাকা অফিসে। এরপর জাহাজে জয়েনিং এর সুযোগ হলে চলে যাব যে কোনো সময়। উনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না, শুধু একাডেমির জুনিয়র হিসেবেই এ সুবর্ণ সুযোগ দিয়েছিলেন।

২৫তম ব্যাচের এক স্যার আমাকে পাসিং আউটের পর থেকেই সাপোর্ট দিচ্ছেন সেই সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে! যখন যেভাবে পেরেছেন আমাকে সাহায্য করেছেন। অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রায়ই ফোন দিয়েছেন। বলেছেন, যদি কখনও টাকার দরকার হয় স্যারকে যেন জানাই! যেখানে নিজের অনেক আত্মীয়স্বজন থেকেই বিপদের সময় পাঁচ হাজার টাকা পাইনি সেখানে স্যার আমাকে ৫০ হাজার টাকা দিতে চেয়েছেন শুধু একাডেমির জুনিয়র হিসেবে! তাও সে সময় যখন আমার সামনে কোনো আশা-ভরসা ছিল না। আজ পর্যন্ত স্যারকে সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার।

২০১৫ সালে জুনিয়র অফিসার হবার পরীক্ষায় পাস করার পর হোয়াটসঅ্যাপে দেশ-বিদেশের অসংখ্য সিনিয়র মেরিনারদের মেসেজ দিয়েছি একটা জবের জন্য। অনেকেই সাহায্যের জন্য চেষ্টা করেছিলেন, সিভি নিয়েছিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে একদিন ২৯তম ব্যাচের এক স্যার সিংগাপুর থেকে ফোন করে বললেন, সিংগাপুরের অন্যতম সেরা একটা কোম্পানি থেকে শিগগিরই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। আমি যেন সবসময় ফোন চালু রাখি, রেগুলার ইমেইল চেক করি। সঙ্গে এটাও বললেন, সিলেকশনের পর যদি এজেন্সি কোনো ধরনের চার্জ দাবি করে আমি যেন সরাসরি স্যারকে জানাই। আল্লাহর অশেষ রহমতে কোনো ধরনের তথাকথিত সার্ভিস চার্জ ছাড়াই, সরাসরি অফিসার হিসেবে র‍্যাংকের সেরা বেতনে জয়েন করেছিলাম। উল্লেখ্য, সেই কন্ট্রাক্টটি আমার এবং আমার পরিবারের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। সেই কন্ট্রাক্টটের জন্যই পরিবারের সমস্ত আর্থিক ঋণ দ্রুততম সময়ে শোধ করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

অফিসার হিসেবে প্রথম কন্ট্রাক্ট শেষ করার পর প্রায় নয় মাস অপেক্ষা করেছিলাম। এর পর দ্বিতীয় কন্ট্রাক্ট করার সুযোগ পেয়েছিলাম ২৪তম ব্যাচের এক স্যারের আন্তরিকতার জন্য। আমার জয়েনিং ডিল নিয়ে সমস্যার কথা বলার পর স্যার নিজে উদ্যোগ নিয়ে আমার ইউএসএ ভিসা করানোসহ রি-জয়েনিংয়ের সমস্ত কাজে সাহায্য করেছিলেন।

২৪তম ব্যাচের আর একজন স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ আছে যিনি বিখ্যাত মার্কস লাইনের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। স্যার মার্কসে এমন কোনো কাজ নেই করেননি আমাকে জয়েন করানোর জন্য! স্যার আমাকে প্রতিনিয়ত মেসেজের রিপ্লাই দিতেন এত ব্যস্ততার মাঝেও। স্যারের সঙ্গে প্রথম যেদিন কাকতালীয়ভাবে ধানমন্ডিতে দেখা হলো সেদিন আমার স্ত্রী তিথিও সঙ্গে ছিল। ভাবী তিথিকে নিজের স্বর্ণের আংটি পরিয়ে দিয়েছিলেন নতুন বউ দেখে। স্যার বাসায় অনেক সময় দিয়ে রেস্টুরেন্টে ডিনার করিয়ে এরপর আমাদের ছেড়েছেন। অথচ স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয়-কথাবার্তা হোয়াটস অ্যাপে শুধু একাডেমির একজন জুনিয়র হিসেবে।

বছরখানেক আগে আমার এক আত্মীয়ের জরুরি কিছু টাকার দরকার হয়েছিল। আমি জাহাজ থেকে পাঠাতে গেলে সময়-ঝামেলা দুটোই বেশি লাগবে ভেবে ৩৪তম ব্যাচের এক স্যারকে মেসেজ দিয়েছিলাম। স্যার আমাকে তৎক্ষণাৎ রিপ্লাই দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কবে কত টাকা লাগবে! জানানোর এক দিনের মধ্যেই স্যার ১০০০ ডলার ট্রান্সফার করে দিয়েছিলেন!

২০১৮ তে সিংগাপুরে সিনিয়র অফিসার হবার পরীক্ষা দেয়ার সময়ে ৪৪, ৪৫, ৪৬তম ব্যাচের স্যারদের আর ৪৮তম ব্যাচের একমাত্র জুনিয়রের আন্তরিকতার কথাও কখনও ভোলার নয়।

কিছুদিন আগে করোনার লকডাউনে তিথি-তাজমীন অস্ট্রেলিয়া আটকা পড়লে সেখানে থাকা ১০তম ব্যাচের এক স্যার বলেছিলেন, ‘If your family needs any help please let me know.’ বিপদের সময় এমন ছোট্ট একটা মেসেজ যে কতবড় মানসিক সাপোর্ট তা বলে বোঝানো যাবে না।

শুধু যে একাডেমির সিনিয়ররাই আন্তরিক তেমন না। একাডেমির বাইরের অনেক ক্যাপ্টেন-চিফ ইঞ্জিনিয়ার স্যারের সাহায্য ভালোবাসা পেয়েছি যাদের প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ।

সিলেট ক্যাডেট কলেজের এক্স-ক্যাডেট একজন চিফ ইঞ্জিনিয়ার স্যার ২০১৫ থেকে বিভিন্নভাবে আমাকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন। আমার জব দেয়া থেকে ইউএসএ ভিসা করানোর জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছিলেন।

সিংগাপুরে থাকাকালীন পহেলা বৈশাখের প্রোগ্রামে নিয়ে যেতে এক স্যার নিজে আমাদের বাসার নিচে এসেছিলেন পিক করতে। ভাবী-ভাতিজিদের সঙ্গে আমাদেরকে একই গাড়িতে করে নিয়ে গিয়েছেন, আবার নামিয়ে দিয়েছেন। কতটুকু আপন মনে করলে নিজের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে জুনিয়রদের নিয়ে একটা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন তা সহজেই অনুমেয়।

এমন আরও অনেক অনেক ঘটনা আছে সিনিয়র, জুনিয়রদের নিয়ে যা বলে শেষ করা যাবে না। সিনিয়রদের আন্তরিকতা দেখে আমি প্রতিনিয়ত অবাক হই।

ভালো খারাপ দুনিয়ার সবখানে, সব প্রফেশনে আছে। আমাদের একাডেমিক সিনিয়র বা প্রফেশনও তার ব্যতিক্রম নয়। আমি নিজেও বেশ কয়েকজন মেরিনারকে দেখেছি, যারা জুনিয়রদের নিয়ে ব্যবসা করে, একাডেমিক সিনিয়র বলে জুনিয়রদের থেকে বিভিন্নভাবে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে জুনিয়রদের অজ্ঞতা বা বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে।

তবে সেসব গুটিকয়েক মেরিনার, এক্স-ক্যাডেটদের জন্য বাকি হাজারও সাদা মনের মেরিনারের ভালো ব্যাপারগুলো প্রকাশ না করাও আমার কাছে অন্যায় বলে মনে হয়। সবখানে, সব ব্যাচেই কিছু অপ্রত্যাশিত ভাইরাস থাকে, যা ফিল্টারিংয়ের সুযোগ নেই। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যতটুকু দেখেছি, মেরিনারদের মধ্যে সে খারাপের অনুপাত খুবই নগণ্য। হয়ত হাজারে ৮-১০ জন! এই ৮-১০ জনের জন্যই বাকিরা কত ভালো তা সহজে উপলব্ধি করতে পেরেছি।

আমি অত্যন্ত গর্বিত বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির একজন ক্যাডেট হতে পেরে, বাংলাদেশ মেরিন কমিউনিটির একজন হতে পেরে। এ কমিউনিটির একজন না হলে হয়ত জানাই হতো না আল্লাহ দুনিয়াতে এত মহৎ আর উদার মনের বিনয়ী মানুষকে পাঠিয়েছেন।

প্রকাশিত:মেরিন একাডেমির ক্যাডেট মানেই অবিচ্ছিন্ন বন্ধন (newsbangla24.com)


লেখক: আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ, এক্স-ক্যাডেট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, ৪৭তম ব্যাচ
[e: sailormahmud@gmail.com]

Share