[নোঙর 2016] একটি দুপুর, অনিলা ও দেবশিশু : তাহসীনা সাইফুল্লাহ্

[নোঙর 2016] একটি দুপুর, অনিলা ও দেবশিশু : তাহসীনা সাইফুল্লাহ্

ব্যস্ত সমস্ত হয়ে গেট পার হল অনিলা, যা ভাবা তাই হাতিরপুলের ১১ নং রোড এমনিতে রিকশায় সয়লাব হয়ে থাকলেও এই মাঝ দুপুরে একটারও দেখা নাই, মরুভুমির লু হাওয়া বইছে যেন চারদিকে, এই মে’তেই এই অবস্থা আর তো দিন পরেই আছে। নিজের উপর বিরক্ত হয়ে উঠল নিরু, ভাষা ইন্সটিটিউটের এই লাঙ্গুয়েজ কোর্স টা কেন যে নিয়েছিল তাও এই সেশনে? এই গরমে, সবগুলা ক্লাস পরেছে শেষ দুপুরের এই ভ্যাপসা সময়টায়। বাসা থেকে বের হতে না হলে এতক্ষন নিজের ঘরের পর্দা টেনে দিয়ে ফুল স্পিড ফ্যানের আরামে একটা গল্পের বই নিয়ে আয়েশ করা যেত। তা না হুটোপুটি করে বেরও, ঝা ঝা রোদে পুড়ে রিকশার আশায় দাড়িয়ে থাকো আর নিজের অদৃষ্ট কে গালমন্দ কর।

রাস্তার একটা পাশ আবার কাটা হচ্ছে, টি এন টি’র কেবল ঠিক ঠাক করা তো না এই নাগরিক জীবন কে আর একটু বিষময় করে দেয়া, উঁচু ঢিবির মতো করে রাখা মাটি গতকালের বৃষ্টিতে চুইয়ে এসে ভালো জায়গাটাও কাঁদা কাঁদা করে দিয়েছে।শখ করে কারিতাস থেকে কেনা ভেজিটেবল ডাই’র সাদা ছাই সুন্দর শাড়িটার পাড়ের কাছটা কেমন কাদা লেগে গেলো, ভাল্লাগে?অস্থির হয়ে উঠল অনিলা, একটা রিকশা অন্তত আয় না রে বাবা। পাশের বিল্ডিঙের দোতলার বারান্দা থেকে আবার খালি গায়ে এক ধিঙ্গী লোক ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। বিশ্রী পশম ওঠা গা, উঁচু করে পড়া লুঙ্গী, আহ কি মনোরম অনুভব যে হচ্ছে অনিলা’র ! গরমে, বিরক্তিতে, রাগে চিড়বিড় করছে ও। এমন সময় হঠাৎ গলির ওই মাথায় এক রিকশা দেখল ও, হাত তুলে থামতে বলবে অমনি চিল চীৎকার আর ধর ধর হুটোপুটি শব্দ শুনে চমকে তাকিয়ে দেখে ওদের মেইন দরজার পাশে সরু জায়গাটায় আস্তানা গেড়ে থাকা পাগলিটা অস্থির হয়ে চেঁচাচ্ছে আর আকুল হয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে কি যেন বলতে চাইছে, নিচের মাটি কাটা গর্তে তাকিয়েই বুঝতে পারল কি হয়েছে।বছর পাঁচ ছয়ের এক ছেলেকে নিয়ে দিন রাত ওই ছোট্ট যায়গাটায় শুয়ে থাকে ও, গরমের দুপুর ঢলে এসেছে, আধো ঘুমে গড়িয়ে মিটার দেড়েক গভীর গর্তটায় পরে গেছে ওর ছেলে’টা। অবোধ মাথা আর অস্পষ্ট চেতনায় ওখানে নেমে ছেলেকে তুলে আনার ক্ষমতাটুকু পাগলীর নেই, কিন্তু বোধের গভীরে বইতে থাকা চিরন্তন মাতৃত্বের টানে কাঁদছে আর একলা পরে থাকা ভূতের গলির এই পথে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে দিয়ে দেখাচ্ছে ছেলেটাকে, বাচ্চাটাও কাঁদায় পরে আফ্রিকান মাগুরের মতো পিছলে পিছলে যাচ্ছে বারবার, নিজেই উঠতে চাইছে কিন্তু পারছেনা। অসহায় এই মা ও ছেলের বাস্তবতায় অনিলার সামনে এসে দাঁড়ালো ওর ত্রাতা রিকশা’টি। মাথা ঝাঁকিয়ে এক ঝটকায় উঠে বসল ও রিকশায়। চলেন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ভাষা ইন্সটিটিউট।

পান্থপথ দিয়ে বের হয়ে রিকশা এখন সাইন্সল্যাব মোড়ে সিগন্যালে, এই সময়ের ভিতরে অনিলা কোনোভাবেই মাথা থেকে ছাড়াতে পারছেনা পাগলীটার গোঙ্গানো কান্না আর বাচ্চাটার হাচরে পাঁচরে বাঁচার চেষ্টা। নিজেকে বোঝাচ্ছে সে, কি ই বা করতে পারত ও, একে মেয়ে সে, দুয়ে শাড়ি পরে আছে, তিনে ওটা একটা ময়লা ঘিনঘিনে পাগলীর বাচ্চা, হাত দিয়ে ধরত কিভাবে ও? আর ধরলেও আজকের ক্লাস টা আর কোনোভাবেই করতে পারত না । বাসায় ফিরে যেতে হত, গোসল করে রেডি হতে হতো আবার। এদিকে সেমিস্টার ফাইনাল ঘাড়ের উপর, ক্লাস মেটরা সব ওর শুধুই কোর্স-মেট, কেউই বন্ধু নয়। প্রেজেন্টেশন, রিপোর্ট সবকিছুতেই নিজের প্রেজেন্স খুবই প্রয়োজন। এই সব কিছুই বার্নিং ফ্যাক্ট, একেবারে আপাদমস্তক রুঢ় বাস্তবতা। কিইই বা করার ছিল আসলে ওই পরিস্থিতিতে ওর? কিন্তু কিন্তু বার বার এতো ডিস্টার্ব করছে দৃশ্যটা, পাগলিটার আকুল কান্না আর কাঁদা মাখা ছোট বাচ্চাটার উঠে আসার মরিয়া চেষ্টা। শেষ মুহূর্তে ও যখন ওদের ওই অবস্থায় ফেলে রিকশায় উঠে বসল, দুজনেই অমন অবাক হয়ে কেন তাকাল ওর দিকে? ইশশশ কেন??

ক্লাসের এক ঘন্টা পঞ্চাশ মিনি্টের পুরোটা সময় বার বার নিরুর মনে ঘুরে ফিরে আসছিলো মা ছেলের দিনমান কাটিয়ে দেয়া ওদেরই গেট এর পাশে পথের ধারে। কখনো শুধুই ঝিম ধরে বসে থাকত দুজনে, কখনো ঘুমোতো, কখনো পা ছড়িয়ে মাথার উঁকুন মারত মা’টা আর বাচ্চা টা পথের ধুলায় নুড়ি পাথর দিয়ে হিজিবিজি আঁকতে থাকত। বাসায় বেঁচে যাওয়া দুপুর বা রাতের খাবার তসলিমাকে দিয়ে মা প্রায়ই পাঠাত ওদের, মিষ্টির পুরনো প্যাকেটে করে। খেত, মা-ছেলে, তাকাতো খেতে খেতে একবার উপরের দিকে মুখ তুলে, হয়ত বুঝতে চাইত, এই দয়ার কারন? পাগল মায়ের ঘোলাটে চেতনায় আর তার সন্তানের আধো উন্মুল বোধে উঠত ক্ষুধা নেভার খুশী । শীতের সন্ধ্যাগুলোয় একটা ছেড়া দুর্গন্ধ কাঁথায় নিজেদের পেঁচিয়ে জড়সড় বসে থাকত দুজন। দেখত অবলা চোখে, গলির ভিতরের ভাপা পিঠার সুগন্ধি দোকান আর সুখী মানুষের আনাগোনা, ভোরে মোটা রঙ্গিন কাপড়ে মোড়ানো খলবলে সুন্দর শিশুর দল মায়েদের হাত ধরে ওদের শিশিরে ভেজা ঘুমন্ত শরীর দুটো পেরিয়ে চলে যেত নানান স্কুলে, মানুষের মত মানুষ হতে। এই আজকের অনিলার মতো উজ্জ্বল মানুষ। নাহ, কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারছিল না ও, কিছুতেই না। আবার মনে পরে যায়, এই ঈদেই সারাদিন বাসায় মেহমানদারি শেষ করে বিকেলের দিকে যখন ওর বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাবে বলে বের হয়েছিল তখন ওদের মা বেটাকে দেখে রোদে ভাজাভাজা হয়ে উপুর হয়ে ঘুমাচ্ছে। শিশু মুখের এক পাশে এসে পড়া ঈদ বিকেলের সোনালী রোদে দেবশিশুর মত লাগছিল ছেলেটিকে, তাকিয়ে দেখেছিল ও । মানুষের পৃথিবীর সকল সৌভাগ্য বঞ্চিত হয়েও যেন ওই সোনা রোদ ওকে একটু করুণা করেছিল। আচ্ছা বাচ্চাটাকে কি কেউ তুলেছে ওখান থেকে? এতক্ষন কি আর ও পরে আছে ওই গর্তে?

ক্লাস শেষে অন্যদিনের মতো করিডোরের আড্ডায় দাঁড়াল না আজ, বের হয়ে সোজা রাস্তায়। রিকশা নিয়ে ফিরতে ফিরতে দেখে সারাদিনের ভ্যাপসা গরমের পরে সন্ধ্যায় ওঠা হালকা বাতাসে ফুলার রোডের শিরীষ গাছগুলোর চিরল পাতায় উঠেছে হিলিবিলি দোল, এ দোল ছড়িয়ে পরল ওর মনেও। নানান এলোমেলো ভাবনার সাথে একটা তিক্ত অপরাধবোধের অনুভবে মেরুদণ্ড শক্ত আর একটা জ্বালা জ্বালা ভাব মনে। কি দেখবে বাসার সামনে গিয়ে ? এক অব্যাক্ত ভয় ওর অস্তিত্বে, তথাকথিত সভ্যতার আর চিরন্তন মানবিকতার টানাপোড়েন নিয়ে অনিলা পার হতে থাকলো পলাশী, নীলক্ষেত, নিউ মার্কেট।

———————-
Tahsina
জীবনটা একটা নিরালা পুকুরের মতো, যার বুকে উঁকি মেরে আকাশ তার চেহারা’টা দেখে নেয়, সময় অসময়ে সবুজ গাছ নাইতে নামে। হিলিবিলি ছায়া কাঁপে তাঁর নিবিড় ছোট্ট ছোট্ট তরঙ্গে। সেই এতটুকু জীবনটা শুভ আর সুন্দরের খোঁজে কাটিয়ে দিতে চান তাহসীনা সাইফুল্লাহ্। দুটি সন্তানের সাথে তাঁদের শৈশব ভাগ করে নিয়ে এ.কে.এম.সাইফুল্লাহ্’র (২৯) সাথে তাঁর ছোট্ট নিটোল সংসার। নেশা পড়া, গান শোনা, আর পেশা ছাত্র পড়ান।

Share