[নোঙর 2016] ওয়ার্ডরোব ম্যালফাংশনঃ চেতনায় আর বেদনায়  -মিনার রশীদ (২১)

[নোঙর 2016] ওয়ার্ডরোব ম্যালফাংশনঃ চেতনায় আর বেদনায় -মিনার রশীদ (২১)

ওয়ার্ডরোব ম্যালফাংশন সভ্য দুনিয়ায়   সবচেয়ে কাঙ্খিত  একটি ‘অনাকাঙ্খিত – ঘটনা’ ।    নামীদামী  সেলিব্রেটি  নায়িকা এবং  গায়িকাদের ওয়ার্ডরোব ম্যালফাংশনের খবর প্রায়শই শুনতে পাওয়া  যায়।  তবে এই কিছিমের ম্যালফাংশন  আমাদের দেশে খুব একটা ঘটতে দেখা  যায় না ।  তবে  সেই  ক্লাইমেক্স  তৈরি হতে মনে হয় আর খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে  না।
এদেশে  ওয়ার্ডরোব ম্যালফাংশন  আপাতত কম হলেও রাজনীতিবিদদের পায়জামার ফিতার  ম্যালফাংশন বেশ কয়েকবার ঘটে গেছে। একই প্রকৃতির  তবে   ভিন্ন ব্যঞ্জনার দুটি  ম্যালফাংশন  পৃথিবীর দুই প্রান্তে  দুই ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করে বসে আছে। আপাতত এই সমস্যার  কোন সমাধাননেই। কারণ পশ্চিমা বিশ্বের সেলিব্রেটিদের যেমন তাদের গতরের বসনটি একটু শক্ত করে বাধার পরামর্শ দেয়া যায় না।  তেমনি ভাবে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের পায়জামার ফিতা খুলে গেলেও  অবসরে যাওয়ার পরামর্শটি রাখা যায় না।   আশা করি লেখার শিরোনামের সাথে বিষয়বস্তু খুব বেশি দূরে সরে যাচ্ছে না।  আমার একাডেমি জীবনের   একটা অম্ল মধুর স্মৃতির সাথে এই  প্রাসঙ্গিক বিষয়টি চলে এসেছে।  মেরিন একাডেমিতে যোগদানের পর   পরই পায়জামার ফিতা সংক্রান্ত এক ম্যালফাংশনের কবলে পড়েছিলাম। কাজেই মেরিনারদের ম্যাগাজিনে সেই স্মৃতিটুকু বর্ণনা করলে তার প্রতি অনেকেই আগ্রহী অথবা সহানুভূতিশীল     হবেন বলে আশা করছি।

ঠিক সময়ে এই পায়জামার  ফিতা লাগানো যে কত জরুরি,  তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম ।  মেরিন একাডেমিতে যোগদানের পূর্বে ফর্দ ধরে ধরে প্রয়োজনীয়  সব জিনিসপত্র  কিনেছিলাম । ফিতা  দিয়ে মেপে মেপে  সঠিক সাইজের স্টিলের কালো বাক্স কিনেছি যার কথা কোনদিন ভোলা যাবে না।   স্লিপিং স্যুট  , প্রেয়ার ড্রেস সবকিছু গুণে গুণে কিনেছি। প্রেয়ার ড্রেস কিনতে বেগ পেতে না হলেও স্লিপিং স্যুট কিনতে ঢাকার নিউ মার্কেটেও অনেক ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে। তখনকার টিভি  নাটকে নায়িকার বাবা কত  ধনী এবং চালচুলাহীন নায়কের কাছে বিয়ে দিতে কতটুকু অনীহা   তা দেখাতে গরমের দেশে শীতের দেশের এই স্লিপিং স্যুটটি  পরানো হতো।  এছাড়া এর   ব্যবহার অন্য কোথাও তেমন দেখা যেতো না।  প্রেয়ার ড্রেসের পায়জামা কিনলেও তার  ফিতাটি জায়গা      মত লাগানো হয় নি।  একাডেমিতে গিয়ে এটি আরাম করে লাগানোর ভাবনাটি  যেকত ভ্রম বলে পরিণত    হয়েছিল এবং একটা  করুণ রাগিণীর সৃষ্টি হয়েছিল  সেটা নিয়েই মূলত আজকের এই লেখাটি।

মেরিন একাডেমিতে যোগদানের পর      একাডেমির জেটি হেডে সিনিয়রদের মধ্যে  যে মুখটি প্রথম দেখি,  তিনি অত্যন্ত সজ্জন রেফায়েত ইবনে আমিন ভাই।  ক্ষুদ্র এ জীবনে  সবচেয়ে হৃদয়বিদারক  ও ভয়ংকর হুকুমটি প্রথম      শুনেছিলাম  –   তা  এই   রেফায়েত ইবনে আমিন ভাইয়ের কন্ঠনালী থেকেই বের হয়েছিল।  যে  কালো স্টিলের বাক্সটি দুই তিন জন শক্ত সামর্থবান মানুষ গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিলেন,  সেই আস্ত  ট্রাংকটি কিনা এখন আমাকে মাথায় নিয়ে   দৌড় দিতে হুকুম করেছে !   আগেই জেনে এসেছি এখানে  হাকিম নড়ে তো-  হুকুম নড়ে না।     আকাশের দিকে তাকিয়ে এই হৃদয় বিদারক হুকুমটির অমানবিক দিকটি নিয়ে  যখন  আনমনে ভাবছি,  তখন দেখি   সতীর্থদের  অর্ধেকের বেশি  হুকুমটি তামিল করা শুরু করে দিয়েছে।

বেহায়া সেই স্টিলের বাক্সটি নিয়ে  সুদীর্ঘ জেটি ও পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে  যখন ক্যাডেট ব্লকে পৌছেছি,     তখন চারকোনা বাক্সটি যে কত কোনা  হয়েছে তা মনে হয় বিখ্যাত  কোন গণিতবিদও গণনা করে বের করতে  পারতেন না।

আটচল্লিশ জন সিনিয়রদের গগনবিদারী চিৎকার,হু উইল উইশ মি  তার সাথে আরও  আটচল্লিশ জন  জুনিয়রের  ‘স্লামালিকুম স্যার’ মিলে মিশে সত্যিই এক ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। প্রথম সেই  রাতটিতে কখন বিছানায় আর কখন মেইন টপ, ফোর টপ গ্রাউন্ডে ছিলাম তা মালুম হচ্ছিল না। মাথার মধ্যে যতগুলি  সার্কিট ছিল,  প্রথম রাতেই মনে হলো তার আশি ভাগ অকেজো  হয়ে পড়েছে । সঙ্গত কারণেই  সারা শরীরে ব্যাথা অনুভুত হচ্ছে। মাথার তালুতেও ব্যথা। সকালে ঘুম ভাঙলে  হাত দিয়ে মনে      হলো,মাথার উপরের চুল সহ  খুলি উঠে আসছে।  চিৎকার দিতে যাবো এমনসময় চোখ মেলে দেখি, চিফ   ক্যাডেট ক্যাপ্টেন রেফায়েত ইবনে আমিন ভাই  বিছানার সামনে।  এবার বেশ মোলায়েম কন্ঠেই কী যেন   জিজ্ঞেস করেছিলেন। কাজেই আপাততঃ  চিৎকার না দিয়ে হাতটি চোখের সামনে   এনে দেখি, ভাবনামত   মাথার খুলি নয়- কিছু মাটি সমেত দুর্বা ঘাষ উঠেএসেছে  । শরতের  রাতে মাঠের মধ্যে  ফ্রন্টরোল দেয়ার     সময়  মাঠের মাটি ও ঘাষ মাথার তালুতে লেগে গিয়েছিল।

সে কি ভয়ংকর সময়। বাপের নামও ভুলে যাবার উপক্রম হয়েছিল।   রাতের বেলা যখন দ্রুম দ্রুম শব্দে    সিনিয়ররা ডরমেটরিতে ঢুকে যেতেন  তখন মনে হতো গল্পের হাউমাউ শব্দ করা রাক্ষসেরা এসে পড়েছে।    আমাদের জুনিয়র ব্যাচের এক ছেলে এমতাবস্থায়  একদিন সত্যি সত্যি  আজান দেয়া শুরু করে দেয়।
যাই হোক রাতের পর দিনটিও শেষ হয়ে গেলো।  জুনিয়র ক্যাডেটদের মাগরেবের নামাজের জন্যে পাঠানো হবে।  সারাদিনের শারীরিক কসরতের পর গোছল সেরে সবাইকে নামাজের জন্যে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া     হলো। ইউনিফর্ম খুলে প্রেয়ার ড্রেস  পায়জামা ও সাদা শার্ট পরতে হবে। তজ্জন্যে সময় বরাদ্দ হয়েছে  মাত্র এক দশমিক পাঁচ মিনিট। দুনিয়ার তাবদ  কাজের জন্যে সিনিয়ররা জুনিয়রদের  জন্যে এই সময়টি বেঁধে দিয়েছেন। ফলে সব জুনিয়র হয়ে পড়েছে-  ব্লাডি লাউজি জুনিয়র।   সঙ্গত কারনেই প্রমাদ গুণলাম। পায়জামার ফিতাটি লাগানো নেই।  বুঝতে পারলাম কী ভুলটি করে ফেলেছি। পায়জামার ফিতা  লাগানোর জন্যে এই সময় মোটেই যথেষ্ঠ নয়।  ফিতাটি যেহেতু সাদা পাঞ্জাবী  ও  গেঞ্জির নিচে থাকবে তাই তা পায়জামার ওপর দিয়ে রশির মত করে বেঁধে ফেললাম।  সহজ ভাবে সমস্যা   সমাধানের জন্যে  মিষ্টার বিনের মত বোধহয় একটু পুলকও অনুভব করেছিলাম।

কিন্তু বিধি বাম। আমার এই কড়িৎ  কর্মটি দেখে ফেলেন খুরশীদ হামিদ ভাই । অর্থাৎ যাকে বর্ণনা করা যায়- পড়বি তো পড় এক্কেবারে  মালির ঘাড়ে।   জুনিয়রদের নিয়ে নিত্য নতুন অনেক উদ্ভাবনী ক্ষমতা যাদের ছিল এই সিনিয়র ভাইটি তাদের অন্যতম  ছিলেন ।  তার বদান্যতায় পুরো ব্যাপারটি ভাইরাসের চেয়েও  দ্রুতগতিতে   সকল জুনিয়র সিনিয়রদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।  কী অভিনব কায়দায় পায়জামার ফিতাটি    লাগিয়েছিলাম  তা   সারা ক্যাডেট ব্লকে  মহা সাড়ম্বরে প্রদর্শিত হয়। তারপরের পরিস্থিতি এই ম্যাগাজিনের অধিকাংশ  পাঠকদের কাছে বর্ণনা করা  নিস্প্রয়োজন।
এই ধরনের অনেক টক-ঝাল-মিষ্টির  স্মৃতি নিয়ে মেরিন একাডেমি আমাদের অনুভবে ও সত্ত্বায় জড়িয়ে   আছে। তাই তো অনেক  ছয়  সাত বছরের ক্যাম্পাস জীবন যা দিতে পারে নি, মাত্র দুই বছরের সেই ক্যাম্পাস  জীবনটি মনে হয়  আমাদেরকে  অনেক বেশি দিয়েছে।
——————

Rashid_21
মিনার রশিদ (২১): প্রকৃত নাম আব্দুর রশিদ হলেও মিনার রশিদ নামেই সমধিক পরিচিত। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে তার লেখা কলামগুলি সুধীজনের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
 

Share