মেরিনার্স ডায়েরি ৮: মেরিনারদের আনন্দ-কষ্টের মিশ্র জীবন – আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (৪৭/ই)

মেরিনার্স ডায়েরি ৮: মেরিনারদের আনন্দ-কষ্টের মিশ্র জীবন – আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (৪৭/ই)

সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার এই সহাবস্থান আমাদের হয়তো একসময় অনুভূতিহীন-নির্বিকার করে দেয়। জাহাজে একটানা ৬/৯ মাস একটি পরিবারের মতো আমরা সবাই মিলেমিশে থাকি। একজনের প্রয়োজনে আরেকজন হাত বাড়িয়ে দিই। এরপর সেই জাহাজ ছেড়ে ফিরতে হয় ঘরে। এ সময় কষ্টের উল্টো দিকে যোগ হয় বাড়ি ফেরার সুখানুভূতি!

মেরিনারদের অনুভূতিগুলো একসময় কেমন যেন ভোঁতা হয়ে যায়! ঠিক যায় না, যেতে বাধ্য হয়।

বাড়ির প্রিয়জনদের ছেড়ে জাহাজে আসার কষ্টের অনুভূতির উল্টো দিকে আবার থাকে জাহাজে জয়েন করার আনন্দ। একইভাবে জাহাজে ৬/৯ মাস থাকার পর ভাসমান এই লৌহ কারাগারে গড়ে ওঠা পরিবারকে ছেড়ে আসার সময় যোগ হয় বাড়ি ফেরার সুখানুভূতি!

সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার এই সহাবস্থান আমাদের হয়তো একসময় অনুভূতিহীন-নির্বিকার করে দেয়। জাহাজে একটানা ৬/৯ মাস একটি পরিবারের মতো আমরা সবাই মিলেমিশে থাকি। একজনের প্রয়োজনে আরেকজন হাত বাড়িয়ে দিই। কে কোন দেশের, ধর্মের বা বর্ণের সেটার কোনো গুরুত্ব এখানে নেই। তখন জাহাজই আমাদের পৃথিবী, কাজই ধর্ম, আর সবার পরিচয় একটাই- মেরিনার!

প্রথম জাহাজে একটানা সাড়ে ১৫ মাস একটি পরিবারের অংশ হয়েছিলাম। সবাই যেন ভাই-ভাই! কত শত ঘটনা, সুখস্মৃতি, কত গভীর ভালোবাসা-আন্তরিকতা সবার সঙ্গে সবার। সেই ভালোবাসা-আন্তরিকতা এখনও অটুট!

এতটাই আন্তরিকতা যে, জাহাজ থেকে নেমে কারও কারও বাড়িতেও গিয়েছিলাম! কিন্তু সবাই মেরিনার হওয়ায় অনেকের সঙ্গেই সে সময় আর দেখা হয়নি। আমি যখন মাটিতে তারা তখন ছিলেন অন্য জাহাজে।

আমার প্রথম জাহাজ বাংলাদেশি ফ্ল্যাগের ‘ট্রান্সওশান প্রোগ্রেস’ পরিবারে ছিলেন কাউসার স্যার (ভাবী, ফাতিহা আর ফাজরী), আশরাফ স্যার, জাভিদ স্যার, শাহরিয়ার স্যার (ভাবী ও তানহা), আব্দুর রহমান স্যার, সালাহউদ্দিন রিয়াদ স্যার, জাহিদ স্যার, সাজেদ স্যার, আরিফ স্যার, মাজহারুল স্যার, মাসুদ স্যার, ঘানার চিফ অফিসার, পাকিস্তানের ক্যাপ্টেন কামাল আইয়ুব স্যার, ব্যাচমেট মাসুক-আরিফ-ফাহাদ, জুনিয়র জুবায়ের আর কবির, কামরুল ভাই, হিমু ভাই, শিমুল ভাই, এমদাদ-সুজন-রফিক-আনোয়ার-মান্নান-ফারুক সাহেবসহ আরও অনেকে।

এর পরের জাহাজে প্রায় ১৬ মাস কাটিয়েছি ভিন্ন এক পরিবারের সঙ্গে। নতুন করে গড়ে উঠেছিল আন্তরিক সম্পর্ক। ফিলিপিনো সংখ্যাগরিষ্ঠ এ পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যদের নামই আমাদের পক্ষে উচ্চারণ করা খানিকটা কঠিন। অ্যালেরিয়া, ন্যাচারাল, ডেনিস সাবাডুকুইয়া, মানানগান, গুজমান, আম্পারো, লেনডিও, সুয়ান, সলিটো, নালডোজা, রুসভেল্ট, অ্যালান ডিওনিও, মার্ক, যোসেফ, জেসি, রোনেল, লাবোস, তামায়ো, বিবি বয়, এলিপিও, উলডিং, মামুন, আজহার, কায়েস, শংকর, শাহরুক।

এর পরের জাহাজে আবার আরেকটি নতুন পরিবার, আবার নতুন নতুন অভিজ্ঞতা, সুখ-দুঃখের মিশ্র অনুভূতি। এভাবে একে একে পাঁচটি জাহাজে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন পরিবারকে পেয়েছি-হারিয়েছি। আগামীতেও এভাবে পাওয়া আর হারানোর খেলা চলতে থাকবে, যতদিন সমুদ্রের জলে বন্দি থাকছি।

অবশ্য বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে আজীবনের জন্য কাউকে হারাইনি। ঈদ, ক্রিসমাস, নিউ ইয়ার, দীপাবলির মতো উৎসবের সময় ফেলে আসা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এখনও কুশল বিনিময় হয়।

কিছুদিন পর ষষ্ঠ জাহাজের পরিবার ছেড়ে নিজের ঘরের পরিবারের কাছে ফিরব। আবার সেই আনন্দ-বেদনার মিশ্র অনুভূতি। জানি না একসময়ে এ মিশ্র অনুভূতি আর থাকবে কি না। হয়তো একসময় শুধু বাড়িতে ফেরার আনন্দ আর বাড়ি ছাড়ার কষ্টই কাজ করবে। তবে আমি চাই, আজীবন এ অনুভূতি বেঁচে থাকুক।

অনুভূতি-ভালোবাসাগুলো টিকে থাকুক আমার ডাঙার এবং জলের উভয় পরিবারের জন্যই।

মেরিনারদের আনন্দ-কষ্টের মিশ্র জীবন (newsbangla24.com)


লেখক: আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, এক্স-ক্যাডেট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি (৪৭তম ব্যাচ)

Share