ক্যাডেট সাহেবদের একাল সেকাল:জহুরুল হক (২১/ প্রকৌশল)

ক্যাডেট সাহেবদের একাল সেকাল:জহুরুল হক (২১/ প্রকৌশল)

বর্তমান যুগের ক্যাডেটদের দূরবস্থার কথা শুনে প্রাচীন যুগের ক্যাডেটদের অবস্থাটা কিঞ্চিৎ আলোকপাত করলাম, যদি তাতে বর্তমান ক্যাডেটদের মনোকষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়।

পর্ব ১ |১৯৮৬।
সুসান জাহাজে আছি ক্যাডেট পদে।
সে এক ভাঙ্গাচোরা লক্কড় ঝক্কড় জাহাজ। নানা আকারের ইঁদুর আর তেলাপোকার সাথে বসবাস। বেতন US$১১০.

ক্যাপ্টেন সাহেব চট্টগ্রামে এসে এক কুকুর এনে জাহাজে তুললেন। হাউন্ড, গ্রে হাউন্ড বা অ্যালসেশিয়ান নয়, স্রেফ এক নেড়ি কুকুর। আগ্রাবাদ বা রিয়াজুদ্দিন বাজারে এরা শুয়ে বসে দিন কাটায়। সে কুকুর আমার কেবিনের দরজার সামনে শুয়ে থাকে, ঘুমায়, হেগে মুতে ভরপুর করে রাখে। কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। যারা ডেক এ্যাকোমোডেশন ঝাড়ু দেয় তারা সেই কুকুরের গু ধরাছোঁয়া করে না। বলে, কুকুরের গু সাফ করা নাকি তাদের আর্টিকেলে লেখা নাই। কী আর করি, নিজের হাতে কুকুরের গু সাফ করি আর ক্যাপ্টেনের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করি।বসদেরকে রিপোর্ট করেও কোন ফলোদয় হয়না। একদিন স্টুয়ার্ড প্রচুর বাসি পঁচা খাবার কুকুরকে খেতে দিল। তাই খেয়ে সারারাত সেই কুকুর আমার কেবিনের দরজার সামনে খক্কর খক্কর করে বমি করল। সকালে উঠে এই অবস্থা দেখে রাগের চোটে কুকুরকে লাঠিপেটা করতে শুরু করলাম আন্ধাধূম। আমি মারি, কুকুর ঘ্যাঁক ঘ্যাঁক করে এলিওয়ের ভিতর দিয়ে দৌড়ায়। আমিও পিছু পিছু দৌড়াই আর কুকুরটাকে মারি। মারাটা মূল উদ্দেশ্য না, উদ্দেশ্য ছিল মারতে মারতে গ্যাংওয়ের দিকে বা মেইন ডেকে নিয়ে যাবো, তারপর কোনভাবে জেটিতে নামিয়ে দিব। কুকুরের চিৎকার শুনে চীফমেট ছুটে এলেন আমাকে সদুপদেশ দিতে শুরু করলেন। এই এই, কর কী কর কী, কুকুর মারলে কুকুর তোমাকে কামড় দিবে তো! সর, কুকুরের কাছ থেকে।
মেজাজ খারাপ করে কুকুর ছেড়ে ফিরে এলাম।

পরের ক্ষ্যাপে জাহাজ আউটারে যাওয়ার সময় দেখি কুকুরটা জাহাজের কোথাও নেই। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এর পরে আর কুকুরের গু, বমি পরিষ্কার করতে হয়নি। ক্যাপ্টেন মনেহয় ক্যাডেট কর্তৃক কুকুরের প্রহৃত হওয়ার খবর কেবিনে বসেই পেয়ে গেছিলেন। তাই ওয়াচম্যান দিয়ে অফলোড করে দিয়েছেন জাহাজ সেইল করার আগ মুহূর্তে।

এরপর এলো 31st নাইট ১৯৮৬। ঠিক রাত ০০:০০ আওয়ারে বড় একটা কেক কাটা হল। আমি রাত বারোটায় ডিউটি সেরে বয়লার স্যুট পরেই কেক কাটায় যোগদান করলাম। অফিসার ক্রু সবাই কেক খেলাম। শেষে বড় একটা টুকরা কেক বেঁচে গেল। সেই টুকরাটা কে খাবে কে খাবে যখন রব উঠল তখন ক্যাপ্টেন সাহেব রায় দিলেন বয়সে সবচেয়ে যে ছোট সেই খাবে কেকের লাস্ট পিসটা।

তারপর সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো উনার। বললেন, এই জহুরই হচ্ছে জাহাজের youngest boy. এসো, সামনে এগিয়ে এসে লাস্ট পিসটা তুমিই খাও।

বীরদর্পে এগিয়ে গেলাম, কেক তুলে মুখে নিলাম।
চারিদিক থেকে তালিয়া আর তালিয়া! জাহাজের বয়োকনিষ্ঠ ছেলেটি কেক খাচ্ছে বছরের প্রথম প্রহরে!

যাক, কুকুরের গু আর বমি সাফ করার দু:খ আজ কেক খেয়ে পুষিয়ে নিলাম। শুধুশুধুই কুকুর পোষার জন্য ক্যাপ্টেন সাহেবকে গালিগালাজ করেছি এতদিন। তিনি ক্যাডেটকে যে কুকুরের চাইতে কতটা বেশী ভালবাসেন তা আজ প্রমাণ করে দিলেন। ক্যাডেটের সুবিধার্থে তিনি প্রিয়তম কুকুরকে বিসর্জন দিয়েছেন।

কিন্তু আমার সুখে বাধ সাধলো আমার নটিক্যাল দোস্ত পরদিন সকালে।
বলল, ঐ ব্যাডা, আমার বয়স তোর থাইক্যা কত কম হবে, অথচ তুই শালা বয়স চোরা, তোরে দেইখ্যা বোঝা যায় না তুই আমার চাইতে বয়সে বড়। আসলে কেকপিসটার ন্যায্য হকদার আমিই ছিলাম।

আমি বললাম, কেক তো রাতে খেয়ে ফেলেছি; সেই কেক কিভাবে তোকে ফিরিয়ে দিয়ে তোর ন্যায্য হক আদায় করব? আচ্ছা ঠিক আছে, বলছিস যখন, অপেক্ষা কর কিছুক্ষণ, তোর ন্যায্য হক আদায় করার ব্যবস্থা করছি।


পর্ব ২ |১৯৮৭।
চট্টগ্রাম সিমেন্ট ক্লিংকার জেটিতে অবস্থান করছে কুখ্যাত জাহাজ সুসান। লাঞ্চ ব্রেক চলছে। ডেকে কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। সবাই লাঞ্চ খেতে গেছে বলেই অনুমিত হচ্ছে। বড় কর্তাব্যক্তিরা লাঞ্চ খতম করে স্টুয়ার্ডের হাতে বানানো এককাপ করে চা কি কফি হাতে নিয়ে খোশগল্পে মগ্ন। কেউ হয়ত সপরিবারে আছেন, তাঁদের খোশগল্প করার ফুরসত নাই, কেবিনের দিকে পা বাড়িয়েছেন। পরিবারকেও তো কিছুটা সময় দিতে হবে।

পাশেই নৌবাহিনীর জেটি। সেখান থেকে একটি নৌবাহিনীর জাহাজ বের হওয়ার পরপরই ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেল। স্রোতের টানে ভেসে আসছে সুসানকে ধাক্কা মারতে। নৌবাহিনীর অফিসার রিক্রুট সবাই ডেকে দাঁড়িয়ে আছে হতবিহ্বল হয়ে। কী করবে যেন বুঝে উঠতেই পারছে না।
নৌবাহিনীর জাহাজ এগোতে এগোতে সুসানের মাত্র মিটার খানেক দূরে আছে। দ্রুত সেই গ্যাপটা কমে আসছে। এক্ষুনি দুই সামরিক আর বাণিজ্যিক জাহাজে ধাক্কা লেগে একটা তুলকালাম কাণ্ড ঘটতে চলেছে!
এমন সময় সুসানের ডেকে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটতে দেখা গেল।
ডেক ক্যাডেট কামরুজ্জামান (FCC) ছুটছে সম্ভাব্য সংঘর্ষস্থলের দিকে, অর্থাৎ নৌবাহিনীর জাহাজ সুসানের ঠিক যেখানটায় গুঁতা মারতে চলেছে সেদিকে।
কামরুজ্জামানের কাঁধে একটা দড়ি দিয়ে বোনা ফেন্ডার। ফেন্ডারের ওজনে সে কুঁজো হয়ে গেছে। তবুও প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। তার দৌড়ের ভিতর এমন একটা লক্ষ্য আছে যেন তার এই প্রাণপ্রিয় সুসানকে সে যেমন করেই হোক রক্ষা করবে। গায়ে একটা আঁচড় লাগাতে দিবে না।
নৌবাহিনীর জাহাজ সুসানের গানেলের ঠিক যেখানটায় গুঁতা মারতে চলেছে ঠিক সেখানে ফেন্ডারটা বাগিয়ে ধরল জামান। দুই জাহাজের মাঝে চাপ খেয়ে বেলুনের মত চ্যাপ্টা হয়ে গেল ফেন্ডার। নৌবাহিনীর জাহাজ আস্তে করে থেমে গেল সুসানের গায়ে। একটা আঁচড়ও লাগলো না কোনো জাহাজে। ফেন্ডারটাকে একটা বুলহর্নের সাথে বেঁধেই জামান দৌড় দিল ফোরক্যাসলের দিকে। টেনিস বলের মত সাইজের দড়ি পাকানো লাইন ছুঁড়ে দিল নৌবাহিনীর জাহাজে। ওরা সেই লাইনের মাধ্যমে মুরিং রোপ পাঠালো, যা দিয়ে সুসানের বোলার্ডে বেঁধে নৌবাহিনীর জাহাজকে ভেসে যাওয়া থেকে রক্ষা করল ডেক ক্যাডেট কামরুজ্জামান।

তার এই অসম সাহসিকতাপূর্ণ কাজ সুসানের কোন বড় কর্তাব্যক্তিদের চোখে পড়ল কি না তা বোঝা না গেলেও কমপক্ষে অন্তত দু‘জনের চক্ষে এ ঘটনা সুপারম্যান মুভির মত ধরা পড়ল।
তাদের একজন হচ্ছে এক অতি উৎসাহী উৎস্যুক ইঞ্জিন ক্যাডেট, যে কিনা লাঞ্চের পর বোট ডেকে পায়চারী করতে করতে হঠাৎ স্থির হয়ে গিয়ে পুরা ঘটনাটি স্বচক্ষে অবলোকন করল।
‘সাবাস বাঘের বাচ্চা জামান ভাই‘ বলে হাততালি দিয়ে ফেলল আবেগে উত্তেজনায়!

চোখে ঝাপসা দেখছে ইঞ্জিন ক্যাডেট। পকেট হাতড়ে সাদা রুমালটা খুঁজছে সে। চোখ মোছা দরকার।


ধন্যবাদান্তে: জহুরুল হক, ২১/ প্রকৌশল

Share