[নোঙর 2016] ‘এম ভি আল রহমান’ এবং তার উদ্ধার কাহিনী: কাজী শাহাদাত হোসেন (১৬)

[নোঙর 2016] ‘এম ভি আল রহমান’ এবং তার উদ্ধার কাহিনী: কাজী শাহাদাত হোসেন (১৬)

একটি সমুদ্রগামী  জাহাজ ‘এম ভি আল রহমান’ বঙ্গোপসাগরে জলোচ্ছ্বাসে চরায় উঠে গেল এবং তার উদ্ধার কাহিনী……

আজ থেকে ২৪ বৎসর আগের কথা। ২৯ শে এপ্রিল ১৯৯১ সাল। ইতিহাসের পাতায় কালো রাত্রি হিসেবে চিহ্নিত। ২৯ শে এপ্রিলের সেই কাল রাত্রিতে ভয়ংকর এক জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকায় আঘাত হেনেছিল। মুহূর্তের মধ্যে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল উপকূলে গড়ে ওঠা বিভিন্ন জনপদ তথা সাগরতীরের গোটা এলাকা। নিমিষেই রুদ্রমূর্তিধারনকারী সেই জলোচ্ছ্বাসে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছিল সম্পদের। শান্ত প্রকৃতি যে হঠাৎ এমন ভয়ংকর রূপ ধারন করতে পারে তা আমি পূর্বে কখনও অবলোকন করিনি। প্রকৃতির সেই ভয়ংকর রূপটি আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল সেদিনের সেই রাত্রিতে। বাংলাদেশের খলিল এন্ড সন্স শিপিং লাইনের (কেএসএল) জাহাজ “আল রহমান” মংলা বন্দরে সিমেন্ট আনলোডিং করে চট্রগ্রামে কর্ণফুলির মোহনায় অবস্থিত সি ইউ এফ এল জেটিতে (সার কারখানার) ভিড়লো । জাহাজটি পুরাতন কিন্তু একদল কর্মঠ ও দক্ষ নাবিক এর পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। আমি সেই জাহাজের সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার। বেশী দিন হয়নি লন্ডন থেকে এসেছি ক্লাস ওয়ান শেষ করে। আশ্বাস দেয়া হয়েছে, এ জাহাজেই চীফ ইঞ্জিনিয়ার হবো। ১২তম ব্যাচের শ্রদ্ধেয় শামসুল আলম চীফ ইঞ্জিনিয়ার যিনি কোম্পানীর ইঞ্জিনিয়ার সুপারেনটেনডেন্ট। কোম্পানীর এই জাহাজ থেকে সাইন অফ করে তিনি অফিসে ইঞ্জিনিয়ার সুপারেনটেনডেন্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন।

“আল রহমান” জাহাজটি কেএসএল কিনেছিল জাপানের বিখ্যাত এভারেট লাইন থেকে। পূর্বের নাম এম ভি মারিয়া এভারেট। জাহাজটি ১৯৬৫ সালে তৈরী হয় । পুরনো হয়ে যাওয়ায় এভারেট লাইন জাহাজটি বিক্রি করে। কেএসএল কয়েক বৎসর জাহাজটি চালিয়ে কিছু মুনাফা অর্জন করে তারপর স্ক্র্যাপ করে। আমি সর্বপ্রথম জাহাজটিতে সাইন অন করলাম ২৮ অক্টোবর ১৯৯০ জাপানের এক পোর্টে। তখনও জাহাজটি মারিয়া এভারেট নামে চলছে। এভারেট লাইন জাপানীজ কোম্পানী, কিন্তু সমস্ত জাহাজগুলি ফিলিপিনো ক্রুদের দিয়ে পরিচালনা হয় । জাহাজ হ্যান্ডওভার হবে চট্রগ্রাম পোর্ট এ। আমি ওনার্স রিপ্রেজেন্টেটিভ এবং সুপারনিউমেরি হিসেবে জাহাজের ক্রু লিস্টে আছি। আমাকে ফিলিপিনো ক্যাপ্টেন ও অন্যান্য ক্রুরা আন্তরিকভাবে গ্রহন করছে। আমাকে যে কেবিন দেওয়া হলো, সেটি সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ারের কেবিন। একটু আশ্চর্য হলাম যে, বর্তমান সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার অন্য একটি ছোট কেবিনে থাকছেন। কয়েকদিন যাওয়ার পর আমাকে সত্য ঘটনাটি জানানো হলো। পূর্বের একজন সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার এই কেবিনে মারা গেছেন। তিনি সকালে ডিউটির জন্য আসছেন না এবং কেবিনের দরজাও খুলছেন না। অবশেষে মাস্টার কি দিয়ে তালা খুলে কেবিনে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। ফিলিপিনোরা খুব মদ্যপান করে। আগের রাতে পার্টিতে সে খুব মদ্যপান করেছিল। আমি কেবিনে রাতে দোয়া পড়ে ঘুমাতে যাই। কেবিনের এক কোণে জিসাসের ছবি, তস্বি ও মোমবাতি  জ্বালানো হতো। আমি ওগুলো সরিয়ে রাখি। ৫ মিনিটেই ঘুম এসে যায়। আমি বরাবরই সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী। এসবকে একটুও তোয়াক্কা করলাম না। ফিলিপিনো ক্রুরা জিজ্ঞেস করে, “তোমার ভয় লাগে না”? ওরা একে অপরের কাছে আমার সাহসিকতার প্রশংসা করে। ঐ কেবিনে আমি, আমার স্ত্রী ও ২ বৎসরের ছেলে মাসরূরকে নিয়ে ছয় মাস ছিলাম এবং তাদের ঘটনাটি বলিনি। আমার প্রথম একটি জাহাজে সেইল করছি যেখানে সব বিদেশী ক্রু এবং একমাত্র আমি বাংলাদেশী । এক মাস পর আমার এক ব্যাচ মেট সালেম সিকান্দার চীফ অফিসার হিসেবে হংকং থেকে জয়েন  করল। আমাদের খাওয়া দাওয়ার খুব অসুবিধা হত। হালাল মাংস না থাকায় সব্জির উপর নির্ভর করতাম। প্রত্যেক দিন লাঞ্চ ও ডিনারে ডিমভাজি খেতাম। ফিলিপিনো চীফ কুক আশ্চর্য হতো মুরগীর মাংস খাই না অথচ মুরগীর ডিম খাই। আমি তাকে বললাম, মাংস খাব যদি জীবটি ইসলামী নিয়ম অনুসারে কিল করা হয়। অবাক হতো আমার কথা শুনে।

“আল রহমান” সি ইউ এফ এল জেটিতে ৭০০০ টন ইউরিয়া সার লোড করবে নেপালের জন্য। আনলোডিং হবে কোলকাতা বন্দরে। প্রায় সাড়ে ৩০০০ টন সার ইতিমধ্যে লোড হয়েছে। ২৯ শে এপ্রিল সারাদিন আকাশ মেঘলা। রাত ৮টার খবরে শুনি ১০ নম্বর সিগনাল চট্টগ্রাম পোর্টের জন্য। ১০ টার খবর শুনব স্মোক রুমে গেছি। সেখানে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর আলম (১৩ সি) ও সার কারখানার জিএম। শুভেচ্ছা বিনিময় করে সোফায় বসলাম। টেলিভিশনে খবর শুরু হলো। খবরে আবারও ১০ নম্বর সিগনাল ও বাতাসের বেগ ইত্যাদির কথা বলল। ১১ টার দিকে জিএম সাহেবের গাড়ির ড্রাইভার এসে বললো, জেটিতে গাড়ি আর রাখা যাচ্ছে না। মনে হয় বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। জিএম সাহেব তাড়াতাড়ি বিদায় নিলেন। আমি স্মোক রুম ছেড়ে কেবিনে এলাম। কারও জানা ছিল না, বিশাল এক ভয়ংকর প্রাকৃতিক দূর্যোগের সম্মুখিন হতে চলেছি এবং ১০ নাম্বার সিগনালে প্রকৃতি এত ভয়াবহ রূপ  নিতে পারে। চীফ ইঞ্জিনিয়ার জাহাজে নেই এজন্য একটু সতর্ক থাকলাম। যে কোন সময় ইঞ্জিন চালানোর জন্য প্রস্তুত রাখা হল। রাত ১২ টায় ইঞ্জিনরুম থেকে টেলিফোন এলো। বার্মিজ থার্ড ইঞ্জিনিয়ার বললো, ইঞ্জিন মুভমেন্ট শুরু হয়েছে, ইঞ্জিনরুমে আসো। টেলিফোন ছেড়ে কেবিন থেকে বের হলাম। সব ক্রুরা একোমডশনের এক জায়গায় জড়ো হয়ে আছে। ডেকের উপর কারো যাওয়ার উপায় নেই। মনে হয় প্রবল বাতাসে উড়িয়ে নিবে। একজন ক্রু বলল, জাহাজের সামনে ও পিছনের বাঁধা রশিগুলি এক এক করে ছিঁড়ে গেছে। আমি দৌড়ে ব্রীজে গেলাম কি হচ্ছে দেখার জন্য। ক্যাপ্টেন আমাকে দেখালেন, শুধু দু’টি রশি দিয়ে জাহাজটি কোন রকম জেটির সাথে লড়াই করে টিকে আছে। ক্রুদের সামনে পিছনে রশিগুলি ঠিক করার জন্য পাঠালেন। কিন্তু বাতাসের বেগ এতো তীব্রতায় ওরা নিরুপায় হয়ে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসে। তাড়াতাড়ি ইঞ্জিনরুমে গিয়ে স্টাফদের বাহিরের অশান্ত ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানালাম।

আবার ইঞ্জিনরুম থেকে ব্রীজে এলাম। পূর্ন শক্তিতে ইঞ্জিনের মুভমেন্ট চলছে। জাহাজের পিছনের রশিগুলি সব ছিঁড়ে গেল। মাত্র একটা রশির সাহায্যে সামনের দিকে আটকিয়ে ছিল। ইঞ্জিন মুভমেন্টের সাহায্য নিয়ে জাহাজটাকে জেটির সাথে আটকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা। হঠাৎ বাতাসের বেগের তীব্রতায় পিছনের দিক কর্ণফুলিতে বের হয়ে আসলো। জাহাজ নাইনটি ডিগ্রিতে জেটির সাথে পজিশন হল। কিছুক্ষণ পর ঐ রশিটিও ছিঁড়ে গিয়ে জাহাজটি সজোরে কর্ণফুলির মাঝামাঝি চলে আসলো। কি ভয়াবহ ব্যাপার! কোথাও আঘাত লাগলে বড় ধরনের আগুন কিংবা বিস্ফোরণ হতে পারতো। প্রচন্ড বেগে আল রহমান কর্ণফুলি নদীর মধ্যে ড্রিফটিং শুরু করলো। ফুল স্পীডে ইঞ্জিন চালিয়েও দিক ঠিক রাখা গেল না। ক্যাপ্টেন জাহাজটিকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে চালিয়ে সাগরে পৌঁছানো চেষ্টা করলেন। বিশাল সাগরে চলাচলে দূর্ঘটনার কম সম্ভাবনা। ব্রীজ থেকে বাহিরে কোন কিছু দেখা যাচ্ছে না। ব্রীজের ভিতর থেকে বাহির হলে বাতাস উড়িয়ে নিবে। রাডারে জাহাজের পজিশনও আসছে না। কোনদিকে চলছে বোঝার উপায় নেই। তবে মাঝে মধ্যে ২ কিঃ মিঃ প্রান্তের এক দিকে সমুদ্রতীরের নেভাল একাডেমীর ও অন্য পাশের চট্রগ্রামের ড্রাইডকের আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। শুধু একই জায়গায় সামনে পিছনে চলছে আর বাতাস ও পানির ঝাপটার সাথে যুদ্ধ চলছে। এই সময়ে জাহাজের তলা কোন কিছুর সঙ্গে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে ছিদ্র হলে ডুবে যেতো। সেক্ষেত্রে জাহাজটি ত্রিশজন নাবিকসহ চোখের পলকে হারিয়ে যেতো জলোচ্ছ্বাসে। বাতাসে আগুনের ফুলকি দেখা গেল। পানির উচ্চতা ফুলে ফেঁপে উঠল স্বাভাবিকের তুলনায় ৩০-৩৫ ফিটের চেয়ে উঁচুতে।  বাতাসের বেগ বেড়েই যাচ্ছিল এবং নিম্নচাপের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর  হচ্ছিল। সর্বোচ্চ বাতাসের বেগ ১০০ থেকে ১৫০ কিঃ মিঃ / ঘন্টা। পোর্ট অথরিটির টাগবোট ও অন্যান্য সাহায্যকারী মালামাল জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেল। পোর্ট এলাকায় যে কোন জাহাজের চলাচল হয় একজন অভিজ্ঞ পোর্ট পাইলটের মাধ্যমে। অনেক জাহাজ কর্নফুলি নদীতে এদিক ওদিক ছূটাছুটি করছে। কোথায় পাইলট? কোথায় বা টাগবোট? কোন দিক নির্দেশনা ছাড়াই কর্ণফুলীতে চলছে আল্ রহমান। কখনও মনে হয়নি এই জীবনযুদ্ধে আমরা জয়ী হব। ক্রুরা ক্যাপ্টেনকে এবং উর্ধতন নাবিকদেরকে সাহায্য করে চেষ্টা করছিল কিভাবে জাহাজটিকে রক্ষা করা যায়। আমরা বিভিন্ন দোয়া ও কলেমা পড়ে নিশ্চিত মৃত্যুর প্রস্তুতি নিচ্ছি, সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছিলাম আর মৃত্যুর প্রতীক্ষা করলাম।

রাত ৩ টা। মনে হল জাহাজ একেবারেই নড়ছে না। সাধারন ফুল স্পিডের চেয়ে বেশী স্পিড দিয়ে জাহাজ নড়ছে না। জাহাজ নদীর চরায় আটকে গেছে। বাহিরে তখনও দেখার উপায় নেই। রাত চারটায় বাহিরে কাছেই একটা সাদা বিল্ডিং এর অংশ বিশেষ দেখা গেল। আর একটু সকাল হতেই দেখা গেল জাহাজটি আটকিয়েছে মেরিন একাডেমীর কর্ণফুলীর পূর্ব পাড়ের জেটির কাছে। সেই সাদা অংশটি ছিল জেটির গার্ডরুম। নদীতে জোঁয়ার প্রায় শেষ। একটা লক্ষণীয় ব্যাপার, সব জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে সাগরের পূর্ন জোঁয়ারের সময়। সকাল সাড়ে পাঁচটায় দেখা গেল জাহাজের আশে পাশে একফোটা পানি নেই। ততক্ষনে নদীতে ভাঁটা এসে গেছে। জাহাজটি নদীর চরায় আটকিয়ে গেল। এত বড় জাহাজ অক্ষত রইলো। ভাবতেই শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়।

সমুদ্রের উথাল পাতাল ঢেউয়ের মধ্যে পাড়ি দিয়ে দেশ বিদেশ গেছি। কিন্তু এ ধরনের অবস্থায় কখনও পরিনি। স্রোতের উপর নির্ভর করে নদীর পাড় ভাঙ্গা ও গড়া একটা নিয়মে চলে। পাড়ের যে অংশ গড়ে অর্থাৎ পলি জমে পাড়টি ঢালু হয় আর অন্যটি খাড়াভাবে মাটিতে ধ্বসে যায়। “আল রহমান” কর্ণফুলির পূর্ব পাড়ে মেরিন একাডেমির জেটির পাশে পলি জমা ঢালুতে আটকায়। জাহাজাটি খাড়া ধ্বসে যাওয়া পাড়ে আটকালে নির্ঘাত উলটে যেতো । আমার স্ত্রী ও আত্মীয় স্বজনরা আমাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিল। সি.ডি.এ আগ্রাবাদে স্ত্রী তার পিতার বাসায়। তিন তলা বিল্ডিং এর নিচের তলা। পানিতে ডুবে গেলে তারা ২য় তলায় উঠে গিয়ে প্রান বাঁচায়। দুদিন পর কোম্পানীর অফিস থেকে ওরা জানতে পারে আমি বেঁচে আছি। কিন্তু আমার জাহাজটি চরায় উঠে গেছে। আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল। ভালো কাজের ফল হিসেবে হোক বা যেকোন কারনে হোক, কোম্পানি আমাকে ২৯ শে এপ্রিল ১৯৯১ সন থেকে আল রহমান জাহাজের চীফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে প্রমোশন দিল। সমস্ত দুঃখ বেদনা ভুলে গিয়ে পুরো উদ্যমে কাজ শুরু করলাম। আমি সেই ভীতকর সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ারের কেবিন থেকে বের হয়ে চীফ ইঞ্জিনিয়ারের কেবিনে চলে এলাম। তারপর কোটি টাকা মূল্যের জাহাজটি কিভাবে উদ্ধার হল? কিভাবে আবার জাহাটিকে পানিতে ভাসানো হল? সে এক চমকপ্রদ কাহিনী।

নদীর চরে আটকে থাকা আল রহমান জাহাজকে আবার ভাসাতে হবে। জাহাজটিকে উদ্ধার করার তীব্র বাসনা জাহাজের প্রত্যেকটি ক্রুর মধ্যে। সমস্ত ক্রু এবং অফিসাররা যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। পাশাপাশি কেএসএল অফিসে আছেন মালিকদের এক ভাই টেকনিকাল ডাইরেক্টর আবদুল মালেক, যিনি একজন মেরিন চীফ ইঞ্জিনিয়ার (১২ সি) আমাদের দারুন ভাবে সাপোর্ট দিয়ে গেলেন।

ভাটার সময় জাহাজের নদীর দিকে ৪টা জায়গায় মাটি খুঁড়ে গ্রাউন্ড ট্যাকেল পুঁতে লম্বা তারের দড়ি দিয়ে জাহাজের মুরিং উইঞ্চের সাথে বেঁধে টানা দিয়ে রাখা হলো। তাতে পূর্ন জোয়ারের সময় জাহাজ আর চরার দিকে উঠবে না। জাহাজের আশে পাশে যেহেতু ভাটার সময় কোন পানি থাকে না। তাই পরীক্ষা করে দেখা গেল জাহাজকে ভাসাতে হলে জাহাজের তলায় পানি ঢুকাতে হবে। কিন্তু শক্ত মাটি কিভাবে সরানো যায়? ঠিক হল জাহাজের এক পাশ থেকে মাটি কেটে জাহাজের তলা দিয়ে অন্য পাশ পর্যন্ত খাল খনন করা হবে। এ রকমভাবে কিছু অংশ বাঁধ দিয়ে পুরো জাহাজটিকে ড্রাই ডকের স্লীপারের মত মাটিতে বসিয়ে রাখা হবে। প্রায় ৩০০ ফুট লম্বা ১০০ ফুট প্রশস্ত জাহাজের তলায় মাটি কাটা সহজ কথা নয়। গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে মাটি কাটার লোকজনের ব্যবস্থা হলো। চেয়ারম্যান প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ জন মাটি কাটার লোক সরবরাহ করে। ভাটার স্থায়ীত্বকাল ১২ ঘন্টা। এর মধ্যে ৮ ঘন্টা মাটি কাটা যায়। পানির গভীরতা পরিমাপক চার্ট পাওয়া গেল ১২ই জুন কর্ণফুলীতে পানির গভীরতা সবচেয়ে বেশী। সেদিন জাহাজটিকে ভাসানো হবে নির্ধারিত হল ।

নদীর বালুচরে আটকে থাকা জাহাজকে পানিতে ভাসাতে হবে। কিন্তু কিভাবে? সে এক রূপকথার গল্পের মত। ১৫০ – ২০০ জন লোক জাহাজের আশে পাশে প্রতিদিন মাটি কাটছে। অফিস থেকে প্রতিদিনের টাকা আসছে। স্থানীয় চেয়ারম্যান মাটি কাটা বাবদ টাকা প্রতিদিন জাহাজ থেকে নিচ্ছে। জাহাজ চরায় উঠে আছে, ক্যাশ টাকা রাখা নিরাপদ নয়। দরিদ্র গ্রামবাসীর মধ্যে তীব্র উৎসাহ উদ্দীপনা। কাজ খোঁজার জন্য অন্যত্র যেতে হচ্ছে না। জাহাজের তলায় মাটি কেটেই প্রতিদিনের রোজগার হয়। আমি ও জাহাজের চীফ অফিসার মোহাম্মদ আলী (বর্তমানে ক্যাপ্টেন, ১৬ ব্যাচ) একাধারে তত্ত্বাবধান করছি যাতে মাটি কাটার লোকগুলি কাজে ফাঁকি না দেয়। দিন দুয়েক মাটি কাটার পরে দেখা গেল তেমন একটা লাভ হচ্ছে না। পূর্ন জোয়ারের সময় প্রচুর পলি জমে মাটি কাটার জায়গাগুলি ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। জাহাজে ৩৯০০ টন সার আছে। জাহাজকে খালি করতে হবে যদি আবার ভাসাতে হয়। ১২ ঘন্টা পূর্ন জোয়ারের সময় জাহাজের জেনারেটর চালাই। রান্না বান্নার কাজটি সে সময় করা হয়। কোন বাংকার (জ্বালানি) নেয়া যাবে না জাহাজে। অতিরিক্ত ওজন দেয়া হলে আরও মাটিতে আটকিয়ে যাবে। শুধু প্রতিদিন ১২ ঘন্টা পূর্ন জোয়ারের সময় মাল খালাস হয়। ২৪ ঘন্টা এক নাগাড়ে কার্গো মাল খালাস করতে হবে। তা না হলে ১২ই জুন এর মধ্যে জাহাজকে খালি করা সম্ভব নয়। ভাটার সময় জেনারেটর কিভাবে চলবে? জেনারেটর ইঞ্জিন কুলিং করার জন্য ভাটার সময় পানি কোথা থেকে আসবে? একটা ব্যবস্থা নেওয়া হল। জাহাজের ফিটার ও ওয়েল্ডারকে ব্যবহার করলাম। ইঞ্জিন কুলিং ওয়াটার ওভারবোর্ড লাইনকে একটি বাল্ব সহ জাহাজের ফায়ার লাইনের সাথে সংযোগ করে দিলাম। জাহাজের পিছনের ডিপ ট্যাংক নং ৩ (পোর্ট এবং স্টারবোর্ড) পূর্ন জোয়ারে ভর্তি করলাম নদীর পানি দিয়ে। ভাটার সময়েও জেনারেটর চলল। জাহাজের জেনারেল সার্ভিস (জি এস) পাম্প ডিপ ট্যাংক থেকে পানি টেনে নিয়ে জেনারেটর ইঞ্জিন কুলিং শেষে ঐ পানি ফায়ার লাইনে পাঠিয়ে দেয়া হতো ওভার বোর্ড বাল্ব বন্ধ রেখে। ফায়ার লাইন থেকে সেই পানিকে জাহাজের মেইন ডেকে দুটো ফায়ার হাইড্রেন্ড খুলে ফায়ার হোজ দিয়ে ডিপ ট্যাংকে পানি ফেরত পাঠানো হতো। জোঁয়ার ও ভাটায় জেনারেটর চালাচ্ছি। জাহাজের যে কোন স্থানে পাওয়ার সাপ্লাই দেয়া সম্ভব হচ্ছে। জাহাজের উইঞ্চ চালিয়ে ডেরিক দিয়ে কার্গো আনলোডিং কাজ চলছে জোয়ার ও ভাটার সময়ে সমান তালে। কেএসএল এর ২৫০ টন ক্যাপাসিটির “নেপচুন” জাহাজটি ভাটার সময় ’আল রহমান’ এর এলোংসাইডে আসতো। জাহাজটির ফ্লাট বোটম ছিল। ফলে মাটিতে বসে গেলেও কোন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। কেএসএল এর ছোট জাহাজগুলো নেপচুন, জুপিটার ও ইউরেনাস, নাজমুন এবং কিং আল হেলাল পালাক্রমে ’আল রহমান’ থেকে ৩৯০০ টন কার্গো খালি করে নিল। এম ভি নেপচুন জাহাজটি ভাটার সময়ে আল রহমানের আনলোডিং এর ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখলো। উল্লেখ্য, কোম্পানির আরেকটি ছোট জাহাজ যার নাম ছিল “খলিল এন্ড সন্স” সেটি ২৯ শে এপ্রিলে কর্ণফুলিতে ডুবে যায়। সেটিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পূর্ন জোয়ারে জি এস পাম্প চালিয়ে নদী থেকে পানি নিয়ে ডিপ ট্যাংকগুলি ভর্তি করে নিতাম। ভাটার সময়ে আর একটি কাজ করে বাড়তি সুবিধা পাওয়া গেল। তাহলো, জাহাজের সামনের ডেকের একটি হাইড্রেন্ড খুলে ফায়ার হোজ দিয়ে হাই প্রেসার ওয়াটার জেট এর সাহায্যে মাটি কাটার জায়গা গুলো থেকে পলি দূর করা। এই কাজটি করে অনেক উপকার পাওয়া গেলাম। মাটি কাটার কাজও সহজ হলো। পলি মাটিও অপসারণ করা হলো এবং জাহাজের মাল খালাস করা হলো।

জাহাজের পিছনের দিকটা প্রোপ্রেলার রাডারসহ মাটিতে ডেবে আছে। সবার কাছেই মনে হল, জাহাজটি হয়তো একেবারেই আর পানিতে নামানো সম্ভব হবে না। হাই টাইড শেষ হয়ে গেছে। পানি অনেক নীচে নেমে গেল। একটি সুন্দর বুদ্ধি বের হল। জাহাজের প্রোপ্রেলার ভাটায় অর্ধেক পানিতে ডুবে থাকে। তখন ইঞ্জিন চালিয়ে রাখলাম খুব কম আর.পি.এম এ। প্রোপ্রেলারের ঘূর্ণায়নে পিছনের মাটিগুলি একটু একটু করে সরে গেল। আর আশে পাশের মাটিগুলি নরম গেল। মাটিতে বসে থাকা জাহাজে প্রচুর ভাইব্রেশন হল। ব্রীজ থেকে জাহাজের স্টীয়ারিং কে হার্ড পোর্ট থেকে হার্ড স্টার বোর্ড করতে পারলে বোঝা যাবে যে রাডারটি মাটিতে আটকিয়ে নেই। একটু একটু করে ইঞ্জিন চালিয়ে তার সাথে একটু একটু করে রাডারটিকে পোর্ট ও হার্ড স্টার বোর্ড করার তিন চারদিন পর জাহাজের পিছনটা ও রাডারটি সম্পূর্ন জমে যাওয়া মাটি থেকে মুক্ত করা সম্ভব হলো।

এরই মধ্যে আল রহমানে ইন্টারন্যাশনাল সেলভেজ এসোসিয়েশনের ক্যাপ্টেন জনসন এসে সরেজমিনে সবকিছু বেশ কয়েকবার দেখে গেলেন। লোকাল এক্সপার্ট ক্যাপ্টেন নূর আহম্মদ (২ ব্যাচ) বিভিন্ন সময়ে এসে জাহাজের বিভিন্ন দিক দেখে পরামর্শ দিলেন। আরেক পাকিস্তানি এক্সপার্ট ক্যাপ্টেন মাহবুব (তিনি মেরিন একাডেমীতে আমাদের শিক্ষক ছিলেন) এসে আমাদের সাথে জাহাজে দু’দিন থাকলেন। মাটি কাটা দেখার জন্য তিনি হাফ প্যান্ট পরে আমাদের সাথে কাদায় হেঁটেছেন এবং জাহাজের আশ পাশে ঘুরে দেখেছেন। সেটা আমাদের জন্য অনেক অনুপ্রেরণার ছিল।

২৯ শে এপ্রিলের রাত্রিতে জাহাজের কার্গো লোডিং চলাকালীন সময়ে আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেল। কার্গো হোল্ডের বিভিন্ন পন্টুন কাভার গুলো জায়গা মতো লাগানো যায়নি। সেগুলো জাহাজের পোর্ট সাইডে ডেকে রাখা ছিল। যার ফলে মাটিতে আটকানো অবস্থায় জাহাজের পোর্ট সাইডে দুই ডিগ্রী লিস্ট দেখাতো। ২ রা জুন। একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেল। রাত ১২ টার পর হঠাৎ সাইক্লোন হলো। কর্ণফুলী নদীর পানি আবার ফুলে ফেঁপে উঠলো। জাহাজের পাশে প্রচুর পানির মধ্যে ‘আল রহমান’ নিজে নিজেই ভেসে উঠলো। ক্যাপ্টেন জাহাজের ইঞ্জিন মুভমেন্ট দিয়ে কর্ণফুলির মূল স্রোতে নিয়ে আসার চেষ্টা করলো। আর সেটি জাহাজের জন্য বিপদজনক হয়ে গেল। পাশে পুঁতে রাখা গ্রাউন্ড ট্যাকেলের তারের দড়ি জাহাজের সামনে ও পিছনের মুরিং উইন্স-এ বাঁধা ছিল। পিছনে গ্রাউন্ড ট্যাকেলের তার প্রোপ্রেলার টিপ ক্ষতি করলো ও তিন টার্ন তার প্রোপ্রেলার রোপ গার্ড এর নিচে শাফ্টের উপরে পেঁচিয়ে গেল। এ যাত্রা জাহাজ উদ্ধার হল না। সকালে ভাটার সময়ে দেখা গেল রোপ গার্ড এর কিছু ক্ষতি হয়েছে। জাহাজের স্টাফদের দ্বারা রোপ গার্ডটি খুলে গ্যাস কাটিং করে তিন টার্ন তার প্রোপ্রেলার শাফ্ট এর উপর থেকে কেটে বের করলাম। রোপ গার্ডটি আবার মেরামত করে আগের মত যথাস্থানে বসিয়ে দিলাম। পরেরদিন সকালে চিটাগাং পোর্টের হারবার মাস্টার আমিরুল ইসলাম জাহাজে এলেন। প্রায় সমস্ত দিন ফুল স্পীডে ইঞ্জিন চালিয়ে বন্দরের দু’টি পাওয়ারফুল টাগবোট দিয়ে আল রহমান জাহাজকে অনেক টানাটানি করে পানিতে নামাতে পারলেন না।

১২ ই জুন। অবশেষে বহু কাংখিত সেই দিনটি এসে গেল। আবহাওয়া খারাপ। সারা আকাশ জুড়ে ঘনকালো মেঘের আনাগোনা। কালো কালো খন্ড খন্ড মেঘগুলি আকাশের এক দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্তে উড়ে চলেছে। সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। প্রকৃতি যেন অঝোরে চোখের পানি ফেলছে। কর্ণফুলিতে সবচেয়ে বেশী প্রায় ৩৬ ফুট পানি হবে। দুপুরে সেই শুভক্ষণটি এসে গেল। চট্রগ্রাম পোর্ট থেকে কোন সাহায্য পাওয়া গেল না। সাহায্যের জন্য কোন টাগবোটও এলো না। জাহাজের মধ্যে আছেন ক্যাপ্টেন জনসন, ক্যাপ্টেন নূর আহম্মদ সহ আরও অনেকে। জাহাজ একটু একটু করে এদিকে ওদিকে হেলছে দুলছে। জাহাজের সামনের উইঞ্চ দিয়ে গ্রাউন্ড ট্যাকেলের তারের মধ্যে টানা দেয়া মাত্র সোঁ সোঁ করে জাহাজটি নদীর মাঝে বেরিয়ে এলো।  সাথে সাথে নৌকাতে করে দুইটি দলকে পাঠানো হল গ্রাউন্ড ট্যাকেলের তার কেটে দিতে। তবুও সমস্যা একটা দেখা দিল। জাহাজ যখন মাটিতে বসা, তখন পোর্ট সাইডে দুই ডিগ্রী লিস্টে ছিল। জাহাজের ১৫টি পন্টুনকে স্টার বোর্ড ডেকে ট্রান্সফার করা হল। সম্পূর্ন পানিতে ভাসার সাথে সাথেই দেখা গেল জাহাজের স্টার বোর্ডে ১২ ডিগ্রী লিষ্ট। এদিকে গ্রাউন্ড ট্যাকেলের তার কাটা চলছে আর একেকটি পন্টুন পোর্ট সাইডে ট্রান্সফার হচ্ছে /।;এবং দুই ডিগ্রী লিস্ট কারেক্ট হচ্ছে। ইঞ্জিন চালানোর সাথে সাথেই জাহাজ চলা শুরু হয়ে গেল। গা শির শির করা অনুভূতিতে ভরে গেল সবার মন!  সে এক দারুন অনুভূতি!  আল রহমান জাহাজ ভেসে চলছে! সবাই একে অপরের সাথে হ্যান্ডশেক ও কোলাকুলি করে আনন্দ প্রকাশ করছে জাহাজের ব্রীজে। জাহাজ কি করে বঙ্গোপসাগরে যাবে? পাইলট কোথায়? কে দিবে দিক নির্দেশনা? রেডিওর মাধ্যমে জাহাজের ক্যাপ্টেন আনোয়ার (১৪ সি) পোর্টকে জানালেন। পোর্ট থেকে ক্যাপ্টেনকে ডাইরেকশন দিল। আল রহমান কর্ণফুলিতে দীর্ঘ ৩২ দিন আটকে থাকার পর ধীরে ধীরে বঙ্গোপসাগরের নদীর মোহনায় গিয়ে এ্যাংকোর করলো। এভাবেই সমাপ্ত হলো একটি দুঃসাহসিক অভিযানের।

আল রহমানের নতুন জীবন। চরায় আটকানো থেকে বের হয়ে বঙ্গোপসাগরে আল রহমান নোঙর করেছে। ভয়েজ প্লান অনুযায়ী নেপালের কার্গো কলিকাতা বন্দরে আনলোড করতে হবে। কেএসএলের ছোট জাহাজ নেপচুন, জুপিটার, ইউরেনাস, সানমুন ও কিং আল হেলাল একে একে আল রহমানের এলোংসাইডে আসলো। সমস্ত সারগুলি আল রহমানের বিভিন্ন কার্গো হল্ডে লোড হল।

চরায় আটকালে জাহাজের স্ট্রাকচারাল ফেইলিউরের সম্ভাবনা থাকে। আল রহমানের সেইলিং এর আগে সবকিছু চেক করে নিলাম। নতুবা সাগরে বিরাট কোন দূর্ঘটনা হতে পারে। জাহাজের সমস্ত ডাবল বটম ট্রাংকগুলির সাঊন্ডিং ভালভাবে চেক করা হলো। জাহাজের তলা ফুটো হলে ট্রাংকগুলিতে অনবরত পানির লেভেল বাড়তে থাকতো। ক্র্যাংকেস খুলে ইঞ্জিনের ভেতরটা ভাল করে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে নিলাম। আল রহমানের ইঞ্জিন ছিল: সুলজার আর. ডি. ৬৮ এবং তার হর্স পাওয়ার ৬৬০০। ইঞ্জিনের ক্র্যাংকশাফ্ট ডিফলেকশান নিয়ে নিলাম। জাহাজের মুরিং ও কার্গো উইঞ্চগুলি চেক করে নেয়া হল। চীফ অফিসার মোহাম্মদ আলী ডেকের কাজগুলি অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে করে নিলেন। দেড় মাস ধরে জাহাজের ইঞ্জিনের কুলিং ও লুব ওয়েল কুলারগুলি কর্ণফুলির কাদা পানি দিয়ে কুলিং হয়েছে। কুলারগুলির টিউব কাদা দিয়ে জ্যাম হয়েছে। সমস্ত ইঞ্জিনের কুলিং ওয়াটার কুলারের শেষ প্রান্তের কভার খুলে পরিষ্কার করে নিলাম।

২৯ শে এপ্রিল থেকে ১২ ই জুন পর্যন্ত সবাইকে অমানুষিক পরিশ্রম করলো। ১২ তারিখে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ভিজতে হলো। গত দেড় মাসে এতটুকু বিশ্বাম নিতে পারিনি। সব সময় বিভিন্ন কাজের প্ল্যান তৈরী হত। এটা করতে হবে, ওটা করাতে হবে। জাহাজ ভেসে যাওয়ার কাজটি সমাধান হয়ে যাওয়ার পর শরীরটা আর কোন বাধা মানলো না। প্রচন্ড জ্বর আর ঠান্ডায় বুকটা জাম হয়ে যাওয়ার কারনে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। এদিকে অফিস থেকে ভিএইচএফ. এ ইঞ্জিনিয়ার সুপারেনটেডেন্ট বিভিন্ন নির্দেশনা দিতে থাকলেন। কিভাবে লগবুকে ঘটনাগুলি এন্ট্রি দিতে হবে। চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে অসুস্থ হলে চলবে না। অনেক কষ্ট করে লগ বুকের তথ্যাদি ঠিক করলাম। অফিস লগ বুকের ফটোকপি ও বিভিন্ন সব তথ্যাদি ইন্সুরেন্স কোম্পানিকে পাঠালো । আমরা কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম ১৯৯১ সালের জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে।

চট্রগ্রাম থেকে দু’দিনের প্যাসেজে কোলকাতা পৌঁছালাম। সী প্যাসেজে একটা বড় সমস্যা ধরা পড়লো। প্রপেলার শাফ্টের স্টার্ন টিউব থেকে লুব ওয়েল লিক করছে। দারুন একটা দুঃশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলাম। কোলকাতা বন্দরের ভেতরে থাকা অবস্থায় নদীতে কিংবা ডকের ভেতরে জাহাজ থেকে লুব ওয়েল বের হলে পানি দূষিত হবে। পানি দূষণের জন্য জাহাজের জরিবানা হতে পারে। এমনকি চীফ ইঞ্জিনিয়ারের জেল হতে পারে। এসব চিন্তা করে একেবারে নাওয়া খাওয়া কোন কিছুতেই ভাল লাগছে না। এ্যাংকারেজে পৌঁছার পর জাহাজ বন্ধ অবস্থায় লুব ওয়েল লিক কমেছে। কোলকাতা থেকে কোম্পানির অফিসে ব্যাপারটা জানালাম। জাহাজ চরায় উঠায় প্রোপ্রেলার শাফটের উপরে চাপ পড়েছে। দেড় মাস ধরে পুনরায় ভাসানোর জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালানোর সময় স্টার্ন টিউবের পিছনের দিকের সিলগুলির ক্ষতি হয়েছে। জাহাজ চললে লিকটা বাড়ছে, প্রতিদিন সী প্যাসেজে লুব ওয়েল লিকের পরিমাণ ৩০-৫০ লিটার।

খালি জাহাজ। কোলকাতা থেকে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে রওয়া। অফিস থেকে খবর এলো, কোন ড্রাই ডক খালি নেই। একটা ভয়েজ করতে হবে। ইন্দোনেশিয়ার পাডাং থেকে সিমেন্ট লোড করে মংলা পোর্টে আনলোড করলাম। একই ধরনের ভয়েজ বহুবার করেছি এ জাহাজে ২৯ শে এপ্রিলের আগে। স্টার্ন টিউবের লিকটি খুব সাবধানার সাথে সামলিয়ে পাডাং টু মংলা ভয়েজ শেষ হল।

’আল রহমান’ এর ড্রাইডক হবে সিঙ্গাপুরের জুরোং শীপ ইয়ার্ডে । ড্রাই ডক খালি না হওয়ায় আরও একটা ভয়েজ করতে হবে।  ভারতের কাকিনাডা বন্দর থেকে চালের ভূষি লোড করে ফিলিপাইনের ম্যানিলাতে আনলোড করা। কাকিনাডা বঙ্গোপসাগর ঘেষে ভারতের অন্ধ্রো প্রদেশের একটি বন্দর। দূর্গন্ধযুক্ত ভূষি নিয়ে ম্যানিলার বহিঃনোঙ্গারে বেশ কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হলো। কাকিনাডা টু ম্যানিলা যেতে আল রহমানের স্টার্ন টিউবের অনেক লুব ওয়েল লিক হল। জাহাজের গতি কমেছে। ইঞ্জিনে জ্বালানি তেল খরচ বেশি হচ্ছে। জাহাজের পিছনে প্রচুর কম্পন হচ্ছে। অফিস থেকে জানালো, আরও একটি পাডাং টু মংলা ভয়েজ শেষ করে তারপর ড্রাই ডক হবে। জাহাজের স্টিয়ারিং থেকে রাডারের রেসপন্স টাইম একটু বেশি হয়ে গেছে। ওদিকে স্টার্ন টিউব লুব ওয়েলের ওভার হেড ট্যাংকে তেল নেয়া হচ্ছে আর লেভেল কমে যাচ্ছে। প্রতি লিটারের দাম ইউএস এক ডলার। সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক একটা বুদ্ধি বের করলো। সে ওভারহেড ট্যাংকের লেভেল একদম কম রাখলো। তাতে একটা ফল পাওয়া গেল। লিকটা পাঁচ ছয় লিটার কমে গেল। সকালের ওয়াচের পর খবরটা জানালো। ওভারহেড ট্যাংকে নতুন তেল যা ছিল সব দেয়া হল। জাহাজের পুরনো বিভিন্ন গ্রেডের যত লুব ওয়েল ছিল, সেগুলি ব্যবহার করা হল। সবচেয়ে ভয়ের কারন, প্রোপ্রেলার শাফটের স্টার্ন টিউব খালি হয়ে গেলে পানি ঢুকে যেতে পারে জাহাজের ভেতর। নতুন তেলগুলি পাম্প করে ওভারহেড ট্যাংকে তোলা সহজ ব্যাপার। কিন্তু অন্য গ্রেডের তেল সাত লিটার বাকেটে করে তোলা ঝামেলার ও কষ্টকর। চালু জাহাজে তেল বাকেট দিয়ে তুলতে তুলতে গ্রীজাররা হাঁপিয়ে উঠছে। অজানা একটি শংকা তাড়া করছিল। যদি স্টার্ন টিউব দিয়ে পানি ঢুকে যায় ইঞ্জিনরুমে ? তাহলে জাহাজটি নির্ঘাত ডুবে যাবে। এভাবে সিঙ্গাপুর ড্রাই ডক আসা পর্যন্ত আল রহমানের স্টার্ন টিউব থেকে প্রায় ৯০০০ লিটার লুব ওয়েল লিক করলো।

জাহাজ ড্রাইডকে উঠলো। ড্রাই ডকে আল রহমানের প্রধান যে কাজগুলি হবে তা হলো জাহাজে তলার যে অংশটুকু পানিতে ডুবে থাকে তা ভাল করে দেখে নেওয়া। প্রোপ্রেলার ও তার শাফ্ট বের করে স্টার্ন টিউবের বিয়ারিং ও সীল গুলি চেক করা। শীপ সাইডে যে সমস্ত ওভারবোর্ড ও সি সাকসান বা ডেলিভারী বাল্ব কাজ করছে না, সেগুলি ওভার হলিং করা। রাডারের ওয়াটার টাইটনেস চেক করা। জাহাজের আউট সাইড ষ্টিল প্লেটের গ্রীট ব্লাসটিং করে পেইন্ট করা। জাহাজের এ্যাংকার ও চেইন লিংকগুলি চেক করা। আগেই বলেছি, মালিকরা ১৯৬৫ সালে তৈরী জাহাজটি বেশি দিন চালাবেন না। সুতারাং যে কাজ না করলেই নয়, সে কাজগুলি ড্রাই ডকে করানো হলো। আমি জাহাজের ইঞ্জিনরুম স্টাফদের দিয়ে অনেক কাজগুলি করালাম। মেইন ইঞ্জিনের দুই ইউনিটের ক্রস্ হেড বিয়ারিং খুলে স্পেয়ার লাগলাম। বিয়ারিং এর নিচের অংশে ক্ষতি হয়েছিল। সিঙ্গাপুর ওয়ার্কশপে রি-মেটালিং হয়ে আসলে পরে ইঞ্জিনে লাগানো হবে। একজোষ্ট গ্যাস বয়লারে টিউব লিক ছিল। জাহাজের ওয়েল্ডারকে দিয়ে সেগুলি মেরামত করালাম। লন্ডনে থাকেন এক বাংলাদেশী সিনিয়ার মেরিন চীফ ইঞ্জিনিয়ার। ওনার নামটা মনে আসছে না। তিনি সিঙ্গাপুরে জাহাজের ইঞ্জিনিয়ার সুপার হিসাবে কাজ করলেন । জাহাজের ড্রাইডকের কাজগুলি তদারকি করলেন। জাহাজের প্রোপেলার ড্রাই ডকে নামানো হল। প্রোপেলার টিপসগুলির খুব বাজে অবস্থা। মাটি কাটায় ব্রাসের তৈরী প্রোপেলারটার ক্ষতি হয়েছিল। স্টার্ন টিউবের ভিতরটা খুব ভাল করে চেক করে নিলাম। জাহাজের পিছনের স্টার্ন টিউবের সিলগুলি ভাল অবস্থায় ছিল না। সীল লাইনার ডিম্বাকৃতির হয়ে গেছে। যার দরূন সীলিং হোতনা এবং লুব ওয়েল লিক করতো।

আল রহমানের সব কাজগুলি একে একে শেষ হল। কিন্তু রাডার গ্রীট ব্লাসটিং করতে যেয়ে দেখা গেল, রাডারের প্লেট ফুটো হয়ে যাচ্ছে। রাডারের হার্ড পোর্ট টু হার্ড স্টারর্বোড যাওয়ার ধীর গতির রেসপন্সের মুখ্য কারন ছিল – রাডারের প্লেট ফুটো হয়ে ভিতরে পানি ঢুকে পরা। প্রোপেলারের টিপ খুব সুন্দর করে বিল্ড আপ করা হলো। জাহাজের স্টার্ন টিউবে নুতন সীল ও লাইনার দেয়া হল। পুরো স্টার্ন টিউবের ভেতর প্রপেলার এবং প্রপেলার শাফ্ট নির্দিষ্ট জায়গায় বসার পর লুব ওয়েল ভরে নিলাম। ইঞ্জিনরুম থেকে টার্নিং গিয়ার দিয়ে প্রপেলার শাফ্ট কে ঘুরিয়ে দেখলাম। কোন লুব ওয়েল লিক করছে না। ড্রাই ডক থেকে নেমে আল্ রহমান নতুন জীবন লাভ করলো। জাহাজ চালু অবস্থায়ও স্টার্ন টিউব থেকে কোন তেল করলো না। জাহাজের স্পীড আগের থেকে ভাল হয়েছে। আল্ রহমান সমুদ্রের ঢেউয়ের তালে তালে পংখীরাজের মত পথ চলা শুরু করলো।

————————–

Kazi Shahadat_16

কাজী শাহাদাত হোসেন। ১৬ তম ব্যাচ/ইঞ্জিনিয়ার ’১৯৮১ মেরিন একাডেমী।। ক্লাস (ওয়ান) মেরিন ইঞ্জিনিয়ার (ইংল্যান্ড)। প্রাক্তন চীফ ইঞ্জিনিয়ার, এনওএল/সিঙ্গাপুর। এমবিএ (কানাডা)। সী কেরিয়ারঃ বিএসসি (১৯৮২-১৯৮৬), বাংলাদেশ প্রাইভেট শিপিং লাইনস (১৯৮৭-১৯৯২), এনওএল (১৯৯৩-১৯৯৮) । বহুজাতিক কোম্পানি পান্ডেকার এনার্জি, মালেয়শিয়ার বাংলাদেশে অবস্থিত ১১০মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্টে ১৯৯৯ সন থেকে কর্মরত। ছাত্রজীবন: খিলগাও গভঃ হাই স্কুল, ঢাকা। এসএসসি ১৯৭৭ । ঢাকা রেসিডেন্টসিয়াল মডেল কলেজ,এইচএসসি ১৯৭৯। বিভিন্ন প্রত্রিকা ও ম্যাগাজিনে লেখেন। উল্লেখ্য তার ”মেরিনার লাইফ”নামে একটি বই ২০১৪ সনের বইমেলায় নন্দিতা প্রকাশ বের করেছে।

Share