[নোঙর 2016] ফেইসবুক স্ট্যাটাস : আতিক উল আযম খান (২৭)

[নোঙর 2016] ফেইসবুক স্ট্যাটাস : আতিক উল আযম খান (২৭)

এক টুকরো বাংলাদেশঃ
মতিঝিল হতে উত্তরা যাব। ১ম বারের মত বিআরটিসি এসি বাসে চড়ে বসলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই অমূল্য অভিজ্ঞতা হল। বাস প্রায় খালি ছিল। ফার্মগেটে পৌঁছতেই বাস প্রায় ভরে গেল। শীতের বিকেল, হালকা শীত শীত ভাব। খুব দ্রুতই বাস যাত্রীরা ৩ ভাগে ভাগ হয়ে গেল।
১/ ১ম দলঃ
– ভাই, এসি বন্ধ করেন।
– ঠাণ্ডায় জমে গেলাম, ফাইজলামি করেন!
– উত্তরমেরুতে আইসা পড়ছি। জলদি বন্ধ করেন।
– এত ঠাণ্ডা জানলে কম্বল নইলে জ্যাকেট নিয়ে আসতাম।
২/ ২য় দলঃ
– এসির বাতাস খাইতে এসি বাস চড়ছি, আপনাদের বকবক বন্ধ করেন।
– এসি বন্ধ করলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাব, খবরদার চালু রাখেন।
– আপনেগো এসি বাসে চড়তে কে বলছে? ভালো না লাগলে নামেন।
– ৫৫ টাকার টিকেট, এসি বন্ধ করলে টাকা ফেরত দিবি কইলাম।
৩/ ৩য় দলঃ বিবিধ শ্রেণী !!
– এই সুপারভাইজার এসি কমা বলতেছি।
– ওই ড্রাইভার, তোর কন্ট্রোলার কাজ করে না ক্যান?
– আপনারা চুপ করেন, বাসে ঝগড়া করতে উঠছেন !!
– ধুর মিয়া, দুনিয়াতে ও শান্তি নাই। বাসেও শান্তি নাই !!
বিভক্তি আর মতবৈষম্যে বাঙালি অদ্বিতীয়। সামান্য বাসের এসি নিয়েই এত মত পার্থক্য। ধৈর্য আর মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা আমাদের চরিত্রে নেই।

দেশের যে কোন ইস্যুতে কেউ যে একমত হয়না, অবাক হবার কিছু নেই !!

দৌড়ঃ
শিহাবকে আজ গতির নেশায় পেয়েছে। মাত্র মাস দুই হল জন্মদিনে বাবার কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছে নতুন মডেলের পোরশে গাড়িটা। কিন্তু অফিসে কাজের চাপে নিজে ইচ্ছামত চালাতে পারেনি। বাবার কর্পোরেট হাউজটায় গ্র্যাজুয়েট হয়েই যোগ দিয়েছে, এখনো ট্রেনিং শেষ হয়নি। ধনীর সন্তান হলেও সুশিক্ষিত আর ভালো স্বভাবের ছেলে শিহাব।

শুক্রবার রাতে বনানীর এই রাস্তাটা একটু সুনসান থাকে। ডিনারের পর বেরিয়েছে গতির ঝড় তুলতে। জোরে চালালেও চারিদিকে খেয়াল রাখছিল শিহাব। রাস্তার দুই পাশে অনেক এপার্টমেন্ট। এগুলো হতে মানুষজন আর গাড়ি ও বেরিয়ে আসছে। একটা রাস্তা দিয়ে যাবার সময় হটাত গাড়িতে একটা পাথরের ছোট টুকরা এসে পড়ল। জোরে ব্রেক চাপল কষে শিহাব……।। ব্যাক গিয়ার দিয়ে ২০ গজ পিছিয়ে দেখল একটা ছোট ছেলে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে। গাড়ি হতে নেমে গটগট করে হেঁটে বামদিকের বডি চেক করল শিহাব। পিছনের দরজায় একটা ছোট ডেনট, রঙ উঠে গিয়ে অল্প ভিতরে ঢুকেছে পাথরের আঘাতে। নতুন পোরশের এই দাগ দেখে মাথায় রক্ত উঠে গেল শিহাবের। কিছু না ভেবেই ১০-১২ বছরের ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে পাশের এক গাছের সাথে চেপে ধরল।

চিৎকারে গলার রগ ফুলে গেল শিহাবের।
– এই তুই পাথর মারলি ক্যান? এখন এটা ঠিক করার টাকা দিবি তুই। বুঝছিস, যত টাকা লাগে দিবি। তোর বাপ কই?

ছেলেটা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “কোন উপায় না দেখে মেরেছি ভাইয়া, মাফ করে দেন। কেউ থামছিল না। কারো হাতে সময় নাই। আমার ছোট ভাই পড়ে গেছে, উঠাতে পারছিনা। বাসা থেকে একটু দূরে চলে আসছিলাম। ওকে একলা ফেলে কাউকে ডাকতেও যেতে পারছিনা। আপনি একটু উঠিয়ে দেবেন?”

শিহাব থতমত খেয়ে দেখল অদুরেই একটা ৮-৯ বছরের ছেলে হুইল চেয়ার থেকে পড়ে কাত হয়ে আছে। হাঁটু ছিলে হালকা রক্ত ও বেরোচ্ছে। সম্ভবত কাঁদছেও। শিহাবের মন অনুশোচনায় ভরে যাচ্ছে। কারন জিজ্ঞেস না করেই ছেলেটাকে মারা ঠিক হয়নি। হেঁটে গিয়ে পঙ্গু ছেলেটাকে তুলে বসিয়ে দিল হুইল চেয়ারে। পকেট হতে রুমাল বের করে হাঁটুর রক্তটা মুছে দিল আদর করে। ভালভাবে দেখল আর কোথাও কোন সমস্যা আছে কিনা। পিচ্চি দুজনের মুখেই হাসি ফুটল। তারা ধন্যবাদ দিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা দিল।

সেই হাসি দেখে শিহাবের মনটা ভাললাগায় সিক্ত হয়ে উঠল। এত খুশি সে পোরশের চাবি পেয়েও হয়নি। গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, কাউকে উপকার বা সাহায্য করার আনন্দ আসলেই অন্যরকম।
শিহাব তার গাড়ির দাগটা আর কখনই ঠিক করেনি। দাগটা প্রতিদিন তাকে মনে করিয়ে দেয়, যে জীবনে এত দ্রুত দৌড়ানো ঠিক নয়। যাতে আশপাশের মানুষকে ওকে থামানোর জন্য বা সাহায্য চাওয়ার জন্য পাথর মারার দরকার না হয়।

মরালঃ
১/ আমরা নিজেদের নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি বা জড়িয়ে যাই যে আর কারো খবর নেয়ার সময় পাইনা। আশপাশের মানুষজনের জন্য হাতে সময় থাকে না।
২/ আর পুরো পরিস্থিতি না বুঝেই আমরা প্রতিক্রিয়া দেখাই বেশির ভাগ সময়। অন্যের বক্তব্য শুনলে পরিস্থিতি হয়ত ভিন্ন হত বা আমাদের বিচার ও অন্যরকম হত।
৩/ রাস্তায় কাউকে পড়ে থাকতে দেখে বা হাইওয়েতে দুর্ঘটনা দেখে আমরা কজন দাঁড়াই, একটু বুকে হাত দিয়ে বলেন তো?

(বিদেশি ঘটনার ছায়া অবলম্বনে)

বাসের মধ্যে সাপঃ
God Damn! Oh Shit!! Snake bit me. I will be dead! I will be dead!!
কক্সবাজার থেকে বাস ছেড়েছে ঘণ্টাখানেক হল। এখনো দুইপাশে পাহাড়ি এলাকা। প্রচুর গাছপালা। সাপখোপ থাকা বিচিত্র নয়। যদিও বাসে সাপ কি আগে হতেই লুকিয়ে ছিল নাকি কারো ব্যাগ হতে বের হয়েছে নিশ্চিত না।

চিৎকারটা এসেছে বাসের মাঝামাঝি সিট হতে। আমার দুই সিট পরে। চিৎকারটা শুনে অনেকের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। কয়েকজন সিট হতেই উঠে দাঁড়ালেন। সামনের সিটের এক ভদ্রলোক লাফ দিলেন,
– এই থামা, থামা। বাস থামা। সাপ আছে বাসে শুনিস নাই?
২য় সারির একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন পিছনে আসার জন্য,
– ছেলেটার সাহায্য লাগতে পারে। কি সাপ কি জানি। আর কোন সাড়া শব্দ ও শুনছি না। মরে টরে গেল নাকি।
উনার পাশের ভদ্রমহিলা খপ করে উনার হাতটা ধরে ফেললেন,
– বসো। এত হিরোগিরি করতে হবে না। সাপের কামড় খাবার শখ হইসে? এই সুপারভাইজার, বাস থামায় না কেন?
আতঙ্ক সাধারনত সংক্রামক হয়। অনেকে উসখুস শুরু করলেন। ২/৪ জন বাস থামার জন্য চেঁচামেচি। আমি ছেলেটার এক হাত দেখতে পাচ্ছি। নড়তে দেখে সাহস পেলাম। বেশ ভালই নড়ছে। সাপের কামড়ের পর বিষের প্রভাব নয়তো?
ছেলেটার অন্যপাশের সিটের লোকজনের তেমন রিয়েকশন নাই। ওদের ও কামড়াল না তো? সাহস করে উঠেই পড়লাম। ছেলেটার সামনে গিয়ে দেখি,
কানে হেডফোন। আশপাশে কি হচ্ছে খবর নাই। স্মার্ট ফোনে সে স্নেক গেম খেলতেছে। সেই স্নেকের কামড়েই এত চিৎকার !!
ডিজিটাল ছেলেমেয়ের যুগ !!

সাড়ে তিন হাত এপার্টমেন্টঃ
মসজিদ হতে বেরিয়ে হাঁটছি। পিছন হতে একজন ভদ্রলোককে পরিচিত মনে হল। একটু দ্রুত পা চালিয়ে ধরলাম।
– শরিফ ভাই, আস সালাম ওয়ালাইকুম। আমাদের পাড়ায় কবে আসছেন? আপনার ফ্ল্যাট তো মনে হয় রেডি। অনেক ইনটেরিওর এর কাজ ও হয়েছে মনে হয়।
অনেক কষ্ট করে হাসলেন। ভদ্রলোক দুবাইয়ে ব্যবসা করেন।৫৫-৫৬ হবে বয়স। দেশে আসা যাওয়ার মধ্যে থাকেন।
– ফ্ল্যাট রেডি হয়েছে ২ মাস আগে। এই ফ্ল্যাটে উঠা আর না উঠা এখন এক কথা আমার জন্য।
– কেন ভাইয়া, কোন সমস্যা?
– জানো, প্রায় ১০ বছর ধরে টাকা জমিয়েছিলাম এই ফ্ল্যাটটার জন্য। এরপর ৩ বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা এই এপার্টমেন্ট। ২ মাস ধরে ১৭ লাখ টাকার ইনটেরিওর, ৩ টা এসি, সেগুন কাঠের সব আলমিরা আর লেকার করা কিচেন কেবিনেট। এখন সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।
– বুঝলাম না।
– আমার একটা কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে, অন্যটা ১৫ ভাগ কাজ করছে। ডায়ালিসিস করে চলছি। বড়জোর ৬ থেকে ১২ মাস হয়ত চলবে এভাবে………।
– এত শখ করে বানালেন যখন উঠে আসেন, চিকিৎসা চলুক………।
– ভাই, অবাক হয়ে ভাবি এই ঘরটার জন্য জীবন দিয়ে দিলাম। কয়মাস পরেই যে ঘরে যাব তার জন্য কিছুই ভাবি নাই। কোন সঞ্চয় নাই। ভেবেছিলাম অন্তত ৭০-৮০ বছর বাঁচব। নাতি নাতনিদের সাথে খেলব। একটা ছোট্ট ঘরে গিয়ে কয়’শ কিংবা হাজার বছর শুয়ে থাকতে হবে তার কোন ইনটেরিওর করলাম না। এসি লাগালাম না। এখন হাতে সময় নাই। মাফ চেয়ে কুল পাচ্ছি না। অল্পতেই চোখে পানি আসে।
একটা সময় একদম আসত না। আসি, আমার জন্য দোয়া করিও।
উনার কথা শুনে একটা হার্টবিট মিস করলাম। আমাদের সাথেও কি অদ্ভুত মিল!!

———————–

Atiq_27
আতিক উল আজম খান, মাস্টার মেরিনার (২৭)। জন্ম / বসবাস – চট্টগ্রাম। ভ্রমন – পেশাসূত্রে এবং ব্যক্তিগতভাবে ৬০-৬৫ টি দেশ। ১ম গ্রন্থ প্রকাশ – অক্ষর, ২০১৫ একুশে বই মেলা,  সিঁড়ি প্রকাশন। লেখালেখি – দৈনিক আজাদি, বিডি টুডে ব্লগ, অনলাইন, যায় যায় দিন, ফেসবুক এবং বিভিন্ন ম্যাগাজিন।

Share