মনের নোঙর পড়ে থাকে সারেঙ বাড়ির ঘরে – আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ (৪৭তম ব্যাচ)

মনের নোঙর পড়ে থাকে সারেঙ বাড়ির ঘরে – আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ (৪৭তম ব্যাচ)

কজন মেরিনারকে বিয়ে করা হয়ত সহজ, কিন্তু আমাদের লাইফস্টাইলের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে পুরো জীবন কাটিয়ে দেয়া মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। মেরিনারদের বিয়ে করতে হলে অবশ্যই একজন মেয়েকে ‘বিশেষ’ এবং ‘অসাধারণ’ হতে হবে।

‘একটু ভালো করে বাঁচবো বলে আর একটু বেশি রোজগার, ছাড়লাম ঘর আমি ছাড়লাম ভালবাসা আমার নীলচে পাহাড়…’

বিয়ের পর তিথির চার জন্মদিনের চারটাতেই আমি দেশের বাইরে! প্রথম জন্মদিনে ছিলাম অস্ট্রেলিয়ায়, দ্বিতীয় জন্মদিনে সিংগাপুরের ক্লেমেন্টি, তৃতীয় জন্মদিনে প্যাসিফিক ওশান আর এবার আছি সিংগাপুর থেকে ইন্দোনেশিয়া যাবার অপেক্ষায়।

বেশ কিছুদিন আগে মেরিনারদের বিয়ে কেন, করলে কী কী সুবিধা ইত্যাদি লেখা একটা পোস্ট দেখেছিলাম। আমি নিশ্চিত নই কতজন মেরিনারের জীবনসঙ্গী বিয়ের আগ থেকেই একা হাতে নিজেকে, সমস্ত পরিবারকে আগলে রাখা লাগবে বিষয়টি পুরোপুরি জেনে-বুঝে একজন মেরিনারকে বিয়ে করে। একটু আধটু জানলেও বাস্তবতা কতটা উপলব্ধি করতে পেরেছিল বিয়ের আগে সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ।

প্রথমদিকে আমি আর তিথি অনেক ফ্যান্টাসিতে ভুগেছি। মনে হয়েছে জাহাজে মাত্র ৬/৭ মাসেরই তো ব্যাপার। আবার আমি সিনিয়র র‍্যাংকে গেলে তিথিকে নিয়েও সেইল করতে পারব ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এখন মনে হয় মেরিনারদের জীবন যাপন নিয়ে একটু বেশিই স্বপ্নালু ছিলাম তখন। তিথিও বিয়ের আগে যতটা স্মুদলি সবকিছু একা হাতে হ্যান্ডেল করতে পারবে ভেবেছিল, বাস্তবে তার ব্যতিক্রমই বেশি দেখতে পাচ্ছে।

জাহাজে থাকা অবস্থায় শুধু আর্থিক সাপোর্ট ছাড়া আর কোনো সাপোর্ট আমরা আমাদের স্ত্রী বা পরিবারকে দিতে পারি না। বর্তমানে জুনিয়র র‍্যাংকে সেই আর্থিক সাপোর্ট দেয়ার সুযোগও অপ্রতুল।

আর্থিক সাপোর্ট অবশ্যই একটা বড় ইস্যু কিন্তু সব কিছু নয়- এটি বেশিরভাগ মেরিনারদের জীবনসঙ্গী কিছুদিন সংসার করার পর বুঝতে পারেন, শুরুতে নয়।

একজন মেরিনারকে বিয়ে করা হয়ত সহজ, কিন্তু আমাদের লাইফস্টাইলের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে পুরো জীবন কাটিয়ে দেয়া মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। মেরিনারদের বিয়ে করতে হলে অবশ্যই একজন মেয়েকে ‘বিশেষ’ এবং ‘অসাধারণ’ হতে হবে। ঢালাওভাবে যে কেউ আমাদের লাইফস্টাইলের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে না। তাই কেউ যদি মানসিকভাবে তেমনটা শক্ত না হন তাহলে তার জন্য মেরিনার কাউকে বিয়ে না করাই সমীচীন বলে মনে করি।

আজকে তাজমীন (আমার সন্তান) বা আমাদের পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে তিথিকেই একা একা সব সামলাতে হবে। একটু সান্ত্বনা বা আমার বুকে মাথা রেখে নিজেকে শক্ত রাখার সুযোগও ওর নেই।

আমার জাহাজে ইন্টারনেট থাকার কল্যাণে হয়ত নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারব (সব জাহাজে সেই সুবিধাও নেই) কিন্তু সেটাই কি সব? টাকাও হয়ত প্রয়োজনের দ্বিগুণ দিলাম, কিন্তু বিপদের সময় স্বামীকে পাশে না পাওয়ার যে অপূর্ণতা, যে আক্ষেপ সেটা কী দিয়ে মিটাবে? আমি যতই দামি দামি গিফট-কসমেটিকস-চকলেটস নিয়ে দেশে যাই না কেন সেটা ওর কষ্ট-আফসোস আর আক্ষেপের তুলনায় নিতান্তই তুচ্ছ।

মেরিনাররা যেমন ‘জাহাজি’ ট্যাগ লাগানোর পর থেকেই নিজেরা দেশের প্রায় সবকিছু থেকেই বঞ্চিত হয় তেমনি তাদের স্ত্রী-সন্তানেরাও। নদীর এপার-ওপার দুই পাড়েই একটা হাহাকার-দীর্ঘশ্বাস থাকে সবসময়।

আমি তাজমীনকে কাছে না পেয়ে ধড়ফড়াইয়া মরি, ওদিকে ফোনে তাজমীন ‘বাবা, প্লিজ কাম হেয়ার, দাদা রুম’ বলে আমাকে ডাকে। ঈদের দিন বা অন্য যে কোনো বিশেষ দিনে আমি একা একা জাহাজে ডিউটি করি, ওদিকে ওরাও বাবা-স্বামীছাড়া!

আমি দেশে না থাকায় আমার বা তিথির প্রিয়জনদের বিয়েসহ অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন মিস্ করি তেমনি ওরাও আমাকে ছাড়া একা একা গিয়ে কোন অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারে না পুরোপুরি। যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যেখানে বাকিদের সবাই বাবা-স্বামীর হাত ধরে উপস্থিত হয় তাজমীন-তিথি সেখানে একা, সঙ্গী-সাপোর্টহীন।

এতকিছুর পরেও আমাদের জীবনসঙ্গীরা আমাদের বা আমাদের পরিবারকে কখনো ফেলে যায় না। হয়ত কখনও কখনও আক্ষেপের ঝুড়ি খুলে বসে, অপ্রাপ্তি বা না পাবার কষ্টগুলো মুখ ফুটে বলে ফেলে কিন্তু দিনশেষে আমরা একই জাহাজে আমাদের জীবন-সমুদ্র পাড়ি দেই। কখনও বিক্ষুব্ধ জলরাশি বা পাহাড়সম ঢেউ এসে ভেঙে দিতে চায়, ডুবিয়ে দিয়ে চায় ভালবাসার সে জাহাজ, কিন্তু আমরা শক্ত করে দুজন দুজনার হাত ধরে বসে থাকি একটা দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে, হয়ত একসঙ্গে ভাসবো বা একসঙ্গে ডুববো, কিন্তু কখনও বিচ্ছিন্ন হব না….

আজকে আমার জীবন-তরীর ক্যাপ্টেনের জন্মদিন, যে কিনা সমস্ত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে জীবন-সমুদ্রে আমাকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে…

জন্মদিনে অনেক অনেক শুভেচ্ছা আর শুভ কামনা রইলো তিথি। আল্লাহ তোমার সমস্ত মনোবাসনা পূর্ণ করুন। জানি না তোমার ঠিক কততম জন্মদিনে আমি দেশে থাকতে পারব, আর কত জন্মদিন এভাবে দূর থেকেই উইশ করে যাব। কে জানে কবে তোমার জন্মদিনের কেক সামনে রেখে তাজমীনকে কোলে নিয়ে গাইতে পারব-

‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ ডিয়ার তিথি। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ….’

লেখক: এক্স-ক্যাডেট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি (৪৭তম ব্যাচ)

প্রকাশিত: নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকম: মনের নোঙর পড়ে থাকে সারেঙ বাড়ির ঘরে (newsbangla24.com)

Share