করোনায় গৃহবন্দী মানে নাবিকজীবনের চর্চা: তন্ময় রায় (45N)
মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ছুটে চলা কোনো জাহাজের নাবিক নই আমরা, কিন্তু কোভিড-১৯–এর মহামারিতে গৃহবন্দী জীবন আমাদের সবাইকে ক্ষণিকের জন্য হলেও সেই জীবনের স্বাদ পাইয়ে দিয়েছে। গৃহবন্দী জীবনে নিজের অজান্তেই আমরা চর্চা করে চলেছি অনেক সামুদ্রিক জীবনের অভ্যাস। নাবিকজীবনের একটা বড় দিক হচ্ছে কোলাহলপূর্ণ সমাজ থেকে দূরে থাকা কিন্তু প্রকৃতির একান্ত কাছে থাকা; যা বর্তমানের সামাজিক দূরত্ব রেখে গৃহবন্দী জীবনের সঙ্গে অনেক মিলে যায়। নাবিকজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তাই এই সংকটময় পরিস্থিতিতে কিছু ইতিবাচক দিক খোঁজার চেষ্টা করেছি এখানে।
আত্মসমর্পণ এবং অভিযোজন
করোনাভাইরাস যতটাই প্রাণঘাতী হোক না কেন, এটা আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত আপাতত সমাধান লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকা। এটা ছাড়া অন্য কোনো পন্থাও খোলা নেই। সুতরাং এটার সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারি আমরা। আমাদের উদ্ভাবক, সৃজনশীল, অভিযোজ্য এবং নমনীয় হওয়া দরকার। গণ্ডিবদ্ধ জীবনাচরণ, অভ্যাস এবং আচরণগুলো বিরক্তিতে পরিণত হতে পারে। তবে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া আমাদের আর উপায় কি, বেঁচে থাকার জন্য!
‘We can’t direct the wind, but we can adjust the sail’। একজন নাবিকের কাছে যেমন নতুন একটা দিন মানে নতুন একটা চ্যালেঞ্জ।
সীমিত পরিসরে আটকে থাকা
লকডাউন মেনে চলা মানে গণ্ডিবদ্ধ জায়গায় বাধ্যবাধকতার সঙ্গে আপস করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলা। যেমনি চলমান জাহাজে কয়েক মিটার মাত্র জায়গায় আপনি হাঁটতে পারবেন। লকডাউনে অপরিহার্য না হলে কোথাও যাওয়ার অনুমতি নেই। এমন অবস্থায় একা থাকাটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ, এমনকি পরিবারের সঙ্গে থাকলেও পারিবারিক শান্তি এবং মানসিক শান্তি বজায় রাখাটা খুব চ্যালেঞ্জ হতে পারে। নাবিকজীবনে এ ধরনের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়মিত এবং এগুলো মোকাবিলার জন্য রয়েছে টেবিল টেনিস থেকে শুরু করে বাস্কেটবলের মতো অনেক ধরনের ইনডোর খেলাধুলার ব্যবস্থা, বিনোদনের জন্য মোবাইল থেকে শুরু করে বড় পর্দার টিভি, শরীরচর্চার জন্য জিমনেসিয়াম অথবা ছোটখাটো সুইমিংপুল। গৃহবন্দী হলেও এটা মাথায় রাখবেন, আপনার কাছে অন্তত আপনার ঘরের মেঝের বিলাসিতা রয়েছে, যা জাহাজের মতো চলন্ত নয়। আপনার চারপাশে কী আছে দেখুন, সুস্থ থাকার জন্য কাজে লাগান।
আমাকে কেমন দেখতে লাগছে কে জানে!
সাধারণত মাঝসাগরে আমি ঢিলেঢালা আরামদায়ক সাদা পরিষ্কার পোশাক পরতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করি। ভালো পোশাক পরে দেখানোর কেউ নেই। আর মাঝসাগরে তো নরসুন্দর নেই, তাই চুল কাটা থেকে দাড়ি কামানো নিজের কাজ নিজেকে সারতে হয়। যেমনটা না লকডাউনে সেলুন, পারলার বা রূপচর্চার প্রয়োজনীয়তা বা সুযোগ—দুটিই খুব কম।
বিবেচনাপূর্বক প্রয়োজনীয় সরবরাহ ঘরে রাখা
একজন সমুদ্রগামী জাহাজের ক্যাপ্টেনকে পরবর্তী সমুদ্রযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার, জল, জ্বালানি তেল থেকে শুরু করে অন্যান্য সামগ্রী, এমনকি অতি দরকারি ওষুধ পর্যাপ্ত আছে কি না, নিশ্চিত করে তারপর পরবর্তী গন্তব্যে যাত্রা শুরু করতে হয়। লকডাউনে নিত্য কেনাকাটা পরিহার করে বিবেচনাপূর্বক প্রয়োজনীয় সরবরাহ ঘরে রাখা আক্ষরিক অর্থে নাবিকজীবনের এই দিকটা চর্চা করার মতো।
স্বাধীন দার্শনিক
একজন লোক গড়ে এক দিনে ২ হাজার ৮০০টি জিনিস/বিষয়/ব্যাপার পছন্দ করেন? সংখ্যাটা সবার জন্য সঠিক কি না, আমি জানি না, তবে আমি বিশ্বাস করি, আমরা এর কাছাকাছি রয়েছি। কেবল একটা সুপারমার্কেটের ভেতরে এক ঘণ্টা ঘুরলেই ১০০টি নতুন সিদ্ধান্ত আমাদের মাথায় ঘুরপাক খাবে। লকডাউনে আমাদের চিন্তাভাবনাগুলো এখন সীমিত, ঘোরাঘুরি কম। এ জন্য নিজের, নিজের জীবনের, নিজের পরিবারের দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত সময় রয়েছে আমাদের হাতে। নিজেকে আবিষ্কার করার সময়। ‘The real voyage of discovery consists not in seeking new landscapes, but in having new eyes.”- MARCEL PROUST (French Novelist).
স্বনির্ভরতা
মাঝসাগরে আমরা কিছু ঠিক করার জন্য কাউকে ভাড়া নিতে পারি না। পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের উদ্ভাবক হতে হয়, বড় কোনো ব্রেকডাউন ছাড়া বাকিটা আমাদের নিজেদের ঠিক করতে হয়। মাথায় রাখতে হয় আটলান্টিকের মাঝখানে কোনো দোকান বা গুগল নেই। এভাবেই কাজের মধ্যে শেখা, নতুন দিন মানে নতুন চ্যালেঞ্জ, নতুন অভিজ্ঞতা একজন নাবিককে অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেনে পরিণত করে। কঠোর লকডাউনে যেমন দোকানপাটে তালা, তেমনি এখন অনেক বাড়িতে কাজের লোক নেই, সামান্য সমস্যায় নেই সমাধানের পথ। অগত্যা নিজেই চেষ্টা করা, ঘরের কাজ নিজেরাই করা। অনেকে হয়তো অভ্যস্ত নই, অনেকে হয়তোবা জানি না, তবুও চেষ্টা করতে ক্ষতি কি!
বই পড়া মানে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতির সঙ্গে জানার পরিধি বৃদ্ধি
অফিসে শিডিউল নেই, বন্ধুদের আড্ডা নেই, মাঠের খেলা নেই, রাজনীতি–অর্থনীতি নিয়ে চায়ের কাপে তর্ক-বিতর্ক নেই, একান্ত নিজের কিছু সময়। নতুন একটা বই পড়ার মোক্ষম সময়। বই পড়তে হয় একাকী এবং তাতে অবসর ভরে ওঠে নির্মল আনন্দে, বুদ্ধি আসে বইয়ের কথামালা থেকে, আর সক্ষমতা আসে গ্রন্থগত বিদ্যার সঙ্গে বিষয়বুদ্ধির সংশ্লেষে। আপনার জ্ঞান, দক্ষতা এবং শখগুলো প্রসারিত করার এটাই সময়।
পরিকল্পনা
করোনা মহামারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, মৌলিক চাহিদা চিকিৎসাক্ষেত্রে আমরা কতটা নাজুক। করোনা–পরবর্তী পরিকল্পনা হোক মৌলিক চাহিদার যথাযথ প্রাপ্তি নিয়ে। যেমন করে নীল জলরাশিতে দুর্বার ছুটে চললেও একজন নাবিকের নীল স্বপ্নগুলো ঘিরে থাকে তাঁর আপনজন, পরিবার, বন্ধু, সমাজ…। পরিকল্পনা থাকে তাদের ঘিরে।
পরিশেষে, টাইটানিক থেকে শুরু করে, বৈরী আবহাওয়া অথবা অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদে পড়ে সমুদ্রগামী জাহাজডুবির ইতিহাস অনেক আছে। ডুবে যাওয়া জাহাজের নাবিকও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রাণপণ চেষ্টা করে যায়, নিজের ক্রু-মেম্বারদের জন্য, নিজের জন্য। একটা লাইফ জ্যাকেট অথবা একটা ভাসমান কাঠের টুকরা ধরে, মনে এই আশা নিয়ে যে ‘জরুরি বার্তা পেয়ে কোনো উদ্ধারকারী দল আসবে তার জন্য।’
কোভিড-১৯ ভাইরাস, পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে সবাইকে গৃহবন্দী হতে বাধ্য করেছে। ফাঁকা করেছে পথঘাট, বন্ধ করেছে যানবাহন, ব্যস্ত অফিসপাড়া করেছে শূন্য, পানশালা থেকে ধর্মশালায় দিয়েছে তালা! অজানা ভীতি, অনিশ্চিত পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে বিশ্ববাসী!
বৈশ্বিক এই ক্রান্তিকালে আমিও আশাবাদী,
কোনো একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খবর আসবে,
করোনা থেকে মুক্ত মানবজাতি।
উদ্ধারকারী দলের মতো কেউ ভ্যাকসিন নিয়ে আসবেন। আবার হাসবে পৃথিবী।
লেখক: তন্ময় রায় (45N)
মার্চেন্ট নেভি অফিসার, আরব সাগর
Recent Comments