[নোঙর 2016] শ্রমিক আর স্বপ্ন : নাসরীন তাহের
[বেশ কিছু বছর প্রবাসে চাকরি করার পর অবশেষে সুদীর্ঘ ছুটি পায় এক শ্রমিক ভাই। দেশে রেখে আসা পরিবারের মুখে হাসি ফুটাবে, তাদের সকলের জীবন থেকে দারিদ্র দূর করে সুখ শান্তিময় জীবনের আরম্ভ হবে – এই ছিল তার স্বপ্ন। কিন্তু ছুটিতে যাবার আগেই ঘটে যায় এক অনাকাঙখিত ঘটনা। একটু অন্যমনষ্ক হয়ে যাওয়ায় মেশিনে আটকে যায় তার পরিহিত শার্টের ঝুলন্ত কিছু অংশ। মেশিনের গর্জনে ডুবে যায় তার আর্তচিৎকার। … আর এভাবেই কঠিন বাস্তবের মাঝে শেষ হয়ে যায় তার সব স্বপ্ন।]
বেশ কিছু বছর প্রবাসে চাকরি করার পর অবশেষে সুদীর্ঘ ছুটি
পায় এক শ্রমিক ভাই। দেশে রেখে আসা পরিবারের মুখে হাসি
ফুটাবে, তাদের সকলের জীবন থেকে দারিদ্র দূর করে সুখ শান্তিময়
জীবনের আরম্ভ হবে – এই ছিল তার স্বপ্ন। কিন্তু ছুটিতে যাবার আগেই
ঘটে যায় এক অনাকাঙখিত ঘটনা। একটু অন্যমনষ্ক হয়ে যাওয়ায়
মেশিনে আটকে যায় তার পরিহিত শার্টের ঝুলন্ত কিছু অংশ। মেশিনের
গর্জনে ডুবে যায় তার আর্তচিৎকার। … আর এভাবেই কঠিন বাস্তবের
মাঝে শেষ হয়ে যায় তার সব স্বপ্ন।
প্রবাসে এসে শ্রমিকভাই তার স্ত্রীপুত্র রেখে,
কাজের ফাঁকে অবসরে কম্পিত হাতে লেখে।
বৃদ্ধ বাবা সজলচোখে পত্রখানা খুলে পড়েন,
“শীঘ্র আমি আসবো বাড়ী, একটু ধৈর্য ধরেন।”
আত্মীয়স্বজন সবাই আকুল চিঠিতে খবর শুনতে,
হিসাব করে আর ক’টা দিন হবে তাদের গুনতে।
শ্রমিক পিতার সন্তানটি যার অর্ধএতীম জীবন,
মা থাকে তার ব্যস্ত কাজে, একলা লাগে মন।
একান্নবর্তী সংসার চলে শ্রমিকের রোজগারে,
সুদিনের আশায় সবাই যে হায় তাকিয়ে রয়েছে, আহারে!
চিররুগ্ন বাবা-মা আর ছোট ছোট ভাইবোন——-
আশা ও ধৈর্য্যর শক্ত লাগামে বেঁধেছে যে তারা মন।
পথ চেয়ে আছে—-দুঃখী যে তারা, আর ক’টা দিন ভাই,
সূর্যস্নাত দিনের শুরু, মেঘ যে আর নাই।
কোম্পানির ঐ চুক্তি শেষে বাড়ী যাবে শীঘ্র শ্রমিক,
জল্পনা আর কল্পনার মাঝে হারায় তাই সে ক্ষণিক।
ওভারটাইমের নেই যে বিরাম, শরীর হয় তার ক্লান্ত,
জরাজীর্ণ সেই হাড়ের মাঝে অসুখ যে হয়েছে পান্থ।
কাজের মাঝে শ্রমিকের মন হারায় কোন উদাসে,
ক্লান্ত কপালে জ্বরের মাত্রা হাল্কা হাল্কা ভাসে।
দেশে রেখে আসা পরিবারের মুখটি সামনে আসে,
দুষ্টু নিয়তি তার দিকে চেয়ে অট্টহাসি হাসে!
বাড়তি খাটুনি ক্ষয়েছে শরীর, ক্লান্তিতে অবশ প্রায়,
ভবিষ্যতের শত পরিকল্পনা চোখের সামনে ধায়।
ব্যস্ত হয়ে চালালো মেশিন সতর্কতা ভুলে,
মেশিনের মাঝে আটকালো শার্ট যতটুকু ছিল ঝুলে।
পরনের কাপড় মেশিনের মাঝে খেয়াল যে তার নাই,
বিদ্যুৎ দানব আঁকড়ে রেখেছে দিচ্ছে না আর ঠাঁই।
যতই ছাড়ায় ততই যেন নিচ্ছে টেনে জোরে,
যন্ত্রদানব আজরাইল বেশে এগিয়ে আসছে, ওরে!
যন্ত্রের সাথে কেউ কি কখনো জিতেছে শক্তিতে?
যন্ত্রের কাছে শ্রমিকেরও তাই হার মানতেই হয়েছে।
বদ্ধ ঘরে সে সময়ে ছিল মেশিনের হুংকার,
শুনলো না যে কেউ হায় অভাগার আর্তচীৎকার।
মেশিনে মানুষে লড়াই শেষে বন্ধ হল চাকা,
অবশ দেহটি লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে রক্তমাখা।
পৃথিবীতে তার সময় শেষ, ডেকে নিয়েছেন বিধাতা,
ভীত চোখদুটো বন্ধ হল, খুলবেনা যে আর তা।
হায়রে ছেলের মরদেহ যখন পৌঁছালো বাংলাদেশে,
বাবা-মা তার শোকে পাগল, আঁছড়ে পড়েন মেঝেতে—-
বিধাতার দিকে চোখ তুলে পিতা করেন জিজ্ঞাস্—–
“এ কি খেলা খেলছো তুমি, এ কোন্ পরিহাস?
বাবার কাঁধে ছেলের লাশ—–এ যে মহাভার!
লাশ দাফনের দাও শক্তি, হে পরোয়ারদেগার!
স্ত্রীপুত্রের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস কাঁদে,
সাত আসমানে বিশাল, আসন তাও বুঝি আজ কাঁপে।
জমি-ভিটা-মাটি, গহনা-গাটি সকলই বন্ধক দিয়ে,
এসেছিল হেথা, হায়রে অভাগা, চাকরি করবে বলে।
ফুটাবে হাসি সকলের মুখে ছিল প্রতিজ্ঞা তার,
নিষ্ঠুর নিয়তির করালগ্রাসে আশা ভেঙ্গে চুরমার!
———————————–
নাসরীন তাহেরঃ ক্যাপ্টেন আবু তাহেরের (১৭) সহধর্মিণী। শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখি তাঁর একটি বিশেষ শখ।
প্রকাশনা- আমার ও সিঙ্গাপুরের কিছু কথা (২০১০), প্রবাসে মনের আয়নায় (২০১০)। লেখালেখি- দি ডেইলি স্টার (ইংরাজি ভাষার দৈনিক)
Recent Comments