[নোঙর 2016]  স্বপ্নভুক : আবদুল্লাহ  আবু সায়ীদ

[নোঙর 2016] স্বপ্নভুক : আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

Abdullah Abu Sayeed

তাঁর কথা দিয়েই বলা যাক তাঁর কথা, “অনিচ্ছুক হৃদয় কে ক্লাশে জোর করে বসিয়ে রেখে কি করব? আমার চ্যালেঞ্জ ছিল এক ধাপ বেশি কেবল শিক্ষক হওয়া নয়, সব ছাত্রের হৃদয়ের কাছে পৌঁছান, সব ছাত্রের হৃদয়কে আপ্লুত করা।” ত্রিশ বছরের শিক্ষকতায়, সাংগঠনিক সাফল্যে, টেলিভিশন উপস্থাপনায় কিংবা বাঙ্গালীর আত্মার মুক্তির আলোময় উত্তরণে “বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের” প্রতিষ্ঠায় তার কর্মসৌকর্যের কোন পরিচয়টা সবচে বিশাল, সবচে বেশী অর্থময় হয়েছে আমাদের জন্য শুধুমাত্র সেই বিষয়টা নিয়েই হতে পারে গবেষণা। তাঁর বহন করা আলোকবর্ততিকা শুদ্ধ করেছে আমাদের বাঙ্গালীদের মন, মনন, চেতনা। পুরোটা কর্মময় জীবন তিনি শুধু মৌলিক বিশুদ্ধচারণের, আনন্দের আর মহত্বের জয়গান গেয়েছেন। তার ক্লাশে তার পাঠচক্রে পাঠ দিয়েছেন আলোকিত মানুষ হবার। মননশীল সরসতায় ক্ষমাহীন নির্মোহ সত্যকে আবিষ্কার করে আমাদের চমকিত করে গেছেন তিনি, তার কাজে। তিনি একুশে পদক ও র‍্যামন মাগসাসাই পদকে ভূষিত হয়েছেন, কিন্তু সবচাইতে বেশী বোধ’হয় বাঙ্গালীর স্বশ্রদ্ধ ভালোবাসায়। “আলো আমার আলো ওগো” গান বাজিয়ে তাঁর জাগরণের ফেরিওয়ালা যখন ঘুরে বেড়ায় গলি উপগলির প্রান্ত থেকে উপান্তে তখন আমরা দেখতেই পারি দিনবদলের স্বপ্ন। কারন, “মানুষ তাঁর আশার সমান বড়”।

 

যা দিয়ে পাবনা আমার শৈশবকে সবচেয়ে ভয় দেখাত তা হল বিশাল কালো গাছপালায় ঢাকা শালগাড়িয়ার বিরাট জঙ্গল। ইছামতী পার হয়ে শালগাড়িয়ায় পা রাখলেই আমার গা ছমছমিয়ে উঠত। পাবনা শহর থেকে ইছামতীর ধার ঘেঁষে যে লাল ইটের রাস্তাটা পায়ে পায়ে এগিয়ে শালগাড়িয়ার শেষপ্রান্ততক চলে গেছে তারই শেষের দিকে নদীর ধারে শহরের শ্মশান। কিছুদিন পরপরই শব বহনকারীরা হল্লা করতে করতে ঐ পথ দিয়ে লাশ নিয়ে যেত। ঘন অন্ধকার জঙ্গলের ভেতর থেকে তাদের উঁচুগলার ঘন ঘন ‘বোলো হরি হরিবোল’ আওয়াজ আমার কাছে অশুভ ইঙ্গিতের মতো লাগত। আমাদের ছেলেবেলার বাংলাদেশের গোটাটাই ছিল এমনি জঙ্গলাকীর্ণ আর অন্ধকার। সে ছিল পুরোপুরি এক আলাদা বাংলাদেশ। আজকের ঝোপ-জঙ্গলহীন, ক্লিন-শেভ করা ছিমছাম বাংলাদেশের সঙ্গে তার কোনো মিলই নেই।

শালগাড়িয়ার জঙ্গল নিয়ে যা ছিল সবচেয়ে উদ্বেগজনক তা হল, শীতকালে ঐ জঙ্গলে প্রায়ই বাঘ আসত। বাঘ আসার ব্যাপারটা আমাদের জন্যে ছিল বিশেষভাবে আতঙ্কের। শালগাড়িয়ায় ভালো জলাশয় না-থাকায় প্রতি শীতে অন্তত দু-চারবার সে-বাঘ ইছামতী পেরিয়ে আমাদের বাসার সামনের পুকুরটায় পানি খেতে আসত। সবসময় আসত না, তবু শীতকালে রাত বেড়ে গেলে আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লেপের নিচে ঢুকে যেতে পারলেই নিশ্চিন্ত হতাম। একেক দিন, পৌষ-মাঘের প্রচন্ড শীতের রাতে আমাদের বাসার শ-দুয়েক গজ পেছনে ইছামতী বরাবর হঠাৎ করেই ফেউয়ের ডাক শোনা যেত। ভয়ে আমাদের শরীর কাঁটা দিয়ে উঠত। আমরা বুঝতে পারতাম বাঘ ইছামতী পার হচ্ছে। কঠিন শীতে কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে বাঘ দেখার জন্যে নিশ্বাস বন্ধ করে আমরা অপেক্ষা করতাম। একসময় দেখতাম আমাদের পুকুরের শান-বাঁধানো সিঁড়ি ধরে পায়ে পায়ে নেমে জলজ্যান্ত বাঘ পানি খেয়ে শালগাড়িয়ার দিকে ফিরে যাচ্ছে।

রাতে যে-বাঘকে দেখে এত ভয় হত দিন হলেই সে-ভয় আমার পুরোপুরি উবে যেত। এর একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। আব্বা এই সময় কলকাতা থেকে আমাদের তিনজনকে একটা করে খেলনা-বন্দুক এনে দিয়েছিলেন। আগের বারে আনা পিস্তলের গুলিতে বারুদ ছিল বলে সেগুলোর ট্রিগার টান দিলে দ্রুম করে শব্দ হত। এগুলোতে তাও হত না। নিতান্তই শাদামাঠা খেলনা-বন্ধুক। টান দিলে খট করে শব্দ করেই চুপ হয়ে যেত। তবু বারুদওয়ালা পিস্তল আমার ভেতর যে-আত্মবিশ্বাস জাগাতে পারেনি, এই পেল্লাই সাইজের বন্দুকটা তাই পেরেছিল। বন্দুকের মতো বড়সড় হওয়ায় ঐ জিনিশটা আমার মনে একটা সত্যিকারের বন্দুকের বিভ্রম জাগিয়েছিল। ওটা নিয়ে গাছপালার ভেতর দিয়ে হাঁটতে গেলেই আমাকে একধরনের দুঃসাহসের নেশায় পেয়ে বসত। মুহুর্তে ঐ খেলনা-বন্দুকটার অসারতা মন থেকে মুছে যেত। ওটাকে মনে হত সত্যিকার বন্দুক। মনে হত এ দিয়ে কেবল কানাকুয়া কেন, গন্ডার বাঘ কোনোকিছু খতম করাই অসম্ভব নয় (এতবড় অস্ত্রটা কি এতটুকু করতে পারবে না?)। আত্মবিশ্বাসে আমি জ্বলতে থাকতাম। একটা আদিম বেপরোয়া বন্য দুঃসাহস আমাকে শক্তিশালী আর অন্ধ করে তুলত। এই খেলনা-বন্দুককে আমি এতটাই সত্যি বলে বিশ্বাস করতাম যে, হাতে ঐ বন্দুক আর কোমরে পিস্তল নিযে আমি একেকদিন একা একা শালগাড়িয়ার অনেক ভেতরে চলে যেতাম। মনে হত বাঘটা তো জানে না কী ভয়ংকর অস্ত্র নিয়ে আমি এগিয়ে আসছি। একবার দেখা হলে টের পাবে। আর এ দিয়ে না হলে কোমরে পিস্তল তো আছেই।

একটা খেলনা-বন্দুককে কী করে এতখানি বিশ্বাস করেছিলাম ভাবলে এখনও হাসি পায়। তবু মনে হয়, সেদিনের ঐ খেলনা-বন্দুকটার মতো আজও কি একইভাবে বহু হাস্যকর জিনিশকে সত্যি বলে বিশ্বাস করছি না? ভাবছি নাকি একদিন বাংলাদেশ সুখের বাগান হবে, আলোকিত মানুষে ভরে যাবে এই দেশ! ডেঙ্গু প্রতিরোধ হবে, বাংলাদেশের পরিবেশ সুস্থ-সুন্দর আর দূষণমুক্ত হয়ে উঠবে। আমরা সবাই সুখী হব, বড় হব। হয়ত সবই মিথ্যা। কিন্তু কী গভীর আর পরিপূর্ণভাবেই না বিশ্বাস করি কথাগুলো! অনেকদিন ভেবেছি আমার এই ভাবনাগুলো যদি সব মিথ্যাও হয়, শুধু আমার এই বিশ্বাসটা জন্মান্ধের মতো বেঁচে থাকে-তাহলেও এই ভাবনাগুলো একদিন সত্য হয়ে যাবে।

আমি অনেক সময় ভেবেছি আমার জীবনের কোন্ প্রবণতাটা সবচেয়ে জোরালো। আমার ধারণা: আমার বিশ্বাস করার ক্ষমতা। জীবনের সম্ভাবনাকে আমি নিরঙ্কুশ নিশ্ছিদ্রভাবে বিশ্বাস করি। এ বিশ্বাস যুক্তিহীন, নিষ্কৃতিহীন, অন্ধ ও জান্তব। আমি বিশ্বাস করি: ‘আমরা করব জয় একদিন’। আশার ব্যাপারে আমি মিথ্যাচারী, প্রশ্নহীন। আমি বিশ্বাস করি: মানুষ তার আশার সমান বড়। বিশ্বাস করি: যে যা পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করে সে তাই হয়ে যায়। তার সঙ্গে সারা পৃথিবীও তাই হয়। নৈরাশ্যে বিশ্বাস করে কী হবে? মানবসভ্যতার আজকের যে বৈভব আর অগ্রগতি- এর একটি ক্ষুদ্রতম কণাও কি নৈরাশ্য দিয়ে তৈরি? তাহলে কেন নৈরাশ্য? তাই আমি বিশ্বাস করি আর স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি, কারণ: স্বপ্ন কোনো উদ্ভট ও অবাস্তব কল্পনালোকের নাম নয়। এ পুরোপুরি একটা বাস্তব জিনিশ। স্বপ্ন হচ্ছে আমাদের গন্তব্য। এ বলে দেয় কতটুকু হাঁটতে হবে, কোনখানে আমার মঞ্জিল। আমি যে-বাস্তবকে খুঁজি, স্বপ্ন হল তার নাম। তাই স্বপ্নে বিশ্বাস, স্বপ্ন দেখার বিশ্বাসকে আমি বাস্তবে বিশ্বাস বলে মনে করি। বাস্তবের চেয়েও এ আরও বড় বাস্তবে বিশ্বাস। বাইবেলে আছে:

 

He who liveth

He who believeth

Shall never die.

এই বিশ্বাস দিয়ে আমি আমার জাগতিক সম্পূর্ণতাকে স্পর্শ করতে চাই।

 

Save

Save

Save

Save

Share