হাদিসুরের মৃত্যু ও আমাদের দায়: আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (৪৭/ই)

হাদিসুরের মৃত্যু ও আমাদের দায়: আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (৪৭/ই)

চোখ বুজলেই দেখতে পাই হাদিসের ঝলসে যাওয়া দেহটা। সে পোড়া দেহের মধ্যে বাস করা একজন হাদিসকে দেখতে পাই যে দেশের এক প্রত্যন্ত এলাকা থেকে একবুক স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছিল মেরিন একাডেমিতে।

একাডেমিতে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর নিশ্চয়ই ভেবেছিল, আর কয়েকবছর পরই ছোটবেলা থেকে দেখে আসা দারিদ্র্য দূর হবে, শিগগির আসবে স্বচ্ছলতা। বাবা-মায়ের মলিন চেহারায় আসবে খুশির ঝলক। হাদিসের সে স্বপ্ন পূরণে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে হাদিস এগিয়ে গিয়েছিল অনেকটাই। অধরা সে স্বপ্ন পূরণের যে সিঁড়ি, তার প্রায় শেষ ধাপে এসে পড়ে গেল এমন গহীনে যেখান থেকে ফিরে আসার কোনো সুযোগ নেই। না, না হাদিস পড়ে যায়নি সে সিঁড়ি থেকে, ওকে ফেলে দেওয়া হয়েছে! ওকে মেরে ফেলা হয়েছে, ওকে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ওর পরিবারকে একটা ভালো ঘরে থাকার স্বপ্ন দেখিয়ে, শেষ সম্বল সে জীর্ণ ঘরকেই নরকের আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ নিষ্ঠুরতার বিচার ওর পরিবার কার কাছে চাইবে? কাকে দেবে?

হাদিসের পোড়া মাংসপিণ্ডের পাশে হয়তো ওর আত্মাটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই আত্মা কি অঝরে কাঁদছে এমন করুণ পরিণতি দেখে? অভিশাপ দিচ্ছে তাদের যাদের ভুলের জন্য এমন বীভৎস পরিণতি হলো? কেঁদে মরছে কি ওর স্নেহশীল বাবা, মমতাময়ী মা, বোন আর এত স্নেহের দুই ভাইয়ের অসহায়ত্বের জন্য? বলছে কি, আমি পারলাম না তোমাদের দেখানো স্বপ্নপূরণ করতে, আমাকে ওরা পারতে দিলো না।

কি দোষ ছিল হাদিসের আমাকে কেউ বলতে পারেন? আপনারা জেনেশুনে ওদের একটা বিপজ্জনক স্থানে পাঠালেন। এরপর বিপদে সাহায্য চাওয়ার পরও একসপ্তাহ কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করতে অপেক্ষা করলেন। ২৯টা জীবন আর তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছিনিমিনি খেললেন। শেষমেশ আপনাদের টনক নাড়তে একটা অমূল্য জীবন বলি দিতে হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। মিলিয়ন ডলারের জাহাজ আরও মিলিয়ন ডলার দিয়ে না হয় সারাই করতে পারবেন কিন্তু হাদিসকে যে চিরবিদায় দিয়ে দিলেন! মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের বিনিময়েও তো ওকে ফিরিয়ে আনা বা রিপেয়ার করা যাবে না!

হাদিসকে মেরে ফেলার পর যে সিদ্ধান্ত ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে নিতে পারলেন, ঘটনার আগের ৭ দিন আপনারা কেন পারলেন না, কেন নিলেন না? কেন এতটা জোর দিলেন না হাদিসের সোনার দেহ অঙ্গার বানানোর আগে? লাশ ছাড়া কি কোন যৌক্তিক দাবিও বাস্তবায়ন হয় না এখানে? হাদিসকে জীবন দিয়ে কেন বাকি ২৮ জনকে বাঁচাতে হলো? কেন ওদের আহাজারি আপনাদের কর্ণকুহরে আগে পৌঁছায়নি?

এই যে হাদিসের অমূল্য জীবনটা কেড়ে নিলেন, এই যে হাদিস জীবন দিয়ে বেঁচে থাকা ২৮টি প্রাণ আর তাদের পরিবারকে রক্ষা করলো- এজন্য আপনারা হাদিস আর ওর পরিবারকে কি মূল্য দেবেন? কাগজে কলমে লেখা ৫ লাখ টাকা? বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, ৫ কোটি টাকা দিলেও কি তা যথেষ্ট? ওর বাবা-মা, কলেজপড়ুয়া দুই ছোট ভাইয়ের স্বপ্ন এবং ভবিষ্যতের মূল্য কীভাবে নিরূপণ করবেন আপনারা?

দয়া করে এবার একটু স্বচ্ছভাবে চিন্তা করুন। হাদিসের পরিবারকে অতিদ্রুত সম্মানজনক এবং উপযুক্ত পাওনা বুঝিয়ে দিন। হাদিসের পরিবারের জন্য কিছু করা দয়া নয় বরং তা হাদিস আর ওর পরিবারের প্রতি আমরা যে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত। আমাদের সবার উচিত অবিলম্বে এ অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করা। নইলে হাদিসের বিদেহী আত্মার অভিশাপ থেকে আমাদের ইহকাল বা পরকাল কোথাও মুক্তি মিলবে না।

বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, ইনসুরেন্স পি অ্যান্ড আই (P&I) এবং বিএমএমওএ (BMMOA) এর সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করবো হাদিসের পরিবারকে দ্রুততম সময়ে তাদের অপূরণীয় ক্ষতির যতটা সম্ভব পুষিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে। হাদিসের ছোট ভাই দুজনেই পড়াশোনা করছে, ওদের পরবর্তীতে একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। হাদিসের যে স্বপ্ন ছিল একটা ভালো ঘর করে দেবে ওর বাবা মাকে-তার ব্যবস্থা করুন। এতেও আমাদের অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত হবে কিনা আমি জানি না। তবে এসব করলে পরকালে হাদিসের সামনে দাঁড়িয়ে অন্তত বলতে পারবো, তোর কোনো স্বপ্ন আমরা অপূর্ণ রাখিনি হাদিস-এবার আমাদের মাফ করে দে….”

হাদিসুরের মৃত্যু ও আমাদের দায় | The Daily Star Bangla

ছবি: আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ / হাদিসুর রহমানের সঙ্গে গতবছরের সেপ্টেম্বরে শেষ দেখায় লেখক।


আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, এক্স-ক্যাডেট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি (বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে নিহত ৪৭তম ব্যাচের হাদিসুর রহমানের ব্যাচমেট)

Share