[SMC Magazine ‘নোঙর’] রাতের গল্প : হারুন-অর-রশিদ (২১)

[SMC Magazine ‘নোঙর’] রাতের গল্প : হারুন-অর-রশিদ (২১)


সাগর দশটা নাগাদ ফিরল। কান্তাকে ডাকতেই মা ইশারায় চুপ করার ইঙ্গিত দিয়ে বললেন, শাওন এসেছে। জার্নি করে খুব ক্লান্ত তাই আগেভাগেই শুয়ে পরেছে।
সাগর তাকিয়ে দেখল ওর রুমের দরজা আংশিক খোলা। ভেতরটা অন্ধকার।
মেঝেতে রাখা পুটলিটা দেখিয়ে মা বললেন, আজ এতে ঘুমাবি।

জরাজীর্ন এক লেপ, জায়গায় জায়গায় তুলা বেরিয়ে আছে, পুরানো চাদর, কভার বিহীন এক বালিশ, বহু বছরের পুরানো এক কাথায় মোড়ানো পুটলিটা ঘরের এক কোনায় পরে থাকে। রাতে ঘুমানোর কোন অতিথি এলে সাগরের জায়গা হয় পুটলির ভেতরে। পুটলিটার সমাদর বেড়ে যায়। আজও বেড়ে গেল।
সাগর কিছু না বলে কান্তার রুমে গেল। গিয়ে দেখল ওর সব জিনিসপত্র এ  রুমে আনা হয়েছে। কান্তাকে বলল, শেষমেশ প্রিন্সেস এলেন তাহলে?

ভাইয়া, টেক ইট ইজি। আপা খুব ভাল মানুষ। দুদিনেই তোমার ভুল ভেঙ্গে দেবেন। আই গ্যারান্টি।
আসতে না আসতেই দেখি তোকে পটিয়েছে? বলে টাওয়াল নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। ভাগ্যিস বাথরুমটা বাইরে।  কাপড় পাল্টিয়ে বের হতেই মা জিজ্ঞেস করলেন, ঠিকমত খেয়েছিস নাকি কিছু খাবি?
খেয়েছি মা। বলে পুটলি খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল।

ঘুম ভাঙ্গল কান্নার শব্দে। পুটলি থেকে মাথা বের করে টের পেল কান্নাটা ওর রুম থেকেই আসছে।
মা বললেন, ভয়ের কিছু নেই মা। তেলাপোকা মানুষকে কামড় দেয় না।
আমি তেলাপোকাকে খুব ভয় পাই আন্টি।
সাগর বলল, ভয় পেলে এখানে আসার দরকার কি? ফাইভ স্টার হোটেলে গেলেই হত।
মা দরজার বাইরে মুখটা এনে বললেন, কিছু করতে না পারলে অন্তত চুপ করে থাক।
পারব না কেন? প্রিন্সেস চাইলে পেস্ট কন্ট্রোল এনে পুরো বাসাটা তেলাপোকা মুক্ত করতে পারব। তবে তা করে লাভ হবে না। কারন পাশের বাসা থেকে নতুন সব তেলাপোকা এসে মুহুর্তে বসতি গড়ে তুলবে। বলে হাসল।
আমি আব্বুর কাছে কমপ্লেইন করব। উনি আমাকে অপমান করছেন। বলে শাওন কান্নার গতি বাড়িয়ে দিল।

সাথে এটাও জানিয়ে দিও, সাগর ভাই মাস্টার্স করে অনেকদিন ধরে বেকার। মুক্তিযোদ্ধার ছেলে হয়েও বেকার। কত ডাব্বা মারা স্টুডেন্ট বিভিন্ন কোটার দোহাই দিয়ে সরকারের গুরুত্তপুর্ন অনেক পদ বাগিয়ে নিলেও উনি বেকার। আংকেল লিডার মানুষ। কিছু একটা করতেও পারেন।

শাওনের কান্না থেমে গেল।

মা বেরিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন, কি বললি ঠিক বুঝলাম না। কিন্তু ওর কান্না মুহুর্তে থেমে গেল। বলে মুচকি হেসে চলে গেলেন।


আজকের ফেরাটাও দেরীতে হল। মা দরজা খুলে বললেন, এত রাতে কে তোর জন্য অফিস খোলা রাখে?
চাকুরীর আশা বাদ দিয়ে ব্যবসার চিন্তা  ভাবনা করছি মা। কিছু একটা না করলে সারভাইভ করব কি করে?
বাবা বললেন, ব্যবসা করবি সেজন্য কি আগে বাসায় ফেরা যাবে না?
যে সব বন্ধুর কাছে ব্যবসার আইডিয়া নিচ্ছি ওরা দিনে খুব ব্যস্ত থাকে বাবা।
আমরা সেকেলে মানুষ। তোদের ডিজিটাল যুগের ডিজিটাল ব্যবসা বানিজ্য কিছু বুঝি না।
মা জিজ্ঞেস করলেন, আজও খেয়ে এসেছিস নাকি?
না মা খাইনি। একদিন তোমার হাতের রান্না না খেলে মনে হয় কতকাল খাইনি।  সে কারনেই আজ বাইরে খাইনি।
পাগল ছেলে আমার। বলে তাড়াতাড়ি টেবিলে  প্লেট দিলেন। তরকারি গরম করবেন সাগর বলল, গরম করতে হবে না। ওভাবেই দাও।
ভাত, ডাল আর বেগুন দিয়ে টেংরা মাছ। এক নিমিষেই প্লেট খালি করে বলল, রান্নায় কি যাদু ঢাল বুঝি না। এত মজা হয় কি করে?

মাকে দেখে মনে হল খুব খুশী হয়েছেন। ফিসফিস করে বললেন, জলদি শুতে যা। বেশী কথা বললে শাওন মার ঘুম ভেঙ্গে যাবে।
বেসিনে হাত ধুয়ে পেস্ট ব্রাস নিয়ে বাথরুমে গেল। সেখান থেকে বেরিয়ে পুটলিটা আনফোল্ড করে শরীর মুড়ে শুয়ে পড়ল।

রাত তখন কটা হবে কে জানে? হঠাৎ চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। কাথার ভেতর থেকে মাথাটা বের করে দেখল বাবা, মা, কান্তা  সবাই তার বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে। একটু দুরে দাড়িয়ে শাওন। চোখ মেলতেই বাবা বললেন, ঘুমের একটা স্টাইল আছে। শাওন মার দোষ কি?
সাগর উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, ব্যাপারটা কি?

মা বললেন, তোকে দেখে শাওন ভয় পেয়েছে। যেভাবে শুয়ে আছিস দেখে যে কেউ ভয় পাবে। মাথাটা একটু বের করে রাখতে পারিস না?
হাসি পেল সাগরের। ওকে হাসতে দেখে বাবা রেগে গেলেন, এখানে হাসির কি আছে? মেয়েটা ভয় পেয়েছে। ভয়ে শরীর কাঁপছে। সরি বল। উঠে ওর মনে একটু বিশ্বাস দে যে তুই ভুত না।
সাগর দাঁড়িয়ে বলল, হ্যালো শাওন আমি ভুত না। ভুতের পা থাকে না। এই দেখ আমার দুটো পা আছে। বলে একটু হেটে দেখাল।

সাগরের কান্ড দেখে সবাই হাসল। সাথে শাওনটাও। তবে ওর হাসিতে লজ্জা মেশানো আছে। যা এ নিশুতি রাতে সাগরের নজর এড়ালো না।
মা শাওনকে বললেন, যাও মা গিয়ে শুয়ে পড়। টয়লেটে যেতে হলে আমাকে ডাক দিও।

বাবা, মা, কান্তা সবাই চলে গেল। শাওন যেতে গিয়ে ফিরে এসে বলল, আপনি অনেক বড় হয়ে গেছেন।
তুমি কি আর সেই ছোট্ট শাওন আছ?

শাওন লজ্জা পেল। সাগর বলল, গিয়ে শুয়ে পর। কাল কথা হবে। এভাবে কথা বলতে দেখলে মা এসে বারটা বাজাবেন। তবে তুমি ভয় পেও না। বারোটা বাজাবেন আমার।
শাওন মুচকি হেসে চলে গেল।

সাগর ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নে পুরবীকে দেখল। আজ খুব সাজগোজ পুরবীর। পরনে তারই পছন্দের হলুদ রঙের সেই জামা। সাগরকে বলল, দেখলে কত সহজেই আমাদের বিয়েটা হয়ে গেল? তুমি শুধু শুধু টেনশন করতে। সামান্য একটা চাকুরী দিয়ে ভালবাসা মাপা যায় না সাগর। ভালবাসা এমন এক জিনিস যাকে পৃথিবীর কোন দাঁড়িপাল্লা দিয়েই মাপা যায় না। বাবাকে বাইর থেকে যতটা কঠিন মনে হয় তিনি ভেতরে ভেতরে আসলে ততটাই নরম। তুমি ভাবতে বাবা আমাদের সম্পকর্টা কখনই মেনে নেবেন না। তোমার সে ধারনা ভুল প্রমানিত হল। বলে মুখটা সাগরের মুখের খুব কাছে নিয়ে এল। এমন সময় ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। চোখ মেলে দেখল তার মুখের উপর সত্যি সত্যি কারও মুখ। প্রথমে ভেবেছিল ধান্দা দেখছে পরে টের পেল এ ধান্দা না সত্যি। ভয় পেয়ে  চিৎকার দিয়ে উঠে বসল। তাকিয়ে দেখল শাওন পায়ের কাছে বসে হাসছে।

কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে দেয়ায় শাওনের উপর খুব রাগ হল। কিছু বলার আগেই শাওন দাঁড়িয়ে বলল, আমি কিন্তু ভুত নই। একটু হেটে বলল, এই দেখুন আমি হাটছি। আমার পা আছে। ভুতের পা থাকে না।
এই সাত সকালে তুমি এখানে কি করছ?
নামাজ পড়ার পর ভাবলাম দেখি আপনাকে জাগিয়ে নামাজ পড়ানো যায় কিনা?
আমি দিনদুপুরেই নামাজ পরি না আর তুমি কি করে ভাবলে ভোরবেলা উঠে নামাজ পরব?
পরতেওতো পারেন। মানুষের হেদায়াত হতে সময় লাগে না।
ইউ রিয়েলি বিকেম ম্যাড শাওন।
ভালবাসা শুধু মুখে বলে লাভ নেই। কাজ করে দেখাতে হয়। উপরওয়ালাকে ভালবাসার ব্যাপারটাও সেরকম।  তাকে ভালবাসলে উঠে নামাজ পড়ুন।
তুমি দোয়া করলেই হবে। বলে শরীরটা পুটলির ভেতরে ঢুকাবে, শাওন পুটলিটা টেনে ধরে বলল, উঠে অফিসে যাবার জন্য রেডী হন। এই ফাঁকে আমি এতে একটু ঘুমিয়ে নেই।
পুটলির গন্ধে বমি করে দেবে। মেঝের বমি সহজে পরিস্কার করা যায়। বিছানাপত্রে করলে তা সহজে পরিস্কার করা যাবে না।
করব না। বলে কাথাটা শুকে বলল, এই দেখুন শুকলাম। কই বমি হল?
শাওন প্লীজ আর একটু ঘুমাতে দাও। প্লীজ।
সাগরের চিৎকার মার কানে গেলেও তিনি কাছে এলেন না। দুরে দাঁড়িয়ে ওদের কান্ড দেখছেন। শাওনটাকে এরকম দুষ্টামী করতে দেখে তার ভাল লাগল।
ঠিক আছে আমি শুব না কিন্তু আপনি উঠুন।  না হলে অফিসে লেট হবেন। বলে জানালাটা খুলতেই বাইরের

আলো এসে ঘরটা আলোকিত করে ফেলল। সাগর তাকিয়ে দেখল বাইরে রীতিমত দিন। মানুষজনের চলাচলের আওয়াজ শোনা যাচেছ। জিজ্ঞেস করল, কটা বাজে?
সোয়া সাতটা।

সাগর এক লাফে বিছানা ছাড়ল। আজ প্রথম দিন। দেরী করা যাবে না। শাওনটা ডেকে ভালই করেছে। বলল, থ্যাংকস।
কিসের জন্য?
ডাকার জন্য। বলে বাথরুমে গেল।

ব্রেকফাষ্টের টেবিলে অনেকদিন পর বাবার মুখোমুখি। খেতে খেতে মাকে বলল, তুমি ডাকবে না? ভাগ্যিস শাওনটা ডেকেছে। তা না হলে লেট হত। প্রথমদিন লেট হলে চাকুরী দেবে না।
তুইতো কিছু বলিসনি। কাল থেকে তোর বাবা ডেকে দেবেন।
বাবা ডাকলে আবার বেশী ভোরে ডেকে তুলবেন। তারচেয়ে একটা অ্যালার্ম ক্লক কিনে ফেলব।
শাওন বলল, আংকেলকে কষ্ট করতে হবে না। আমিই ডেকে দেব।
তুমি আজ আছ কাল নেই। আমার অ্যালার্ম  ক্লকই এনাফ। বলে বেরিয়ে গেল।


রাতে ফিরে কাপড় পাল্টানোর জন্য কান্তার রুমে গেল। সেখানে নিজের কোন জামা কাপড় নেই। উল্টো সে জায়গায় শাওনের সব জামা কাপড়। কান্তাকে জিজ্ঞেস করল, আমার জামা কাপড় কোথায়?
আপাকেই জিজ্ঞেস কর।
সাগর বেরিয়ে এসে মাকে  জিজ্ঞেস করতেই মা বললেন, শাওন তোর রুমে রেখেছে। তুই আজ থেকে নিজের রুমেই ঘুমাবি।
আর ফজলু আংকেল এসে মেয়েকে কষ্ট দেবার জন্য গালমন্দ করবেন আমাকে। তোমরা সেটাই চাও তাই না?

শাওন বাবার পাশে চুপচাপ বসে আছে।
বাবা বললেন, ফজলু ফোন করেছিল। শাওন মা কি বলেছে জানিনা। ও খুব খুশী। বলল, ”তোদেরকে একবার আসতেই হবে। শাওন মাকে যে আদর যত্ন করছিস তা কিছুটা হলেওতো শোধ করার সুযোগ পাব”।
সাগর কিছু না বলে রুমেগেল। ভেতরে ঢুকে অবাক। সব জামা কাপড় সুন্দর করে সাজানো। সে নিজে অগোছালা এক মানুষ। শাওনটা বোধোয় খুব গোছালো। নিজের সব জিনিস কান্তার রুমে নিলেও  এখনও ওর দুই একটা জামা কাপড় রয়ে গেছে। কেন রেখেছে কে জানে?  আর কিছু ভাববার আগেই শাওন এসে হাজির।

সাগর বলল, ভার্সিটি যাবে আমাকে বললেই পারতে। নিয়ে যেতাম।
আজ আপনার প্রথম দিন। কষ্ট দিতে চাইনি। সুদিন ভাইটাকে ভালই মনে হল। একদিনে অনেক জায়গায় নিয়েছেন।
আবার যেতে হলে বলো।

শাওন চলে যেতে গিয়ে ফিরে এসে বলল, আপনি না চাইলে এখানে ঘুমানোর দরকার নেই। বলে মুচকি হেসে চলে গেল।

ঘুমানোর উদ্দেশ্যে বালিশটায় মাথা দিয়ে সাথে সাথে উঠে বসল। শাওনের শেষ কথাটা বুঝতে অসুবিধা হল না। সবকিছু নিলেও, ও বিছানার চাদর আর বালিশটা নেইনি। ওর শরীরের একটা গন্ধ এতে মাখামাখি হয়ে আছে। এই বালিশে মাথা দিয়ে,  নাক মুখ দিয়ে হাজারো নি:শ্বাস নিয়ে, হাজারো নি:শ্বাস ছেড়ে এতে একটা গন্ধ মেখেছে। এখন নি:শ্বাস নিতে গেলেই ওর শরীরের গন্ধটা অনুভুত হচ্ছে। কিন’ শাওন জানে না তার নাকে পুরবীর শরীরের গন্ধ লেগে আছে। শাওনের শরীর কেন? পৃথিবীর কোন পারফিউম মেরেও সে গন্ধ সরানো  যাবে না। একবার ভাবল চাদর বালিশটা পাল্টাবে। আবার মনে হল শাওনটা ইচ্ছে করেই তা করেছে। মাঝরাতে ওকে দু:খ দেবার কোন মানে হয় না। ঘুমানোর জন্য সাগর রুমের লাইটা নিভিয়ে ফেলল।

—————————————–
Harun Or Rashid 21

[হারুন অর রশীদ, মেরীন একাডেমী, ২১তম ব্যাচের একজন প্রাক্তন ক্যাডেট। তার লেখা উপন্যাস জগৎ সংসারে” বইমেলা ২০০৭ এ প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে প্রকাশিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম, রোদ কুয়াশার দিন”, দুরে যাওয়া কাছে পাওয়ার গল্প”, ক্রসফায়ার কেচ্ছা। তার সর্বশেষ উপন্যাস দেশ থেকে প্রবাসে” বইমেলা ২০১৪ এ প্রকাশিত হয়। মানুষের সুখ দুখ, হাসি কান্নার সাদামাটা ঘটনাবলী নিয়েই রচিত তার এসব উপন্যাস। পাঠকের অনুভুতিতে ছোঁয়া দেবার কেবলি এক প্রয়াস।]       

Share