একজন কমান্ড্যান্ট, একজন সাজিদ স্যার: আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ (৪৭তম ব্যাচ)

একজন কমান্ড্যান্ট, একজন সাজিদ স্যার: আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ (৪৭তম ব্যাচ)

মার্চ ২০১৩, রাত আড়াইটা! ফার্মগেট মণিপুরীপাড়ার একরুমের ভাড়া বাসার ফ্লোরিং তোশকে শুয়ে আছি। পাশেই খাটের উপর আব্বা-আম্মা শুয়ে। আব্বা অসুস্থ, কিডনিজনিত সমস্যার জন্য সপ্তাহে ২/৩ দিন ডায়ালাইসিস করাতে হচ্ছে। হাসপাতালে সর্বোচ্চ ছাড় পাবার পরেও মাসে খরচ প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা।

ডায়ালাইসিসের জন্য লালমাটিয়ার এশিয়ান কার্ডিয়াক হাসপাতালে যেতাম আব্বাকে নিয়ে। বড়দা কিছুদিন সেখানে ডাক্তারী করায় ৪০% পর্যন্ত ছাড় দিতেন ম্যানেজার সাহেব। একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য মাসে মাসে এতগুলো করে টাকা ম্যানেজ করা প্রায় দুঃসাধ্য। তবুও বড়দা একা একা সব চাপ নিয়ে আব্বার সুচিকিৎসা করিয়েছেন। বন্ধুদের থেকে নিরুপায় হয়ে ধার-দেনা করেছেন। দুঃখজনক এবং কষ্টদায়ক হলেও সত্যি, হাতে গোনা ২/৪ জন আত্মীয় ছাড়া বেশিরভাগ কাছের মানুষের থেকে তখন কোন সাহায্য পাইনি। কারো থেকে একবার ডায়ালাইসিসের ৪/৫ হাজার টাকা পাওয়াও যে তখন কত বড় উপকার সেটা অনেকেই অনুধাবন করেনি, করতে চায়নি। যাদের সাহায্য করার সামর্থ্য ছিল তাদের অনেকে বাংলা সিনেমার শেষ দৃশ্যে পুলিশ যেমন আসে তেমনি নামমাত্র ভূমিকায় সাহায্যের জন্য এসেছিল আব্বা আই.সি.ইউ’তে থাকাবস্থায়। 
আমার দেখা আমাদের পরিবারের সবচেয়ে বড় সঙ্কটময় সময় ছিল ২০১৩ । এমনও হয়েছে আমি ফার্মগেট থেকে পলিথিনে করে মাত্র ৩ কেজি চাল কিনেছি যেখানে ছোটবেলা থেকে ৫০ কেজির বস্তা ছাড়া চাল কিনতে দেখিনি। এমন একটা সময়ে আমি বেকার বসে! ক্যাডেট হিসেবে মাসে ২০০ ডলার বাসায় দিতে পারলেও বিরাট উপকার হয় কিন্তু সে সুযোগটা কোথায় পাবো? কে দিবে?

কারো রেফারেন্স পেলে তাড়াতাড়ি জাহাজে উঠার সুযোগ পাবো ভেবে এক মধ্যরাতে মেসেঞ্জারে একাডেমির কমান্ড্যান্ট সাজিদ স্যারকে মেসেজ দিলাম। স্যার কোথাও আমার সিভি ফরোয়ার্ড করলে একটু আলাদাভাবে দেখবে বলেই আমার বিশ্বাস ছিল। স্যার মেসেজ পেয়েই বললেন আমার সিভি আর বাকি ডকুমেন্টস ইমেইল করে দিতে। দু’দিন পরেই দেখি স্যার Hong Lam Marine (HLM) Pte Ltd. এর ক্রুয়িং ম্যানেজার কেট এনের কাছে আমার সিভি ফরোয়ার্ড করেছেন!! HLM এ সাজিদ স্যারের সিনিয়র নওশাদ শাহ্ স্যার, স্যারের ব্যাচমেট মামুন স্যার (কয়েকমাস আগে পরলোকগমন করেছেন) আর জুনিয়র ইফতেখার স্যারও ছিলেন যাদেরকে উনি নিয়মিত মেইল করেছেন, আপডেট জানতে চেয়েছেন আমার জবের ব্যাপারে। বলতে সংকোচ নেই, ফেসবুকে যখন দেখতাম ব্যাচমেটদের অনেকেই দেশ-বিদেশ থেকে উঠে যাচ্ছে জাহাজে তখন একটু হলেও বুকে কাঁপন লাগতো! মনে হতো, যদি এখন আমি ওর জায়গায় জয়েন করতে পারতাম তাহলে আব্বার জন্য সামান্য কিছু হলেও টাকা পাঠাতে পারতাম, বড়দাকে সাপোর্ট দিতে পারতাম!

একদিকে পরিবারের সঙ্কট, অন্যদিকে জব না হওয়ার ফ্রাস্ট্রেশনের সময় Hong Lam Marine আমাকে প্রচন্ড স্বস্তি এনে দিয়েছিল। HLM এর আশা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, সেই দুঃসহ সময় পার করতে সাহায্য করেছিল। রাতে শুয়ে ফ্রাস্ট্রেশনে এপাশ-ওপাশ করে সাজিদ স্যারকে মেসেজ দিয়ে ভোর বেলায়ই রিপ্লাই পেতাম! যখন-তখন, প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক কত মেসেজ দিয়েছি তবুও স্যার কখনো বিরক্ত হননি বা মেসেজ ইগনোর করেননি। বরং এতো ব্যস্ততার মাঝেও আমার ইমেইলের ড্রাফট  দেখে প্রয়োজনে ভাষা পরিবর্তন/সংশোধন করে দিয়েছেন।

আশায় থাকার কয়েকমাস পরেও Hong Lam থেকে কোন ধরনের কনফার্মেশন পাইনি। এর প্রথম কারণ ছিল ওদের সব জাহাজে ক্যাডেট নেয়ার সুযোগ ছিলনা। দ্বিতীয়ত, আমাদের আগের ব্যাচগুলোর কিছু ক্যাডেট HLM এ ক্যাডেটশীপ শেষ করে ওখানে আর কন্টিনিউ করেনি-যে জন্য বাংলাদেশী ক্যাডেট নিয়োগে ওদের অনাগ্রহ  ছিল। সাজিদ স্যার তবু নিয়মিত ইমেইল করতেন কেট এন আর বাকিদের কাছে যেহেতু HLM অফিসিয়ালি রিজেক্টও করেনি আমাকে।

২০১৩ সালে ASP Shipmanagement এর ডেলিগেটস একাডেমিতে ক্যাডেট নির্বাচনের জন্য আসবে শুনে সাজিদ স্যার নিজে আমার ইমেইল, সিভি ক্রস-চেক করে ২৯ তম ব্যাচের শাকিল আহমেদ মাহিন স্যারকে পাঠাতে বলেছিলেন স্যারকে CC দিয়ে। ইমেইলের CC, BCC নিয়ে তখন কোন ধারণাই ছিলনা আমার। সাজিদ স্যারের সাথে ইমেইলে যোগাযোগ করা থেকেই ইমেইল লেখার ধরন, CC, BCC এসব শিখেছি। যদিও ASP ডেলিগেটস আসার আগেই আমি জাহাজে জয়েন করায় শেষ পর্যন্ত ইন্টারভিউ দিতে পারিনি। তা না হলে পজিটিভ কিছু হতো বলেই আমার দৃঢ়বিশ্বাস।  সাজিদ স্যার আব্বা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন সময়েও ফোন করেছেন, খোঁজ-খবর নিয়েছেন।

২০১৮ তে সিংগাপুরে ক্লাস-টু পরীক্ষার Letter of Eligibility (LOE) এর জন্য জাহাজ থেকে MPA তে এপ্লাই করেছিলাম। এপ্লাই করার পর ফিরতি মেইলে আমার মেইন সার্টিফিকেটের স্ক্যানড কপি পাঠাতে বলে যেটা আমি তখনো তুলিনি একাডেমি থেকে। সে মুহুর্তে জাহাজ থেকে সেটা কালেক্ট করাও আমার পক্ষে সম্ভব ছিলনা। সাজিদ স্যারকে আমার সমস্যাটা জানাতেই বললেন, একাডেমিতে আমার পরিচিত কোন জুনিয়রকে যেন স্যারের সাথে ইমিডিয়েট দেখা করতে বলি। সৌভাগ্যক্রমে আমার খুব কাছের এক জুনিয়র, সেতু, তখন পোস্ট-সী ব্লকে ছিল। সেতু স্যারের সাথে দেখা করে আমার হয়ে সব ফর্মালিটি সম্পন্ন করে সার্টিফিকেট তুলে আমাকে পাঠায়। সাজিদ স্যার আমাকে সে সুযোগটা না দিলে, এতটা আন্তরিক না হলে হয়তো প্ল্যানমতো সিংগাপুরে পরীক্ষা দিতে পারতাম না।

আমি এখন যে জাহাজে আছি সেটাতে জয়েনিংয়ের আগেও একটা সমস্যায় পড়ে সাজিদ স্যারের সাহায্যপ্রার্থী হয়েছিলাম এবং বরাবরের মতো সেবারও স্যারকে পাশে পেয়েছি। গত অক্টোবরে লাস্ট জাহাজ থেকে নামার সাত মাস পর প্রমোশনসহ জয়েনিং প্ল্যান পেয়ে ১৪ দিনের ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ করছিলাম। কিন্তু জয়েনিংয়ের ৫ দিন আগে আমার সিঙ্গাপুরের ভিসা এপ্লিকেশন রিজেক্টেড হয়, ফলশ্রুতিতে জয়েনিংও। সিঙ্গাপুরে প্রায় ৭ মাস থেকে ক্লাস-টু পাশ করার পরেও ভিসা না দেয়ার যৌক্তিক কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এরপর কোম্পানি জানায়, আমার নামের বানানে হাইফেন থাকায় ভিসা এপ্লিকেশন রিজেক্টেড হয়েছে। সিঙ্গাপুর অফিস থেকে আমাকে নতুন করে হাইফেন বাদ দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে পাসপোর্ট বানাতে বলা হয় আপডেটেড নিয়ম অনুযায়ী। এটা শুনে আমি যেন অথৈজলে পড়লাম! প্রশাসনিকভাবে বা পাসপোর্ট অফিসে আমার পরিচিত কেউ নেই যে কোনভাবে সাহায্য করতে পারে। নিরূপায় হয়ে জরুরি ভিত্তিতে পাসপোর্টের প্রয়োজনীয়তার কথা সাজিদ স্যারকে জানিয়ে জিজ্ঞেস করলাম স্যারের পরিচিত কেউ আছে কিনা যে আমাকে সাহায্য করতে পারে। স্যার তখনই আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের ডেপুটি ডিরেক্টর শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ স্যারের ফোন নাম্বার মেসেজ করে সকালে গিয়ে দেখা করতে বললেন। পরেরদিন আগারগাঁও যাবার পর সাজিদ স্যার নিজে ওয়ালীউল্লাহ স্যারকে ফোন করে বলেছিলেন আমার ব্যাপারটা একটু বিশেষভাবে দেখতে যেন দ্রুত পাসপোর্ট হাতে পাই। এরপর স্যারদের আন্তরিকতা আর আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি সময়মতো ই-পাসপোর্ট পাই এবং পরবর্তীতে সিঙ্গাপুর থেকেই জয়েন করি।  

সাজিদ স্যারের সাথে পাসিং আউটের পর একবার মাত্র দেখা হয়েছিল। সেটাও সেই ২০১৫ তে, একাডেমিতে  ক্লাস-থ্রী প্রিপ্যারেটরি কোর্স করার সময়। দেশে থাকাকালীন সময়ে স্যারের সাথে ফোনে কথা হয় মাঝে মাঝে। স্যারের ফোনে আমার নাম্বারটা সেইভ করা আছে নিশ্চয়ই, তা না হলে ফোন রিসিভ করেই  “ওয়ালাইকুম আসসালাম মাহমুদ! কেমন আছো, তোমার আম্মু কেমন আছেন” নিশ্চয়ই বলতেন না। 
আজকে (১ সেপ্টেম্বর) শ্রদ্ধেয় সাজিদ স্যারের জন্মদিন। মহান আল্লাহ সাজিদ স্যারকে সুস্থ আর দীর্ঘ কল্যাণকর জীবন দান করুন-আমীন।

পরিশেষে, সাজিদ স্যারের মতো যারাই আমাদের মতো জুনিয়রদের প্রয়োজনে সবসময় পাশে দাঁড়িয়েছেন/দাঁড়াচ্ছেন, নিঃস্বার্থভাবে সাপোর্ট দিয়েছেন/দিচ্ছেন তাদের সকলের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। আল্লাহ আপনাদের মতো উদার মনের মানুষদের ছায়ায় আমাদেরকে আরও শত-সহস্র বছর থাকার সুযোগ দান করুন।।


কৃতজ্ঞতায়,আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (৪৭/ই) | ১ সেপ্টেম্বর ২০২১

Share