নাবিকের মানসিক স্বাস্থ্য: আতিয়া (৪৯ তম ব্যাচ)
বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি তে যখন জুনিয়র ক্যাডেট হিসেবে দিন পার করছি তখন প্রতিদিন মনে হত…. এই বিশ্বমানের একাডেমি তে শারীরিক কঠোর পরিশ্রম আর প্রচুর লেখাপড়া এর পাশাপাশি ইমোশনাল /সাইকোলজিক্যাল /ক্লিনিক্যাল মেন্টাল হেলথ রিলেটেড নুন্যতম স্টাডি র প্রয়োজন।
এই যে মাটিতে বসবাসের উপযোগী মানুষ গুলো লোহা আর নোনাপানি কে জীবনসঙ্গী করে নিচ্ছে, সেটা চাট্টিখানি ব্যপার নয় কিন্তু!! so they need more mental health care and knowledge
বলাবাহুল্য একাডেমি তে এই রিলেডেট কোন স্টাডি না থাকলে ও এই একাডেমি ই আমাদের মানসিক ভাবে এতটা স্ট্রং করে তুলে যে সাত সমুদ্রে ভয়াল ঝড় বা যে কোন বিপদে,ভীত হওয়ার বদলে নিজের সবটুকু দিয়ে জাহাজ আর মালামালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেউ পিছপা হয় না।
ঝামেলা টা হলো ২০১৬ সালে যখন নিজে জাহাজে চাকরি করতে শুরু করলাম।
একি!!!! একেকটা মানুষ কে দেখলে মনে হতো বহুকাল ধরে লোহা আর নোনাপানিতে থাকতে থাকতে এরা আর মানুষ নেই।
এজন্যই বোধ করি এদের কে সর্বজন গৃহিত জেন্ডার Men or Women না বলে #Seaman বলা হয়!!!!
এরা জাহাজি শুধুই জাহাজি এটাই তাদের পরিচয়!!!!
কিন্তু এই মানুষ গুলার ত জীবন আছে, তাদের অপেক্ষায় তাদের পরিবার আছে। এরা ও স্বাভাবিক মানুষের মতই জীবন উপভোগ করতে চায়।
আবার পরক্ষনেই মনে হতো আমি নতুন, নয়তো গাধা এমন মনে হচ্ছে কেন আমার, সবাই ত দিব্যি আছে।
এইসব আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে দিন চলে যাচ্ছিলো।
২০১৭ সাল,গ্রাজুয়েশন এর থিসিস এর টাইম এলো। বন্ধু বান্ধবী রা সবাই তোড় জোড় নিয়ে লেগেছে দাত ভাংগা জ্ঞান মূলক টপিক নিয়ে। সিজিপিএ বাড়াতে হবে বলে কথা।
আমার মাথায় এখনো ঘুড়পাক খাচ্ছে সেই নোনাপানি র নাবিকের মনের অবস্থা, মানসিক স্বাস্থের অবস্থা। খুব জানতে ইচ্ছা করলো আমি ই কি অতিরঞ্জিত ভাবছি নাকি এমন কিছু সবার মাঝেই কম বেশি আছে।
স্রোতের বিপরীতে গিয়ে স্থির করলাম এটা নিয়েই থিসিস করবো। আমার এতো দিনের আগ্রহ যা নিয়ে তাই নিয়েই এবার গরুখোজা হবে।
কিন্তু এ কি!!! সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি কানাখুসা শুরু করলো। সম্মানিত কয়েকজন সিনিয়র মেরিনার ডেকে জানিয়ে দিলো আমার এটা চেঞ্জ করা উচিত। সময় থাকতে যেনো চেঞ্জ করে ফেলি। ক্লোজ বন্ধবীরা বুঝাতে চাইলো এমন পাগলামি করলে নাকি সিজিপিএ ২ পাবো!!!!!
সিজিপিএ নিয়ে কোন কালেই মাথা ব্যাথা ছিলো না।তাই এসব কানে না নিয়ে কাজ শুরু করলাম৷
ঢাকা ভার্সিটি এবং জগন্নাথ এর বান্ধবী দের সহযোগিতা য় ওদের লাইব্রেরি তে গিয়ে স্টাডি শুরু করলাম। যেই আমি জিবনে কোন দিন এক্সাম এর দুদিন ছাড়া লেখাপড়া করি না,অলস, কামচোর সে আমি কিনা এই টপিক নিয়ে দিন রাত পড়েই যাচ্ছি। ওদের লাইব্রেরি সব থিসিস পরে শেষ করে ফেলছি। নোট করছি।
কি আজব যুগে যুগে মানুষ পুলিশ, আর্মি, নার্স,পাইলট, টিচার, ওয়ার্কিং মাদার, স্পেশাল চাইন্ড ইভেন প্রসট্রিটিউট দের নিয়ে ও কাজ করেছে।কিন্তু নাবিক নামক যে একটা প্রফেশন আছে সেটা কেউ বোধ হয় জানেই না!!!!! অথচ নাবিক তার জীবন ভর দেশের এবং পুরো বিশ্বের ট্রেড এ ভুমিকা রাখে ৯৫% international trade আমাদের দিয়ে হয়।
যেহেতু দেশি কোন লেখা বা জরিপ নাই।বিদেশি লেখা গুলো পড়া শেষ করলাম।
কলম হাতে নিলাম, মাঠে নামলাম। সবাই ল্যাপটপ এ বসে থিসিস করছে।আর আমি সবার দরজায় দরজায় গিয়ে দীর্ঘ অপেক্ষা করে জানতে চাইছি স্যার আপনার জিবনের বিষন্নতার অধ্যায় গুলা বলেন….. আপনার দেখা জাহাজি জিবনের অন্যদের গল্প গুলা বলেন। যারা কথা বলতে চায় না তাদের দিলাম গুগল ফর্ম।
এভাবে ৩ মাসে আমার ভান্ডার ভরে গেলো সাদাকালো অংসখ্য গল্পে,জানলাম কত হাসিখুশি প্রিয় মুখ সমুদ্রের নীল জলে নিজেকে বিসর্যন দিতে গিয়ে ও দেয় নি। জানলাম আমার শিপের ই কেউ রাতের অন্ধকারে বোট ডেকে দাড়িতে থাকতো একটা ঝাপ দেবার সাহসের আশায়। কিন্তু কোন দিন টের পাই নি। জানলাম অনেকের প্রিয় বন্ধুর আত্নহত্যার গল্প।জানলাম একজন গোল্ড মেডেলিস্ট এর ৩ বার আত্নহত্যার চেষ্টা র পর সার্থক হবার গল্প।
জানলাম অনেকেই আর তার পরিবারে থাকতে চায় না। জানলাম অনেকেই পরিবার ছেড়ে পালিয়েছে। অনেকে চাইলে ও তার পরিবার তাকে আর আপন করে নেয় না তারা চায় শুধু টাকা।আরো কত গল্প যা বলে শেষ করা যাবে না…….
আমি অবাক হতাম। কখনো চোখ ঘোলা হয়ে যেত।আমি তখন যেনো নতুন করে এই নোনাজলের মানুষ গুলোকে ভালোবাসতে শুরু করলাম। নতুন করে চিনলাম জানলাম অনেক কিছু।
যার ৫০% ও আমি আমার dissertation paper এ দিতে পারি নাই। কিন্তু শিখেছি।জেনেছি। ভালোবেসেছি।
এর পর থেকে থেকে সব সময় ভাবি সুযোগ এলে এই বিষয় টা নিয়ে কাজ করবো। আমাকে অনেক কিছু শিখতে হবে জানতে হবে। সেই চেষ্টায় এই বিষয়ে লেখালেখি চালিয়ে যাই। maritime journal এ যায়গা করে নেয় সেই লেখা । শেখার জন্য “welfare at sea” নামক কর্মশালায় যোগ দেই। মেন্টাল হেলথ রিলেটেড কিছু কোর্স করি। আরো একটু বিস্তারিত জানতে” primary clinical mental heath” ৩ মাসের একটা প্রশিক্ষণ নেই। এখন ও আরো অনেক কিছু জানতে শিখতে চাই।
খুব ভালো লাগে যখন দেখি এখন অনেকেই এই বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। থিসিস এর টপিক হিসেবে বেছে নিচ্ছে।তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে plagiarism থেকে বের হয়ে আসার।
ভালো থাকুক জাহাজিরা এটাই চাওয়া
Atiya Ananna, 49N [atiya.ananna49@gmail.com]
Recent Comments