[SMC Magazine ‘নোঙর’] ফেডাগালপিয়া : গাজী আবু তাহের (১৭)

[SMC Magazine ‘নোঙর’] ফেডাগালপিয়া : গাজী আবু তাহের (১৭)

ছোটবেলায় বাবার মুখে শুনতাম “এই সেদিনই তো পাঠশালায় যেতাম, আজ চাকরী শেষে অবসরে যাচ্ছি”, শুনে খুব হাসি পেত — সময়ের কি পা আছে? সময় আবার চলে যায় কিভাবে? আজ বুঝতে পারি বাবার সেদিনের কথা অর্থ! টিক টিক করে কখন যে জীবন নামের সেই ঘড়িটার কাঁটা এগিয়ে গিয়ে সময়কে অতীত করে দিল তার হিসাব রাখার সময়ই তো পেলাম না। হাওয়ার বেগে কখন শৈশব থেকে কৈশোর তারপর যৌবন পেরিয়ে জীবনের মধ্যভাগে পাড়ি জমাতে বসেছি, বুঝতেই পারলাম না। এভাবেই বুঝি সময় পেরিয়ে যায় যুগ থেকে শতাব্দীতে!

সাগরে সময় ধাবিত হত তড়িৎগতিতে। নয়নাভিরাম সুর্যোদয় আর তার সাথে ছিল ডিউটি! সমুদ্রের বিভিন্ন অবস্থার মাঝে সপ্তাহের দিন-তারিখ ঠিক না থাকলেও রকমারী খাবারের মেন্যু ঠিকই মনে করিয়ে দিত আজ কি বার।

সমুদ্রের যে কত রূপ — সেই বহুরূপী সাগরের সাথে নাবিকের জীবন অতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে এ তো সকলেরই জানা। বৃহৎ কুসুমসম সুর্যের অস্ত যাওয়ার যে সৌন্দর্য, সেই সৌন্দর্যের মুগ্ধতায় পরিতৃপ্ত নাবিকের চোখ। আঁধারের রূপ সমুদ্রে যেন অপরূপ সুন্দর! গোধূলীর পরই ঘটতো মিটিমিটি তারার আবির্ভাব। শুরু হয়ে যেত সব নেভিগেটরদের ছুটাছুটি, কিশু অংক কষাকষি, তারপর একরাশ তৃপ্তিময় Position Fixing.

আজ এগুলো শুধুই গল্প। বিজ্ঞানের অভিনব উদ্ভাবনে এসবই এখন স্কৃনে পাওয়া যাচ্ছে সর্বক্ষণ। নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে স্যাটেলাইটগুলো।

বিরামহীনভাবে চলছে জাহাজের ইঞ্জিন – এও এক বিস্ময়! দিনের পর দিন প্রায় একই গতিতে, কখনো ফুসলে ওঠা সফেন ঢেউ কখনো বা শান্ত পানি চিরে জাহাজ চলছে তো চলছেই। গন্তব্য যত দূরেই হোক না কেন তা থেকে নিস্তার নেই নাবিকের। গতির এই ধারা অব্যাহত রাখতে ব্যস্ত প্রকৌশলীরা।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে আছে বিশ্রামের সময়। আর অন্তত ডিনারের পর আকটা আড্ডা। সুতরাং সময় ধরে রাখার মত কোন ফুসরৎ নেই। ব্রীজে ডিউটির এক মিশ্র অনুভুতি আজ লেখার মূল প্রতিপাদ্য।

একেক সাগরে ডিউটি ও বিউটির ধারা একেক রকম। ট্রাফিক যেখানে যত বেশি, নার্ভ সেখানে তত সজাগ — সময়ও পাল্লা দিয়ে ছুটে যায় Watch এর ক্রান্তিলগ্নে। আবার এমনও প্রহর যায়, দিন যায়, সপ্তাহ যায় ট্রাফিক কখনো থাকে আবার কখনো থাকেনা। কিন্তু তাই বলে কাজ কিংবা সময় কোনটাই তো আর থেমে থাকে না। ডিউটির এই নিয়মমাফিক কাজের সাথে যে ব্যাক্তিটি সবচেয়ে বড় সহযোগী হয় বা তখন হতো তার নাম ‘সুকানী’। প্রকৌশলী বন্ধুরা তেলওয়ালার কাছ থেকে পেত নানান তথ্যের সম্ভার। এই watch সঙ্গিদের একেকজন একেক নামে ডাকতো। কী সুখানী, কেউ Shukani, কেউ কোয়ার্টার মাষ্টার ইত্যাদি। আমার উল্লেখ্য সুকানী একজন প্রবীণ অ অভিজ্ঞতার রসে পুষ্ট নাবিক, যাকে বলে প্রুডেন্ট সেইলর। তাই ছোট ছোট সাগর পারি দিয়ে যখন মহাসাগরে প্রবেশ করতাম তখন তার অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলতে থাকতো একের পর এক। প্রথমেই বলে রাখি, গল্প জমতো তখনই যখন সাগর শান্ত কিংবা অশান্তের মাঝামাঝি। সাগরের রুদ্র মূর্তিতে যখন চাচা আপন প্রাণ বাঁচা তখন এগুলো কেবল গালমন্দেই রূপ নিত। এমনই এক মজার ঘটনা বলি — আমার সাথে যে সুকানী ডিউটি করতেন তিনি একটু চুপচাপ স্বভাবের হলেও রাত দশটায় চা-চক্র অর্থাৎ সফর (Supper) খাওয়ার পর তার কথাবলার ইচ্ছেগুলো যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো।
ঃ স্যার, বইলতে ফারেন জাহাজে সবছেয়ে ছালাক কে? আমি জাইনতাম আফনে বইলতে ফাইরবেন না। আঁই বইলছি — আঁই, আমি আরি – সাদামাটা উত্তর।
ঃ ‘বাহ! আপনি এত confident!’  কিছুটা অবাক হয়েই বললাম।
ঃ স্যার আঁর rank হইলো যাই Sea Cunny অর্থাৎ আঁই Sea Cunning মানে ছালাক-ছতুর।
ঃ ‘বাহ বেশ তো! এইভাবে তো কখনো ভেবে দেখেনি।‘
বেশ বুঝতে পারলাম, যে এই ভদ্রলোক তার analytical brain নিয়েও নাড়াচাড়া করেন। এভাবেই তার কাছ থেকে অনেক কিছুই জেনেছি, শিখেছি – অবশ্য বেশিরভাগই হাসির খোরাক!!!

ছোট্ট কয়েকটি দ্বীপ পার হয়ে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করেছি। মিষির মত কালো রাত কিন্তু আকাশ খুব একটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না। মেঘ জমেছিল দিকচক্রবাল জুড়ে। তেমন ট্রাফিকও ছিল না। সুকানী তার গল্প শুরু করলেন—
ঃ স্যার, কলম্বো ফার হইছি দুইদিন, তারফর কি ঘইটলো যানেন নি? বড়ো বড়ো ক’খান চিংড়ী মাছ আমাগো জাহাজ আটকি ধইরলো – আঁই এরোন্ডা জাহাজে তকন ছাকরী কইত্তাম। — ঐ জাহাজ কয়লা দি চইলতো। নতুন ছাকরী, অবশ্য হের এগে ব্যাং লাইনে (Bank Line) কিছু সফর কইচ্ছি কিন্তু এই দরনের গটনা গটে নাই। ক্যাপ্টেন সাবে জাহাজ খারা করি ছাগল, মুরগী ফালাইতে থাকলো। এক সময় ছিংড়ী মাছের রাগ ছুটি গেলে আঁরা রওয়ানা অইলাম।

কতগুলো বছর এই সাগরে কেটেছে, কিন্তু কোন চিংড়ীতো দুরের কথা কোন তিমিকেও কখনো জাহাজ আটকাতে দেখিনি। আজ স্টীম শীপও নেই, সেই চিংড়ীও নেই। ব্যাং লাইনও নেই।

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে আটলান্টিকে এসেছি মাত্র। স্পেনকে ডানে রেখে উত্তরে যাচ্ছি ইংল্যান্ডের একটি বন্দরে। জাহাজের দুলুনির চরিত্র টের পেয়ে যেন সুকানী বুঝে গেলেন জাহাজের তৎক্ষণিক অবস্থান।

প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, “স্যার, জাহাজ কি বয়া বিস্কুটে হইরসে নি?”

চাকরী জীবনে সেই প্রথম আমার বয়া বিস্কুট খাওয়ার অভিজ্ঞতা। ক্রমশইঃ সাগর উত্তাল হতে লাগলো। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির সাথে কনকনে ঠান্ডা বাতাস। একবার ডানে, একবার বামে কখনো পেচিয়ে পেচিয়ে আছাড়! মনে থাকবে ১২-১৪ ঘ্নটার সেই তিক্ত আবেগ ঘন অভিজ্ঞতা, সুকানীর সহানুভুতি।

এবার যাচ্ছি আমারিকা। আটলান্টিকে ১১/১২ দিন থাকতে হবে। বড় বড় ঢেউ আছে, তবে ঝড়ো আবহাওয়া নয়। ট্র্যাফিক নেই। কেবল রাতের সাক্ষ্য অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্রের মাঝে কিছু মিটি মিটি আলো। এমনই এক রাতের গল্প।
ঃ স্যার, তেলবাড়ি চুন শাবান যাইতে এইবার কম সময় লাইগবো। আকাশ কিলিয়ার।
আমার ঠোঁট ও চোয়াল বিস্তৃত হল। ভিরমী খাওয়ার পালা! তালবাড়ি, শাবান — এই আঞ্চলিক শব্দগুলো যে navigational jargon এ যুক্ত হয়েছে তাও জানলাম সেই রাতে।

বড় পর্দায় সিনেমা দেখার চল ছিল আমাদের সময়ে। তাই চৌধুরী বাড়ী, সারেং বৌ ইত্যাদির সাথে পরিচয় ছিল কিন্তু তেলবাড়ির সাথে পরিচয় ঐদিন থেকে; আর শাবান, ববিতা তখনকার হিট নায়িকা তাই তাদের চিনতাম, কিন্তু বন্দরের নাআম শাবানা – এই প্রথম শুনলাম।

এভাবেই একটু একটু রসালাপে এগিয়ে যেত দিন।

আরেক রাতে সফর খেতে খেতে কিছুটা কৌতুহল বশতঃই প্রশ্ন করেছিলাম, আমার বুদ্ধিমান নাবিক Sea Cunny কে।

“আপনি আমেরিকার কোন কোন দেশে ঘুরেছেন? “
এমন অদ্ভুত সুন্দর জবাব আমি আর কখনো শুনিনি আর কখনো শুনবো কিনা তাও জানিনা।
ঃ স্যার, আমেরিকার উত্তর-দক্ষিণ ব্যাক ঘুরি ফেইলছি। এই দিরেন শাবানা, হোশটন, ন’ফক, নিউয়ক, ফেডাগালপিয়া।
ভুল শুনেছি ভেবে আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম। আবারো সেই একই উত্তর! — ফেডাগালপিয়া!

কাপ থেকে চা আমার  হাতে পড়ে যাবার উপক্রম হল। কোন্রকমে নিজেকে সামলে নিলাম এই যাত্রা! কিন্তু তাতে বক্তার কোন ভাববৈকল্য হল কিনা জানিনা। কেননা তিনি নির্দ্ধিধায় বলে যাচ্ছিলেন অনেক যায়গা, অনেক নতুন নাম। কিন্তু আমার আর কিছুই শোনা হয়নি। সবকিছু ছাপিয়ে শুধুই প্রতিধ্বনিত হয়েছে একটি শব্দ, ফেডাগালপিয়া!

আনন্দ-হতাশা সকল স্মৃতির ভান্ডারে আজও একটা বড় স্থান জুড়ে আছে — ফেডাগালপিয়া!

 

————————-
Taher 17

[একজন নৈমিত্তিক লেখক।  চারপাশে যা ঘটে তা থেকেই জীবনের আনন্দ খোঁজার চেষ্টা করেন। নাবিক জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সমুদ্রযাত্রার অভিজ্ঞতা নিয়ে সাপ্তাহিক বিচীত্রায়  “প্রবাস থেকে” কলামে   নিয়মিত লিখতেন]

Share