উত্তমাশা অন্তরীপের দুলুনী – রেফায়েত ইবনে আমিন (২০ই)
আমার তো ধারনা ছিলো আফ্রিকা মানেই জঙ্গল, অনুন্নত দেশ। কিন্তু আমি সেই ১৯৮০-র দশকেই সাউথ আফ্রিকার শহরগুলোকে দেখেছিলাম উন্নত বিশের যে কোন শহরের চেয়ে কম নয়। ইউরোপ অ্যামেরিকার মতই সুন্দর সুন্দর বিল্ডিং, দোকান-পাট। আমি ক্যাবল-কারে করে টেবিল মাউন্টেনের উপরে গিয়েছিলাম। সাড়ে তিন হাজার ফুট উঁচু পাহাড়, কিন্তু উপরে একদম সমান সমতল জায়গা (মালভূমি)। দূর থেকে দেখতে আসলেই একটা টেবিলের মত ফ্ল্যাট লাগে। এটা এই শহরের অনেকগুলোর মাঝে একটা বিশেষ আকর্ষন।
আপনারা অনেকেই হয়তো গর্জনশীল চল্লিশার (Roaring Forties) নাম শুনেছেন বা ভূগোল ক্লাসে পড়েছেন। চল্লিশ ডিগ্রী দক্ষিণ অক্ষরেখা থেকে আরো নীচের দিকে (দক্ষিণে) নামতে থাকলে প্রচন্ড সামুদ্রিক বাতাসের সম্মুখীন হতে হয়। সেই বাতাসের এতই শব্দ, যে সেটাকে তখন আর হু-হু বা শো-শো বলা চলে না; রীতিমত গর্জনের মতই শোনায়। তীব্র বাতাসের বেগে সব কিছুই উড়িয়ে নিয়ে লন্ডভন্ড করে দেয়। চিলি-আর্জেন্টিনা, সাউথ আফ্রিকার নীচের অংশ, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এসমস্ত ঘিরেই সেই চল্লিশ অক্ষরেখা। প্রকৃতপক্ষে চল্লিশ থেকে সাতচল্লিশ/আটচল্লিশ ডিগ্রীর মাঝে এরকম ভয়াবহ বাতাস হয়। সেখান দিয়ে জাহাজ চালানো বেশ দুরূহ; অথচ আবার এককালে পালতোলা জাহাজের সময়ে, নাবিকেরা সেই বাতাসেরই অনুকূলে পাল খাটিয়ে, সুবিধামত কাজে লাগিয়ে জাহাজের স্পীড বাড়িয়ে নিতো (Clipper Route)। এখনো অনেক সৌখিন এডভেঞ্চারাস লোক সেরকম করে পালতোলা বোট/ইয়ট চালায় বা রেস করে।
আরো বলি, গর্জনশীল চল্লিশা তো মাত্র শুরু। এবারে নীচের দিকে, মানে দক্ষিণে নামতে শুরু করুন। Roaring Forties-এর চাইতেও বেশী আছে – “Furious Fifties” এবং আরো দক্ষিণে “Screaming Sixties” কেউ কেউ বলে “Shrieking Sixties” (বাতাসের আওয়াজ অপেরাশিল্পীর মত চীৎকার করতে পারে আরকি)। বাতাসের গতি এবং ঝড়-ঝঞ্ঝা এতই ভয়ংকর যে, আদিকালের নাবিকেরা বলতো, ‘চল্লিশ ডিগ্রীর নীচে কোনো দেশের কোনো আইন-কানুন নাই, পঞ্চাশ ডিগ্রীর নীচে কোনো ঈশ্বর নাই, আর ষাট ডিগ্রীর নীচে কোনো বিশ্বই নাই’। মনে রাখবেন, কুমেরুর অবস্থান হলো নব্বই ডিগ্রীতে।
এতক্ষণ তো শুধু বাতাসের কথাই বললাম। এবারে সমুদ্রের বিক্ষুব্ধ উত্তাল পানি আর স্রোতের ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করি। আমরা ব্রাজিল থেকে মাল বোঝাই করে দক্ষিণ আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে সাউথ আফ্রিকার নীচ দিয়ে ঘুরে উপরের দিকে উঠা শুরু করতাম। উত্তমাশা অন্তরীপের (Cape of Good Hope) নাম নিশচয়ই শুনেছেন। সেখানে আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর দুইটা মিলেছে – মানে দুই সাগরের পানিই সেখানে আছড়া-পাছড়ি করছে। সেই সাথে রয়েছে নীচে অ্যান্টার্টিকা বা কুমেরুর প্রভাব। সব মিলিয়ে বুঝতেই পারছেন কী একটা দুর্গম জলপথ। প্রতিমাসেই একবার করে পাড়ি দিতাম সেই পথে। একবার ব্রাজিল থেকে মধ্য-প্রাচ্যে, তারপরে ফিরতি পথে আবার ব্রাজিল। উত্তমাশা দিয়ে প্রতিবারে যেতে যেতে মনে মনে “উত্তম আশা”-ই করতাম – আল্লাহ্ যাতে সহী-সালামতে নিরাপদে স্থানটুকু পার করিয়ে দেয়। কী যে দুলুনী চলতে থাকে, দিনের পর দিন ক্রমাগত দুলছি তো দুলছিই। একদম রুটিন বেঁধে দুলুনী। তবে মাঝে মধ্যে রুটিন ভেঙ্গে ঝোড়ো বাতাস তেড়েফুঁড়ে এসে নর্মাল দুলুনীকে আরো জটিল করে দেয়। তখন আমরা রোলিং থেকে শুরু করে pitching, heaving, yawing, cork-screwing সবই করতে থাকি। সেজন্যই তো প্রথম যে ইউরোপীয়ান এই কেইপ অফ গুড হোপ দিয়ে জাহাজ নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলো, বার্থোলোমিউ ডায়াজ, সে এটার নাম দিয়েছিলো Cape of Storms – খুবই মানানসই নাম। আমরা ব্রাজিল থেকে যাওয়ার পথে জাহাজ মাল নিয়ে ভর্তি থাকতো, তার ফলে দুলুনী একটু কম হতো। কিন্ত, ফিরে আসার সময়ে, জাহাজ একদম খালি। তখন ব্যালাস্ট ট্যাঙ্কে সমুদ্রের পানি ভরে ভরে কিছুটা ওজন বাড়িয়ে জাহাজকে থিতু করার চেষ্টা করা হতো। দুনিয়ার অন্যান্য জায়গায় সেটা হয়ে যায়; কিন্তু কেইপ অফ গুড হোপে লোডেড ব্যালাস্টও খুব বেশী কাজ দেয় না।
কেইপ অফ গুড হোপ নিয়ে দুইটা ভ্রান্ত ধারনা আছে। একটা হলো, এটাই সাউথ আফ্রিকার সবচাইতে দক্ষিণের পয়েন্ট; আর দ্বিতীয়টা হলো – এখানে এতই ঝড়-ঝাপটা হয়, তাই নাবিকেরা গুড হোপ করতে থাকে নিরাপদে পার হয়ে যাওয়ার জন্য (উদাহরণ – আমি)। কিন্তু গুড হোপ নাম হওয়ার অন্য কারণ আছে। পর্তুগীজ রাজা অনেক বছর ধরে অনেক টাকাপয়সা খরচ করে অনেক অভিযাত্রী পাঠিয়েছিলেন আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে ভারতবর্ষে পৌঁছানোর জলপথ আবিষ্কারের আশায়। এই বার্থোলোমিউ-ই প্রথম, যিনি আফিকার সর্বদক্ষিণ পয়েন্ট ঘুরে উত্তরের দিকে গিয়ে বুঝেছিলেন ভারতে যাওয়া সম্ভব। যদিও পরবর্তীতে ভাস্কো-ডা-গামাই প্রথম ভারত পৌঁছান। কিন্তু বার্থোলোমিউর আবিষ্কারে রাজার মনের আশা আবারো চাঙা হয়ে উঠে, এবং সেই আশা যাতে না হারিয়ে যায়, তাই তিনি বার্থোলোমিউর দেওয়া নাম কেইপ অফ স্টর্ম পালটে কেইপ অফ গুড হোপ রাখলেন। আর দ্বিতীয় ভ্রান্তি – কেইপ অফ গুড হোপ নয়, সাউথ আফ্রিকার সবচাইতে দক্ষিণের পয়েন্ট হলো Cape Agulhas (আগালাস বা আগুলিয়াস)। এখান থেকে কেইপ অফ গুড হোপের কেইপ পয়েন্ট পর্যন্ত এইটুকু এলাকার মাঝেই দুই মহাসমুদ্রের (আটলান্টিক ও ভারত) পানির মিলন হয় বা ধাক্কাধাক্কি, আছড়া-পাছড়ি হয়।
আমাদের জাহাজ মাঝে মধ্যেই কেইপটাউন, ডারবান, পোর্ট এলিজাবেথ ইত্যাদিতে থামতো। আমার তো ধারনা ছিলো আফ্রিকা মানেই জঙ্গল, অনুন্নত দেশ। কিন্তু আমি সেই ১৯৮০-র দশকেই সাউথ আফ্রিকার শহরগুলোকে দেখেছিলাম উন্নত বিশের যে কোন শহরের চেয়ে কম নয়। ইউরোপ অ্যামেরিকার মতই সুন্দর সুন্দর বিল্ডিং, দোকান-পাট। আমি ক্যাবল-কারে করে টেবিল মাউন্টেনের উপরে গিয়েছিলাম। সাড়ে তিন হাজার ফুট উঁচু পাহাড়, কিন্তু উপরে একদম সমান সমতল জায়গা (মালভূমি)। দূর থেকে দেখতে আসলেই একটা টেবিলের মত ফ্ল্যাট লাগে। এটা এই শহরের অনেকগুলোর মাঝে একটা বিশেষ আকর্ষন। পাহাড়ের উপরে সেখানে খুবই সুন্দর পার্ক আছে, সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর জন্য খুবই ভালো একটা জায়গা। কিন্তু সবচেয়ে দৃষ্টি কেড়ে নেওয়া দৃশ্য হলো পাহাড়ের উপর থেকে নীচে কেইপটাউন শহর এবং শহর ছাড়িয়ে বন্দর হয়ে সমুদ্র। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্য সেখানে উপভোগ করার মত। শহরের মধ্যে বড় বড় ডিপার্টমেন্টাল এবং ব্র্যান্ডনেইমের স্টোর ছিলো – খুবই দামী। মাঝে মাঝে সেগুলোতে ঘুরতে যেতাম, উইন্ডো-শপিং করতাম। আমার জংলি ধারনার ভুল ভাঙ্গলো – দেখলাম যে তাদের জীবনযাত্রার মানও খুব উন্নত এবং সবকিছুই খুবই দামী। তবে যেটা বুকে বেশী বেজেছে, সেটা হলো বর্ণ-বৈষম্যের ব্যাপারটা। রাস্তার সাইনবোর্ডে লিখা দেখেছি – No Blacks Allowed, Only for Whites ইত্যাদি। আমি ১৯৮৭/৮৮ সালের দিকে সেখানে যেতাম। এরপরে ১৯৮৯/৯০-এর দিকে নেলসন ম্যান্ডেলা মুক্তি পাওয়ার পরে, ধীরে ধীরে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়। এই কেইপটাউনের অদূরেই সমুদ্রের মাঝে রয়েছে রোবেন আইল্যান্ড (Robben Island), যেখানে ম্যান্ডেলা ১৮ বছর বন্দী ছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার আরেকটা জিনিস লক্ষণীয় – দেশটার বিকেন্দ্রীকরণ পলিসি। রাজধানী প্রিটোরিয়া হলেও, এদের পার্লামেন্ট হচ্ছে কেইপটাউনে। প্রিটোরিয়াতে খালি প্রেসিডেন্ট বসেন। আর অন্য একটা শহর ব্লোমফোন্টেইনে (Bloemfontein) জুডিশিয়াল রাজধানী বা সুপ্রীম কোর্ট। এভাবে তারা সবকিছু একজায়গায় ক্ষমতার কেন্দ্র না করে রেখে, ছড়িয়ে দিয়েছে। ব্রাজিলেও একই ব্যাপার দেখেছি – একটা বড় শহরে রাজধানী বানিয়ে সেটাকেই সবকিছুর কেন্দ্র করে নাই। রাজধানী ব্রাসিলিয়াতে করে, বিকেন্দ্রীকরণ করেছে। অথচ আমাদের দেশে, ঢাকা ছাড়া কোন কাজই হয় না।
সাউথ আফ্রিকায় প্রচুর ভারতীয় বংশোদ্ভূত রয়েছে। তারা বংশ-পরম্পরায় সেদেশে রয়েছে। অনেক অনেক আগে বৃটিশ আমলে সেখানে গিয়েছিলো ভারত থেকে, এরপরে রয়েই গেছে। তাদের উত্তরপুরুষেরা এখন সেখানের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে। মহাত্মা গান্ধীও কিন্তু লন্ডনে আইন পাশ করে সেখানে ছিলেন। খেয়াল করলাম – সাদা চামড়ারা সব প্রশাসনে ও উচ্চপদে, ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা ব্যবসায়ী বা আমলা ক্যাটাগরিতে, আর অধিকাংশ কালো মানুষই দারিদ্রসীমার নীচে, এবং সবকিছু থেকে বঞ্চিত। সে ছিলো সেই আশীর দশকের কথা, এখন অনেক কিছুই বদলেছে। তবে, বর্ণবৈষম্য বাদ দিলে, সেই তখনই আমার কাছে সাউথ আফ্রিকাকে খুবই ভালো লেগেছিলো।
আমার একটা অনুরোধ – কারো যদি কোনো বিষয়ে কোনো কৌতুহল থাকে, তাহলে আমাকে refayet@yahoo.com ই-মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।
উত্তমাশা অন্তরীপের দুলুনী – দৈনিক আজাদী (dainikazadi.net)
রেফায়েত ইবনে আমিন (২০ই), টলিডো, ওহাইও, ২০২২
refayet@yahoo.com
Recent Comments