প্যারানাগুয়া – রেফায়েত ইবনে আমিন (২০ই)

প্যারানাগুয়া – রেফায়েত ইবনে আমিন (২০ই)

কিন্তু আমার কাছে প্যারানাগুয়া অন্যরকম লাগতো। সেইসময়ে এই শহরটাকে, নিজের হোমপোর্ট মনে করতাম। শহরটার নাম এসেছে সেখানের আদিবাসীদের ভাষা থেকে যার মানে বিশাল গোলাকার সমুদ্র (Great Round Sea); ম্যাপে ভালোমত লক্ষ্য করে দেখলে আসলেই দেখা যায়, আটলান্টিক সেখানে বৃত্তাকার একটা উপসাগর হয়ে গেছে, নাম – প্যারানাগুয়া বে।

দক্ষিণ আটলান্টিকের কোল ঘেঁষে, ব্রাজিলের একটা ছোট্ট ছিমছাম বন্দরের নাম প্যারানাগুয়া (Paranaguá), যেখানে আমি ১৯৮৭/৮৮ সালে মিস্ট্রাল নামের এক রীফার জাহাজে কাজ করার সুবাদে বেশ অনেকবার গিয়েছিলাম মালামাল লোড করার জন্য। রিও-ডি-জানিরো আর সাও-পাওলো (স্যান্টোস) – এই দুটোই ব্রাজিলের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বন্দর, আমি সেগুলোতেও গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কাছে প্যারানাগুয়া অন্যরকম লাগতো। সেইসময়ে এই শহরটাকে, নিজের হোমপোর্ট মনে করতাম। শহরটার নাম এসেছে সেখানের আদিবাসীদের ভাষা থেকে যার মানে বিশাল গোলাকার সমুদ্র (Great Round Sea); ম্যাপে ভালোমত লক্ষ্য করে দেখলে আসলেই দেখা যায়, আটলান্টিক সেখানে বৃত্তাকার একটা উপসাগর হয়ে গেছে, নাম – প্যারানাগুয়া বে।

Map of Paranaguá

প্যারানাগুয়া থেকে আমরা মধ্য-প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের জন্য কলা, ফ্রোজেন চিকেন, মাটন আর বীফ নিতাম। মাঝে মাঝে সাউথ আফ্রিকাতেও সেই কার্গোর কিছুটা খালাস করতাম। একটা জিনিস খেয়াল করবেন, চিকেন-মাটন-বীফ যদি মধ্য-প্রাচ্যে যায়, তাহলে সেগুলো হালাল ভাবে জবাই করতে হবে। ব্রাজিলে প্রচুর লেবানীজ ও সিরিয়ান দেখেছিলাম। তারা সেই বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই এখানে চলে এসেছিলো ইমিগ্র্যান্ট হিসাবে। অধিকাংশই ছিলো লিভ্যান্ট খ্রীষ্টান, কিন্তু কিছু কিছু মুসলিমও ছিলো। তারাই সেখানে বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীতে কেউ কেউ সেখানে বসে এই ইন্টারন্যাশানাল হালাল মাংসের বিজনেস শুরু করে। আমরা সেগুলোই নিয়ে যেতাম।

Paranaguá Bay 

ব্রাজিল দেশটা অত্যন্ত সুন্দর এবং শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যই না, প্রাকৃতিক সম্পদেও সমৃদ্ধ। আমার সেখানের ফল-ফলারি খুবই ভালো লাগতো। পৃথিবীর অনেক দেশই ঘুরে বেড়াবার সুযোগে, আমি দেখেছি থাইল্যান্ড এবং ব্রাজিলের ফল সবচেয়ে ভালো স্বাদের। আমার মনে আছে, ব্রাজিলিয়ান কলা এতই বড় যে, একটা শেষ করতে আমাকে বেশ কষ্ট করতে হতো। একবারেই পেট ভরে যেত। তাদের আমও খুব মিষ্টি, রসালো এবং মাংসালো, মোটা-তাজা। সেই কারনেই তো আমাদের জাহাজ এখান থেকে কলা নিয়ে যেতো মধ্য-প্রাচ্যের দেশগুলোতে। ব্রাজিল কফি, আঁখ, সয়াবীন, কাঠ ইত্যাদি আরো অনেক কিছুর জন্য বিখ্যাত। আঁখের রস থেকে চিনি এবং ইথানল বানানোর ব্যাপারে তারা বেশ এগিয়ে। এই ইথানল গাড়ীর জ্বালানীর বদলে ব্যবহার হয়। ইন্ডাস্ট্রীর দিকেও তারা বেশ উন্নত দেশ। সেদেশে জার্মানীর লাইসেন্সে ভক্সওয়াগন গাড়ি বানানো হয়, ব্রাজিলের তৈরী এম্ব্রেয়ার (Embraer) প্লেন এখন বিশ্বের সব উন্নত দেশের বিমান বহরে আছে। তারা স্টীল, কপার, এলুমিনিয়াম ইত্যাদিও প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করে, এবং বিশ্ব-বাজারে এগুলোর চাহিদাও প্রচুর। সেজন্যই তো পনের-বিশ বছর আগে সৃষ্টি হয়েছিলো চারদেশ মিলে নতুন সুপার-পাওয়ার নাম BRIC (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া ও চায়না)। যদিও সেটা বেশীদিন স্থায়ী হয় নাই।

তবে, সেই ৮৭/৮৮ সালের দিকে আমি যখন যেতাম, তখন ব্রাজিলের অর্থনীতির খুবই খারাপ অবস্থা ছিলো। মুদ্রাস্ফীতি (inflation) ছিলো চরম, এবং জনগনের জন্য অসহনীয়। আমরা যারা বিদেশ থেকে সেখানে যেতাম, আমাদের পকেটে থাকতো অ্যামেরিকান ডলার, আমাদের খুবই লাভ হতো; অথচ স্থানীয় জনসাধারনের নাভিশ্বাস উঠার মত অবস্থা তখন। আমার মনে আছে, আমি যেবারে প্রথম সেখানে যাই, তখন তাদের মুদ্রার নাম ছিলো ক্রুজেরো (Cruzeiro); এক ডলারে একশো-দেড়শো ক্রুজেরো পেতাম। আমরা প্রতি দেড় বা দুইমাস পরে সেখানে ফেরত যেতাম মালামাল বোঝাই করতে। আমার দ্বিতীয়বারে, দেখি ডলারে ৬০০ ক্রুজেরো। এরপরে ১,৪০০ তারপরের বার দুই হাজারের উপরে। অবস্থা এমনই হলো যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্যে সরকার বাধ্য হয়ে নতুন মুদ্রা বাজারে ছাড়লো ক্রুজেডো (Cruzado) নাম দিয়ে। এক ক্রুজেডো হলো এক হাজার ক্রুজেরোর সমান। তারপরেও মানুষের ভোগান্তির শেষ নাই। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই – ট্যাক্সীভাড়া সেদেশে মিটারেই চলে। কিন্তু দৈনিক মুদ্রাস্ফীতি এতই প্রকট ছিলো যে, মিটারে যেই ভাড়া আসতো সেটা কোনমতেই চালকের জন্য ন্যায্য হতো না। মিটার তো বছরে বা দুই বছরে একবার এডজাস্ট/ক্যালিব্রেট করে, কিন্তু মুদ্রা তো প্রতিদিনই ভয়ঙ্করভাবে মূল্য হারাচ্ছে। সেজন্য, প্রতিদিন সকালে সব ট্যাক্সী-ড্রাইভাররা সিটি-কর্পোরেশান থেকে একটা দৈনিক কনভারশান-রেইটের চার্ট নিতো। মিটারে যেই ভাড়া উঠবে, চার্ট দেখে মিটারের ভাড়ার অনুপাতে সেদিন কতো ভাড়া হলো সেই হিসাব করে যাত্রী থেকে আদায় করবে। কী দুর্বিষহ সেই মুদ্রাস্ফীতি! সেখানে মুদ্রাস্ফীতির হার ২,০০০% থেকে ৩,০০০% হয়েছিলো – যেটা কিনা সাধারণত ২% থেকে ৬% এর মাঝে থাকে।

আর ক্রুজেরো থেকে ক্রুজেডো বা এর উল্টা, এরকম শুধু যে আমার সময়েই একবার হলো তা নয়। ব্রাজিলে এরকম করতে হয়েছে পাঁচ-ছয়বার। প্রতিবারেই নতুন মুদ্রার এক ইউনিট হয়েছে পুরাতন একহাজার ইউনিটের সমান। অবশ্য, বর্তমানে বেশ কয়েক বছর ধরে আমি লক্ষ্য করেছি তাদের মুদ্রা কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে, এবং নতুন মুদ্রার নামকরণ করেছে Real (উচ্চারন করে হিয়েল)। মুদ্রার এরকম অবমূল্যায়ন অনেক দেশেই হয়ে থাকে। আমি ২০০৫ সাল থেকে বেশ অনেক বছর তুরস্কে আসা-যাওয়া করতাম। সেখানেও এরকম হয়েছে, তাদের পুরাতন এক মিলিয়ন লিরার বদলে নতুন এক লিরা পাওয়া যেতো!

বলছিলাম প্যারানাগুয়ার কথা আর চলে গেছি ব্রাজিলের মুদ্রাস্ফীতির আলোচনায়। প্যারানাগুয়ার পোর্টে গাঙচিলের মত একধরনের পাখী দেখতে আমার খুবই মজা লাগতো। আমাদের চট্টগ্রামে যেমন বঙ্গোপসাগর থেকে কর্ণফুলি নদী ধরে এসে বন্দরের জেটিগুলো। প্যারানাগুয়ায় কিন্তু সেরকম কোন নদী নাই। একদম দক্ষিণ অ্যাটলান্টিকের সঙ্গেই লাগানো প্যারানাগুয়া বে, সেখানেই বন্দর এবং জেটি। সেকারনে অনেক সামুদ্রিক পাখীও আছে সেখানে। পোর্টে জাহাজে বসে বসে আমি দেখতাম সেই পাখীগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে। সেখান থেকেই হঠাৎ করে তিন চারটা পাখী বেশ হাই-স্পীডে ফাইটার-জেটের মত ডাইভ দিয়ে, পাখা গুটিয়ে নিয়ে পানির মধ্যে ডুবে গেলো। হঠাৎ দেখলে মন হবে সেগুলো গুলি খেয়ে মারা যেয়ে পানিতে পড়ে গেলো বুঝিবা। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পর, প্রায় পাঁচ-দশমিনিট পরে, আবার তারা ভুশ্‌শ্‌ করে পানি থেকে বের হয়ে শাঁ শাঁ করে মুখে মাছ নিয়ে উড়ে চলে যায়। পরে জেনেছি এগুলোকে গ্যানেট (gannet) পাখী বলে। একদম টর্পেডোর স্পীডে পানিতে ঢুকে; এবং অনেকক্ষণ ধরেই ডুবসাঁতার দিয়ে পানিতে থেকে মাছ ধরে। তারা পানির তলায় থেকেও দুয়েকটা মাছ গিলে খেয়ে নেয়, এরপরে উঠার সময়ে একটা মুখে ধরে উড়াল দেয়। এত সময় ধরে পানির তলায় পাখী থাকতে পারে, সেই ধারনাই আমার ছিল না। আর, তার উপরে সেগুলো যেইভাবে গুলি খাওয়া বকের মত পানিতে পড়তো, আমি প্রথম প্রথম মনে করতাম যে অনেকগুলো পাখী একসাথে মারা গেলো বুঝি। তারপরে দেখতাম তারা ঠিকই উঠে এসেছে – সেটাই তাদের মাছ-শিকার করার টেকনিক। আমি জাহাজের ডেকে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা সেই পাখীগুলোর মাছ ধরা দেখে কাটিয়ে দিতাম।

ব্রাজিলের লোকজন খুবই ভালো এবং বন্ধুবৎসল মনে হয়েছে। বিশেষ করে, তাদের ইকোনমিক ক্রাইসিসের সময়ে আমরা যখন সেখানে যেতাম, আমরা ডলার খরচ করতাম। তাদের জন্য সেটা ছিলো একটা আশীর্বাদস্বরূপ। আমাদের একটু আলাদা খাতির করতো। আমি মিস্ট্রাল জাহাজের পরেও, অন্যান্য আরো অনেক জাহাজেই ব্রাজিলের নানান পোর্টে গিয়েছিলাম। সেগুলো নিয়েও লিখে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবো। আমার একটা অনুরোধ – কারো যদি কোনো বিষয়ে কোনো কৌতুহল থাকে, তাহলে আমাকে refayet@yahoo.com ই-মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।

প্যারানাগুয়া – দৈনিক আজাদী (dainikazadi.net)


রেফায়েত ইবনে আমিন (২০ই), টলিডো, ওহাইও, ২০২২
refayet@yahoo.com

Share